অনলাইন জব স্ক্যাম
প্রতারণায় বাংলাদেশিরা যেভাবে জড়িত, প্রতিরোধে যা করণীয়
‘ঘরে বসে দিনে তিন হাজার টাকা আয়’— আকর্ষণীয় এমন চাকরির প্রলোভনে পড়ে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক লোক প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মোটা অঙ্কের টাকা খুইয়ে নিঃস্ব হওয়ার সংখ্যা একশ’র কম নয়। তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা। তবে, সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে রাজি হন না অনেকে। এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত মোট ৪০টি মামলা রুজু হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খুইয়েছেন।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, অনলাইন চাকরির নামে প্রতারণার যাবতীয় কার্যক্রম দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হলেও মূলহোতারা সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেন না। এজন্য তারা ব্যবহার করেন বাংলাদেশি এজেন্টদের।
বিজ্ঞাপন
অনলাইন চাকরির নামে প্রতারণার যাবতীয় কার্যক্রম দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত হলেও মূলহোতারা সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেন না। এজন্য তারা ব্যবহার করেন বাংলাদেশি এজেন্টদের। প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হয় দুই শ্রেণির বাংলাদেশিদের। একটি পক্ষ হচ্ছেন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদের এজেন্ট। অপর পক্ষ হলেন বাংলাদেশি তরুণ ফ্রিল্যান্সাররা
প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হয় দুই শ্রেণির বাংলাদেশিদের। একটি পক্ষ হচ্ছেন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিকাশ ও নগদের এজেন্ট। অপর পক্ষ হলেন বাংলাদেশি তরুণ ফ্রিল্যান্সাররা। এ কাজে জড়িত অধিকাংশ বিকাশ ও নগদের এজেন্ট ঢাকার বাইরে অবস্থান করছেন। তবে, ফ্রিল্যান্সাররা ঢাকার মধ্যকার। তারা বিভিন্ন কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্তে নেমে জানতে পারে, এখন পর্যন্ত তারা যত বিকাশ ও নগদের এজেন্ট বা ফ্রিল্যান্সারকে গ্রেপ্তার করেছেন তাদের অধিকাংশের বাড়ি টাঙ্গাইলে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে অন্য যাদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে তারাও টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, গোপালপুর, মধুপুর, ঘাটাইল, ধনবাড়ী ও কালিহাতী উপজেলার। তাদের বয়স ১৭ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে।
প্রতারকদের হয়ে বাংলাদেশের কিছু অসৎ বিকাশ ও নগদের এজেন্ট প্রতারণার এ টাকা নিজেদের কাছে সংগ্রহ করেন। সেই টাকা পরে তারা ফ্রিল্যান্সারদের কাছে দেন। ফ্রিল্যান্সাররা সেই টাকা নানা কৌশলে বিদেশে অবস্থান করা প্রতারকদের কাছে পাঠান।
অনুসন্ধান বলছে, প্রতারকরা গ্রাহকদের বিনিয়োগের জন্য কিছু বিকাশ ও নগদের এজেন্ট নম্বর দিয়ে থাকেন। গ্রাহকরা সেসব নম্বরে টাকা পাঠান। এজেন্টরা সেই টাকা তুলে ফ্রিল্যান্সারদের কাছে দেন। ফ্রিল্যান্সারদের নির্দেশনা দেওয়া থাকে যে, বাইনান্সের (ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ) মাধ্যমে বিট কয়েন কিনে প্রতারকদের কাছে টাকা পাঠাতে।
