সম্প্রতি নিয়োগ বাণিজ্য ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ইতোমধ্যে এ অপরাধে কয়েকজনকে আটক করে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন তৎপরতার পর এবার বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টে (বিআইবিএম) নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে এ সংক্রান্ত একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন বিআইবিএমের নিয়োগ পরীক্ষা কমিটি-২ এর সমন্বয়ক অধ্যাপক মো. মহিউদ্দিন ছিদ্দিক। সেখানে তিনি বিআইবিএমের সহকারী প্রোগ্রামার ও সংস্থার মহাপরিচালকের স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামানের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তোলেন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘একজন কর্মকর্তার নিয়োগ এবং পরীক্ষায় অনিয়মের কারণে বিআইবিএমের ৫০ বছরের অর্জিত সুনাম এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সদ্য সাবেক এক মহাপরিচালক ও বর্তমান মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন কম্পিউটার অপারেটর এবং বর্তমান ডিজির স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামান। নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষার দুর্নীতির সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সব অনুষদ সদস্য জেনে থাকলেও মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলেন না।’

‘সর্বশেষ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালভিত্তিক সিনিয়র অফিসার পদে ভয়াবহ নিয়োগ বাণিজ্য হয়। এ কারণে বিআইবিএম এখন ভীষণ ইমেজ সংকটে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোদাগাড়ীর হতদরিদ্র ১০ ভাই-বোনের পরিবারের সন্তান ব্যাংকের নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষার কাজ করে হয়ে গেছেন বিআইবিএমের শীর্ষ ধনী। বর্তমানে তার সম্পদের পরিমাণ ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার মতো। এ বেপরোয়া দুর্নীতিবাজকে থামাবে কে? কেননা মহাপরিচালক ও তার পরিবারের সদস্যদের অতি ঘনিষ্ঠ স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামান। এখন বিআইবিএমের অনুষদ সদস্যরা তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।’

নাম না প্রকাশের শর্তে এসব অভিযোগ নিয়ে কথা বলেছেন বিআইবিএমের একাধিক অনুষদ সদস্য। তাদের দাবি, ডিজির স্টাফ অফিসার হওয়ায় শাহীনুজ্জামানের এ দুর্নীতির বিষয়ে কেউ কথা বলেন না।

বিআইবিএমের একাধিক অনুষদ সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিজির পৃষ্ঠপোষকতার কারণে শাহীনুজ্জামানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াতে পারেন না। নতুন ডিজি এলে শাহীনুজ্জামান তাদের যেভাবে হোক ম্যানেজ করে ফেলেন। ডিজি ম্যানেজ হতে না চাইলে তার পরিবারের সদস্যদের ম্যানেজ করেন শাহীনুজ্জামান। বর্তমান ডিজির বড় ছেলের সঙ্গে শাহীনুজ্জামানের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে ডিজির ছেলেকে আইফোন ও মেয়েকে আমেরিকা যাওয়ার টিকিট উপঢৌকন হিসেবে দিয়েছেন। এ ছাড়া নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্য থেকে যা আয় করেন সেখান থেকে ডিজিকে ভাগ দেন শাহীনুজ্জামান।

তারা আরও বলেন, কম্পিউটার অপারেটর থেকে সহকারী প্রোগ্রামার হওয়া শাহীনুজ্জামান বর্তমানে অঢেল সম্পদের মালিক। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি সবই আছে তার। তিনি অফিসে যাতায়াত করেন ব্যক্তিগত দুটি গাড়ি দিয়ে। গভর্নরের কাছে অভিযোগ যাওয়ায় তিনি আপাতত কোনো গাড়ি ব্যবহার করছেন না। শাহীনুজ্জামানকে রক্ষা করতে বর্তমান ডিজি সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছেন।

শাহীনুজ্জামানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগপত্রে যা যা উল্লেখ আছে

নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের সত্যতা

ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সদস্যভুক্ত ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২০২১ সালভিত্তিক সিনিয়র অফিসার, আইডি নং-১০১৮০; যেখানে ৯২২ জনের নিয়োগ দেওয়ার জন্য গত ২০২৩ সালের ১০ নভেম্বর প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামান একটি বড় ধরনের নিয়োগ বাণিজ্যে লিপ্ত হন। প্রথমত, প্রশ্ন ফটোকপি কক্ষে পরীক্ষা কমিটির বাইরে কারও মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু মহাপরিচালকের স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামানকে গার্ডদের পক্ষ থেকে নিষেধ করা হলেও তিনি মোবাইল নিয়ে ভেতরে যান। সেমিনার কক্ষে বিভিন্ন কেন্দ্রের জন্য ওএমআর প্যাকেটিং তার দায়িত্বে না থাকলেও তিনি জোরপূর্বক তার সিন্ডিকেটের বাইরের লোকজনকে কৌশলে সরিয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে (মহানগর মহিলা কলেজ) প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ওএমআর প্যাকেটিং করান। পরবর্তীতে ওই কেন্দ্রে তিনি ইনভিজিলেটরের দায়িত্ব পালন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কম্পিউটার অপারেটর থেকে সহকারী প্রোগ্রামার হওয়া শাহীনুজ্জামান বর্তমানে অঢেল সম্পদের মালিক। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমি সবই আছে তার। তিনি অফিসে যাতায়াত করেন ব্যক্তিগত দুটি গাড়ি দিয়ে। গভর্নরের কাছে অভিযোগ যাওয়ায় তিনি আপাতত কোনো গাড়ি ব্যবহার করছেন না। শাহীনুজ্জামানকে রক্ষা করতে বর্তমান ডিজি সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছেন

কেন্দ্রটি থেকে পরবর্তীতে ওএমআর স্ক্যান করার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আসা কর্মকর্তারা ১৫৩টি ব্ল্যাঙ্ক ওএমআর উদ্ধার করেন। যেখানে ইনভিজিলেটরের স্বাক্ষর আছে। এসব ভুয়া ওএমআর স্বাক্ষর শাহীনুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগেও বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক অতুল চন্দ্র পন্ডিত এ ধরনের ওএমআর মেশিনে রিড করার সময় হাতেনাতে ধরেন। কিন্তু মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কিছুই করা হয়নি। 

ফেসবুকে চলে আসে পরীক্ষার প্রশ্ন

সম্প্রতি বিআইবিএম মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি পদোন্নতি পরীক্ষা পরিচালনা করে। ৯০০ জনের ওই পদোন্নতি পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব পান সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশারেফ হোসেন। মহাপরিচালকের নির্দেশে এ কে এম শাহীনুজ্জামানকে টিমে নিয়ে কাজটি করতে গিয়ে বিপদে পড়েন ড. মোশারেফ। অভিযোগ রয়েছে, শাহীনুজ্জামানের মাধ্যমে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফেসবুকে চলে আসে। পরবর্তীতে রাত ১২টায় আবার নতুন প্রশ্ন তৈরি করে প্রিন্ট দেওয়া হয়।

অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের মূলহোতা

২০১৪ সালে অগ্রণী ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিআইবিএম মহাপরিচালকের স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামানের প্রশ্নফাঁস কেলেঙ্কারি তথ্য সর্বপ্রথম সামনে আসে। ওই সময় এক লাখের বেশি প্রার্থীর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হয়। পরীক্ষার সমন্বয়কের দায়িত্বে থেকে প্রশ্নফাঁস করেন শাহীনুজ্জামান। পরবর্তীতে সেই পরীক্ষা বাতিল করা হয়। পরীক্ষার আগেই বিআইবিএম ও অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ই-মেইলে অভিযোগসহ প্রশ্ন চলে আসে। এরপর সেই পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই থেকে সরকারি ব্যাংকের এবং সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তবে, বর্তমানে আবার বিআইবিএমের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সালে প্রশ্ন জালিয়াতি করা সেই শাহীনুজ্জামানকে আবারও পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