সম্প্রতি সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম বিভাগ বাংলাদেশি চক্রের এমন পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সিটিটিসি জানতে পারে যে, বাংলাদেশে প্রতারকদের এ ধরনের বেশ কয়েকটি টিম রয়েছে। প্রতি টিমে একজন বিকাশ এজেন্ট ও পাঁচজন ফ্রিল্যান্সার থাকেন। বিকাশ এজেন্ট শুধুমাত্র অর্থ সংগ্রহ করেন এবং সেই টাকা ফ্রিল্যান্সারদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠান। প্রতিটি টিমে ফ্রিল্যান্সারদের একেকজনের ভূমিকা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
প্রতারকরা গ্রাহকদের বিনিয়োগের জন্য কিছু বিকাশ ও নগদের এজেন্ট নম্বর দিয়ে থাকেন। গ্রাহকরা সেসব নম্বরে টাকা পাঠান। এজেন্টরা সেই টাকা তুলে ফ্রিল্যান্সারদের কাছে দেন। ফ্রিল্যান্সারদের নির্দেশনা দেওয়া থাকে যে, বাইনান্সের (ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জ) মাধ্যমে বিট কয়েন কিনে প্রতারকদের কাছে টাকা পাঠাতে
ফ্রিল্যান্সাররা বিকাশ এজেন্ট থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা সংগ্রহ করেন না। এ কাজের জন্য তারা বিভিন্নজনের কাছ থেকে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ভাড়া নেন। সেই অ্যাকাউন্ট থেকে বিশেষ কৌশলে প্রতারকদের জন্য বিট কয়েন কিনে বিদেশে টাকা পাচার করেন।
আরও পড়ুন
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ভাড়া দেওয়ার জন্য ভিন্ন একটি চক্র রয়েছে। তাদের রয়েছে আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। এ ধরনের অ্যাকাউন্ট মাসিক তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যায়। অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাদের পাঁচ/ছয়টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তারা এসব অ্যাকাউন্ট অন্যকে ভাড়া দেন। নিজেদের এটিএম কার্ড ও চেক বই তুলে দেন ভাড়া নেওয়া ব্যক্তির কাছে। সম্প্রতি সিটিটিসি তাদের অভিযানে ২৭ বছর বয়সী সাঈদ আনোয়ার ওরফে পাপ্পু নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেন। যিনি নিজের এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে করা অ্যাকাউন্ট ফ্রিল্যান্সারদের কাছে ভাড়া দেন। অ্যাকাউন্টগুলো ছিল সিটি ব্যাংকের।
প্রতারণায় সহযোগিতা করার জন্য বিকাশ ও নগদের এজেন্টরা প্রতি লেনদেনে ১০ টাকা এবং দৈনিক মোট লেনদেনের ওপর দুই থেকে পাঁচ শতাংশ কমিশন পান। আর ফ্রিল্যান্সাররা দৈনিক ৫০ মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ছয় হাজার টাকা করে বেতন পান। টাকা পাওয়ার উপায়টাও খুব সহজ। গ্রাহকরা যখন প্রতারকদের কথায় বিকাশ বা নগদে টাকা পাঠান তখন এজেন্টরা সেটি সংগ্রহ করে নিজেদের কমিশন কেটে ফ্রিল্যান্সারদের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেন। ফ্রিল্যান্সাররা নিজেদের বেতন রেখে বাকি টাকা দিয়ে বিট কয়েন কেনেন।
সিটিটিসি জানায়, ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী তারা এখন পর্যন্ত প্রতারণার টাকা সংগ্রহকারী শতাধিক বিকাশ ও নগদ এজেন্টের নম্বর চিহ্নিত করেছে। এ বিষয়ে ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা অ্যাকাউন্টের লেনদেন স্থগিত রেখেছে।
প্রতারণায় সহযোগিতা করার জন্য বিকাশ ও নগদের এজেন্টরা প্রতি লেনদেনে ১০ টাকা এবং দৈনিক মোট লেনদেনের ওপর দুই থেকে পাঁচ শতাংশ কমিশন পান। আর ফ্রিল্যান্সাররা দৈনিক ৫০ মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ছয় হাজার টাকা করে বেতন পান। টাকা পাওয়ার উপায়টাও খুব সহজ। গ্রাহকরা যখন প্রতারকদের কথায় বিকাশ বা নগদে টাকা পাঠান তখন এজেন্টরা সেটি সংগ্রহ করে নিজেদের কমিশন কেটে ফ্রিল্যান্সারদের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেন। ফ্রিল্যান্সাররা নিজেদের বেতন রেখে বাকি টাকা দিয়ে বিট কয়েন কেনেন
ঢাকা পোস্টের কাছে আসা বিভিন্ন অভিযোগ ও মামলার কপি যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, প্রায় ৮০টির মতো বিকাশ ও নগদের নম্বর দিয়ে টাকা লেনদেন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি নম্বর অনেকবার ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বিকাশ নম্বরগুলো হলো- ০১৯৯৮২৮০৬২৮, ০১৯৩২৮৩১৮৮৪, ০১৮৭৮৪৩৫২৩৪, ০১৬১৪৯৫৪০২০, ০১৯৩১৩২৮৬৫০, ০১৯৬৮৫৭০৯৬৭, ০১৬১৬৬৮৩৪৯৬, ০১৩২১৬১২৬৬০, ০১৩২৩২৩৫০৭৬, ০১৮৩১৪০৪৪১২ ও ০১৯০৬৮৮২৮৬২। এ ছাড়া নগদ নম্বরগুলো হচ্ছে- ০১৬০৭৬৩৩০৫৭ ও ০১৬০৭৬৩৭৮৬২।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, ফ্রিল্যান্সাররা যেসব ব্যাংক থেকে বেশি টাকা পাচার করেছেন সেগুলো হচ্ছে- সিটি ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইসলামী ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাংককে জানানো হয়েছে। তবে, কাজের কাজ তেমন একটা হয় না। কারণ, কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টের লেনদেন বন্ধ করার সুপারিশ করতে হলে পুলিশকে আদালত থেকে অর্ডার আনতে হয়। তাই পুলিশ এসব ঝক্কি নিতে চায় না। তবে, ব্যাংকগুলো যদি তাদের সন্দেহজনক লেনদেনগুলো চিহ্নিত করতে পারে সেক্ষেত্রে এসব টাকা পাচার বন্ধ করা সম্ভব।
গ্রাহকদের নম্বর যেভাবে সংগ্রহ করেন প্রতারকরা
অনলাইন প্রতারণায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সবাই বাংলাদেশি। তারা শুধু প্রতারণার টাকা সংগ্রহ করে বিদেশে পাচার করতেন। মোবাইল গ্রাহকদের নম্বর কীভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে, সে বিষয়ে তারা (গ্রেপ্তাররা) কিছুই জানেন না। তবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটির বেশি মোবাইল ব্যবহারকারী প্রতারণামূলক এমন মেসেজ পেয়েছেন। মেসেজ পেয়েছেন খোদ কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামানসহ দেশের সব বাহিনীর সাইবার ইউনিটের সদস্যরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটির বেশি মোবাইল ব্যবহারকারী প্রতারণামূলক এমন মেসেজ পেয়েছেন। মেসেজ পেয়েছেন খোদ কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামানসহ দেশের সব বাহিনীর সাইবার ইউনিটের সদস্যরা
নম্বর সংগ্রহ ও মেসেজ পাঠানোর বিষয়ে পুলিশের তদন্ত বলছে, কোনো সুনির্দিষ্ট নম্বর নয়, র্যান্ডমলি বা আন্দাজে একটি নম্বর সেট করে পরের নম্বরগুলোর ক্রম অনুসারে এসএমএস পাঠাতে থাকেন প্রতারকরা। যেমন- তারা প্রথমে একটি নম্বর সিলেট করল ০১৭*****০০১। এরপর শেষের তিন অক্ষর বদলে ০০২, ০০৩, ০০৪ এভাবে ক্রম অনুসারে র্যান্ডম বা এলোমেলোভাবে মেসেজ দিতে থাকেন।
এসব মেসেজ তারা বাংলাদেশের কয়েকটি এসএমএস সার্ভিস প্রোভাইডার থেকে বাল্ক পরিমাণে কিনে থাকেন। তাদের কাছ থেকে এসএমএস কেনার খরচ পড়ে বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ১৭ পয়সা। এ মাধ্যমে একসঙ্গে সর্বোচ্চ এক লাখ গ্রাহকের মোবাইলে এসএমএস পাঠানো যায়। এসএমএসগুলো গ্রাহকদের কাছে টেলিটকের +৮৮০১৫..., রবির +৮৮০১৮... ও বাংলালিংকের +৮৮০১৯... নম্বর থেকে যায়। তবে, এসব এসএমএস পাঠানোর সঙ্গে দেশের কোনো মোবাইল অপারেটরের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।