মহাপরিচালকের মদদে অপ্রতিরোধ্য শাহীনুজ্জামান

বর্তমান মহাপরিচালক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নির্দেশে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষার সব দায়িত্ব পান স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামান। গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মহাপরিচালকদের (ড. তৌফিক ও ড. আখতারুজ্জামান) সঙ্গে তার পারিবারিক ঘনিষ্ঠতার কারণে একচেটিয়া নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষার কাজ পেয়েছেন এ স্টাফ অফিসার। 

২৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক

স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামান নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্য করে ২০০ থেকে ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। বর্তমানে তার রয়েছে দুটি ব্যক্তিগত গাড়ি। নিজের ব্যবহারের জন্য ৫৫ লাখ টাকা মূল্যের হোন্ডা সিভিক এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য ৮০ লাখ টাকা দামের জিপ। বিআইবিএমের সবচেয়ে দামি মোটরসাইকেলেরও মালিক শাহীন। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান এখন রাজকীয় স্টাইলে চলাচল করেন। থাকেন রাজধানীর ধানমন্ডিতে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে। যেখানে ভাড়া দেন তার বেতনের চেয়েও বেশি।

রাজধানী ঢাকাসহ রাজশাহীতে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এর মধ্যে রাজধানীর ৬০ ফিটে লেগুনা স্ট্যান্ডের গির্জার পাশে নির্মাণাধীন সুউচ্চ ভবনের ১০ থেকে ১২টি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। এর মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি। মেট্রোরেল স্টেশনের কাছে দিয়াবাড়ীতে রয়েছে ১০ কাঠা ও ছয় কাঠার দুটি প্লট। যার বর্তমান বাজার মূল্য ২৫ কোটি টাকার বেশি।

উত্তরার ১৬নং সেক্টরের মাথায় তার ছয় তলা একটি বাড়ির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। রাজধানীর দক্ষিণ বনশ্রীর ১নং রোডে আরও একটি বাড়ির কাজ চলছে। খিলক্ষেত মন্দিরের পেছনে একটি দোতলা বাড়িসহ জায়গা কিনেছেন। নিজ এলাকা চাঁপাইনবাবগঞ্জের জমিদার বনে গেছেন বিআইবিএমের স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামান। গোদাগাড়ী থানার পাশে ৩৭টি দোকানের একটি বিশাল মার্কেট গড়েছেন। যেখানে কয়েকটি ব্যাংকের বুথ বসানো হয়েছে। এ ছাড়া ৬০ বিঘা জমির ওপর গড়ে তুলেছেন বিশাল আমবাগান। যে আম বিআইবিএমের মহাপরিচালকসহ কয়েকজনের বাসায় দফায় দফায় পৌঁছে দেন। এ ছাড়া রাজশাহী শহরের চার রাস্তা মোড়ের কাছে আরও একটি ভবনের মালিক স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামান। এমনকি বিআইবিএমের সবচেয়ে দামি আইফোনটির মালিকও তিনি। বাজারে নতুন আইফোন এলে তা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনেন। উপহার দেন সদ্য সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান মহাপরিচালকের পরিবারের সদস্যদের। 

ডিজির ছেলে-মেয়েকে আইফোন ও বিমানের টিকিট উপহার

বিআইবিএমের সব নিয়োগ ও ব্যাংকের পদোন্নতি পরীক্ষা সমন্বয় করতে গিয়ে প্রশ্নফাঁস করেন শাহীনুজ্জামান। প্রত্যেক পরীক্ষায় ৫০ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত টার্গেট করেন তিনি। যা বিআইবিএমের সব পর্যায়ে ওপেন সিক্রেট।

সম্প্রতি ওয়ান ব্যাংকের স্পেশাল ক্যাডার অফিসার নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে শাহীনুজ্জামানের অর্থ লেনদেনের অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়। যেটি এখন অনেকের কাছে রয়েছে। বিষয়টি বর্তমান ও সাবেক মহাপরিচালককে বলা হলেও তারা তা আমলে নেননি। কারণ, মহাপরিচালকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শাহীনুজ্জামানের রয়েছে বিশেষ সখ্যতা। বিশেষ করে বর্তমান ডিজির বড় ছেলের সঙ্গে রয়েছে তার বিশেষ খাতির। মহাপরিচালকের মেয়ের বিদেশ যাওয়া থেকে শুরু করে বিমানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সব খরচ বহন করেন এ স্টাফ অফিসার।