২০২৩ সালে ফ্রান্সভিত্তিক ইউরোনিউজ নামের একটি পত্রিকা ‘দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা নাগরিকদের অনলাইন প্রতারণার ফাঁদ’ বিষয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে প্রতারকরা কীভাবে নম্বর সংগ্রহ করে সে বিষয়ে জানার চেষ্টা করে তারা। এ সময় তারা হোয়াটসঅ্যাপ (মেটা), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা- এফবিআই, ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন- ইন্টারপোল ও ইইউ-এর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন এজেন্সি ফর ল এনফোর্সমেন্ট কো-অপারেশনের (ইউরোপল) সঙ্গে কথা বলে। তবে, কোনো সংস্থাই সুনির্দিষ্টভাবে মোবাইল নম্বর সংগ্রহের কোনো উৎস খুঁজে পায়নি।
প্রতিবেদনে নিজেদের বক্তব্যে এফবিআই প্রতারকদের ডাটা (ফোন নম্বর) সংগ্রহের কোনো সুনির্দিষ্ট উৎস বলতে পারেনি। তবে তারা জানায়, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে এ ধরনের এসএমএস পাওয়া এবং প্রতারণার শিকার হয়ে ৬০ দেশের ৫০০ জনের বেশি চাকরিপ্রত্যাশী তাদের ‘ইন্টারনেট ক্রাইম কমপ্লেইন্ট সেন্টার’ বিভাগে অভিযোগ করেছেন।
‘সূত্র’ খুঁজে পায় না পুলিশ, ভরসা কেবল অ্যাকাউন্ট নম্বর
দেশের বাইরে থেকে কারা এ ব্যবসা পরিচালনা করছে, সে বিষয়ে তথ্য থাকলেও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে। তদন্তে তাদের একমাত্র ভরসা বিকাশ-নগদ ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর।
সিআইডি, ডিবি ও সিটিটিসি এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় যাদের আটক করেছে তারা বিকাশ বা নগদের এজেন্ট, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মালিক ও ভাড়া নেওয়া ব্যক্তিরা। এর বাইরে আর কিছুই করার নেই তাদের।
আরও পড়ুন
তবে, যেসব মোবাইল ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে গ্রাহকদের চাকরির মেসেজ পাঠানো হয় এমন তিন/চারটি নম্বরের সূত্র ধরে তদন্ত করে পুলিশ। তারা সরেজমিনে গিয়ে দেখেন নম্বরগুলো কৃষক, শ্রমিক বা সাধারণ মানুষের, যারা বাটন ফোন ব্যবহার করেন।
সম্প্রতি এ ধরনের একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে জানা যায়, ওই ব্যক্তি নিজেও জানেন না তার নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে মেসেজ দেওয়া হয়েছে।
টেলিগ্রামের ভূমিকা কী
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এ ধরনের প্রতারণা অনেকে টেলিগ্রাম স্ক্যামও বলে। গ্রাহকদের মেসেজ নিরাপদ রাখার জন্য বিখ্যাত এ অ্যাপ দিয়েই প্রতারণামূলক কাজটি করা হচ্ছে। তবে, তাদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায় না বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ বিষয়ে তদন্তকারী এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে বিটিআরসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত যোগাযোগ হয়। তারা বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে। তবে, টেলিগ্রাম থেকে এ সহযোগিতা পাওয়া যায় না। তাদের সদিচ্ছা থাকলে এ ধরনের অপরাধ তাৎক্ষণিক বন্ধ করা সম্ভব হতো। তাদের উচিৎ সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে দেওয়া।
টেলিগ্রাম স্ক্যামের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি আদৌ অবগত কি না— জানতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে টেলিগ্রাম প্রেস টিমের কাছে গত ৪ মে তিনটি প্রশ্ন পাঠানো হয়। সেখানে জানতে চাওয়া হয়, তারা এ স্ক্যামের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পেয়েছে কি না, স্ক্যামের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কোনো অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নিয়েছে কি না এবং এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে তাদের মন্তব্য কী?