শাহজালাল ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায়ও প্রশ্নফাঁস

স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামান নিয়োগ ও ব্যাংকের পদোন্নতি পরীক্ষায় সমন্বয়ের কথা বলে পরীক্ষা কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব নেন। কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষার আগের রাতে ফেসবুকে প্রশ্ন চলে যায়। শাহজালাল ব্যাংকের চাপে রাতে আবার নতুন প্রশ্ন তৈরি করে ফটোকপি করা হয়। এসব মহাপরিচালকসহ সবার জানা, কিন্তু অদৃশ্য কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

বিআইবিএমের সব নিয়োগ ও ব্যাংকের পদোন্নতি পরীক্ষা সমন্বয় করতে গিয়ে প্রশ্নফাঁস করেন শাহীনুজ্জামান। প্রত্যেক পরীক্ষায় ৫০ লাখ থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত টার্গেট করেন তিনি। যা বিআইবিএমের সব পর্যায়ে ওপেন সিক্রেট

আতঙ্কে থাকে নিয়োগ পরীক্ষা কমিটি

সম্প্রতি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের একটি বড় নিয়োগ পরীক্ষার টিমে কাজ করেন এ কে এম শাহীনুজ্জামান। সেখানে দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক মো. মহিউদ্দিন ছিদ্দিক বলেন, তার (শাহীনুজ্জামান) অনেকগুলো কুকর্ম আমার নজরে এসেছে। তিনি মহাপরিচালকের কথা বলে প্রশ্নের সফট কপি চান। এ কারণে টিমের আরেক সহযোগী অধ্যাপক এম আর আলম ভাইসহ পুরো টিম প্রথম থেকেই সতর্ক ছিল।

তিনি আরও বলেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়নে বিশেষ কৌশল নেওয়া হয়। মূলত পরীক্ষার্থীদের জন্য এমন প্রশ্ন তৈরি করা হয় যেন স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামান চক্র কোনোভাবে ফাঁস করলেও তার উত্তর যেন তৈরি করতে না পারে। এরপরও বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। স্টাফ অফিসার হওয়ার কারণে পুরো টিমকে আতঙ্ক নিয়ে কাজ করতে হয়।

স্টেশনারি কেনাকাটায়ও দুর্নীতির অভিযোগ

অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষক সম্মানিত অনুষদ সদস্যদের বাড়তি সম্মানীর প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য রীতিমতো চাপ দেন শাহীনুজ্জামান। বিভিন্ন সময় নিয়োগ পরীক্ষা টিমকে বেশি দামে স্টেশনারি কিনতে বাধ্য করেন। নিম্নমানের স্টেশনারি নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ থাকার পরও তা পাত্তা দেন না স্টাফ অফিসার। এক পরীক্ষার হলেই ১০ লাখ টাকার খরচ দেখান। ডিজির নির্দেশে গত ১২ বছর ধরে স্টেশনারি কেনাকাটার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করেন স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামান। এ ছাড়া তিনি আত্মীয়-স্বজনদের অনেককে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি দিয়েছেন।

স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামানের অতি ঘনিষ্ঠ শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত জানে আলম। ব্যাংকের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করেন তিনি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা যায় যে, এর পেছনে মূলত স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামানের চক্র কাজ করেছে।

বিআইবিএমের অধীনে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা বন্ধের দাবি

গত এক যুগের বেশি সময় ধরে স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামান নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। প্রতিটি জায়গায় তার নিয়ন্ত্রণ থাকায় অনুষদ সদস্যরা কিছু করতে পারেন না।