তবে, ২০ মে পর্যন্ত টেলিগ্রাম প্রেস টিম এ বিষয়ে কোনো জবাব পাঠায়নি।
কত টাকা পাচার হয়েছে, হিসাব নেই কারও কাছে
এ প্রতারণার মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সাররা দেশ থেকে কত টাকা পাচার করেছেন— এর সুনির্দিষ্ট হিসাব কারও কাছে নেই। তবে, একটি চক্রকে গ্রেপ্তারের পর একমাত্র ডিবি জানায়, তাদের ধারণা চক্রটি গত দুই বছরে ২০০ কোটি টাকা পাচার করেছে। তবে, অন্য কোনো সংস্থা টাকা পাচারের অঙ্কের বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি।
আরও পড়ুন
প্রতারণা থেকে একমাত্র বাঁচার উপায় ‘সচেতনতা’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, অনলাইনে চাকরি দেওয়ার এ প্রতারণা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে নিজস্ব সচেতনতা। কাউন্টার টেররিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (সদ্য এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. নাজমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে অনলাইন জব স্ক্যাম একটি মারাত্মক ফাঁদে রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি আমরা এ ধরনের অনেক ঘটনা পাচ্ছি, যারা লাখ লাখ টাকা হারিয়েছেন। এ প্রতারণা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে ব্যক্তিগত সচেতনতা। অনেক গ্রাহকই নিয়মিত মোবাইল বা হোয়াটসঅ্যাপে এ ধরনের চাকরির বিজ্ঞাপন ও লিংক পেতে পারেন। লিংকগুলোতে কোনোভাবেই ক্লিক করা যাবে না। এ ছাড়া, সেসব মেসেজ ডিলিট করে সঙ্গে সঙ্গে নম্বর ব্লক করে দিতে হবে।
পুলিশ জানায়, কেউ যদি এ ধরনের প্রতারণার শিকার হন তাকে তাৎক্ষণিক নিকটস্থ থানায় গিয়ে মামলা করতে হবে। ভুক্তভোগী থানায় গিয়ে পেনাল কোডের ৪০৬ ও ৪২০ ধারায় মামলা করতে পারেন। ৪০৬ ধারাটি ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ করা’ বুঝায়। এ অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা তিন বছরের জেল অথবা জরিমানা। কিংবা জেল-জরিমানা উভয়ই। পেনাল কোডের ৪২০ ধারা অনুযায়ী, প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অপরাধীর সাত বছরের জেল অথবা জরিমানা কিংবা জেল-জরিমানা উভয়ই হতে পারে।
বারবার কেন বিদেশি প্রতারকদের টার্গেট বাংলাদেশিরা
এর আগেও ডোলান্সার, বিডি ক্লিক সেন্টার ও হানি ট্র্যাপের মতো ফাঁদ পাতে বিদেশিরা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাদের ঝোঁকটা বেশি। কেন বারবার বাংলাদেশিদের টার্গেট করা হচ্ছে— জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, সাধারণত সহজ-সরল মনোভাবসম্পন্ন মানুষ এ ধরনের বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হন। তারা ঠিকানা কিংবা মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করে টাকা পাঠিয়ে নিজের চাকরির ব্যবস্থা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। পরে তারা প্রতারিত হন। এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘসময় ধরে চলতে থাকলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে অভিযোগ পেলে তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন।
‘ইদানীং এ ধরনের অপরাধীদের বহু রূপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকায় তাদের গ্রেপ্তার কিংবা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সময় লেগে যায়। তবে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ব্যক্তিকেই সর্বোচ্চ সতর্ক ও সজাগ থেকে এ ধরনের বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত না হয়ে জ্ঞান, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে কর্মের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে এ ধরনের অপরাধীরা প্রতারণামূলক কৌশল থেকে বিরত থাকবে।’
ফ্রিল্যান্সার-নেতৃত্ব যা বলছে
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) সভাপতি তানজিবা রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা এ ধরনের অপকর্ম ও স্ক্যামিংয়ের সঙ্গে জড়িত তারা কোনোভাবেই ফ্রিল্যান্সার হতে পারেন না। এ ধরনের অনেক ঘটনা আমরা শুনেছি যারা অপকর্ম করে ফ্রিল্যান্সার পরিচয় দিয়ে থাকে।
‘ফ্রিল্যান্সারদের একটি আইডি কার্ড দেওয়া হয়। আইডি পেতে তাদের দুই বছর কাজ করতে হয়, কাজের গ্রোথ থাকার প্রয়োজন হয়। আরও কিছু শর্ত আছে। তাই যারা এমন স্ক্যামিং করে ধরা পড়ছে তারা কোনোভাবেই ফ্রিল্যান্সার নন। সাইবার পুলিশ যদি আমাদের সঙ্গে বসে, আমরা তাদের এসব বিষয়ে আইডেন্টিফাই করে দিতে পারব।’
এআর/এমএআর/