বিআইবিএমের নথি ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামানের সমন্বয় করা সব পরীক্ষা মিরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজে নেওয়া হয়েছে। সেখানে দুই থেকে তিনজন শিক্ষককে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। তার নির্দেশিত সিন্ডিকেটের সদস্যরাও এখন কোটিপতি। তার পছন্দের বাইরে কোনো পিয়ন, দারোয়ান, দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো কাজে সংযুক্ত হতে পারে না। যা নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ। তবে, সবচেয়ে বড় কথা পরীক্ষার কন্ট্রোল রুম নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। ফলে এনসিসি ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, এবি ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ রয়েছে শাহীনুজ্জামানের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় বিআইবিএম থেকে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের কাজ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন সংস্থাটির সমন্বয়ক ও নিয়োগ পরীক্ষা কমিটির অধ্যাপক মো. মহিউদ্দিন ছিদ্দিক।

শাহীনুজ্জামানের দুর্নীতির বিষয়ে যা বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক 

দুর্নীতির এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি তদন্ত কমিটি করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বিআইবিএম মহাপরিচালককে চিঠি দেয়। এ নির্দেশনার পাঁচ মাস অতিবাহিত হতে চললেও এখনও কোনো প্রতিবেদন দিতে পারেনি বিআইবিএম।

চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের স্টাফ অফিসার এ কে এম শাহীনুজ্জামানের বিরুদ্ধে নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষায় অনিয়মের বিষয়ে প্রাপ্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠনপূর্বক এক মাসের মধ্যে একটি তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করার জন্য আপনাদের অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। এ কে এম শাহীনুজ্জামানের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিআইবিএম কর্তৃক আয়োজিত নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষা সংক্রান্ত কার্যক্রমে শাহীনুজ্জামানকে সম্পৃক্ত না করে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করার জন্য অনুরোধ করা হলো। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মানেনি বিআইবিএম

বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামানকে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করার নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেটি মানেনি বিআইবিএম। শাহীনুজ্জামান অতীতের ন্যায় এখন পর্যন্ত মহাপরিচালকের স্টাফ অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষার কমিটিতে তাকে সংযুক্ত করা হচ্ছে।

বিষয়টি ঢাকা পোস্টকে বিআইবিএমের একাধিক অনুষদ সদস্য নিশ্চিত করেছেন।

তদন্ত কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক মো. রিয়াদ ফারজান্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিবেদন না দিলে এ বিষয়ে আমি কথা বলতে পারব না। প্রতিবেদন কবে দেবে, সেটিও বলতে পারছি না।

বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামানকে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করার নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেটি মানেনি বিআইবিএম। শাহীনুজ্জামান অতীতের ন্যায় এখন পর্যন্ত মহাপরিচালকের স্টাফ অফিসার পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এবং নিয়োগ ও পদোন্নতি পরীক্ষার কমিটিতে তাকে সংযুক্ত করা হচ্ছে

এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালককে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপে এসএমএস দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। 

রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা : বাংলাদেশ ব্যাংক

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযোগের ভিত্তিতে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে এবং তাকে (শাহীনুজ্জামান) অন্য জায়গায় বদলির নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই আলোকে তাকে স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট টিমে বদলি করা হয়েছে এবং এখনও তিনি এ শাখায় কর্মরত আছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এমন তথ্য আছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্যের বিষয়ে এখন কিছু বলা সম্ভব হবে না। কারণ, বিষয়টি নিয়ে এখনও তদন্ত চলমান। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্ত কমিটিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কোনো ব্যক্তিবিশেষের নেই।

সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও তদন্ত করতে হবে: টিআইবি

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি (শাহীনুজ্জামান) এককভাবে দুর্নীতি করেননি। কারণ, তার জায়গা থেকে এককভাবে পদোন্নতি বা নিয়োগ বাণিজ্যের সুযোগ নেই। তার এ অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নেপথ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে মহাপরিচালকসহ অন্য সহযোগীরা রয়েছেন। যারা নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন, তাদের যোগসাজশ, অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্ব ছাড়া এটি কোনো অবস্থায় সম্ভব হয়নি। কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কমিটি, যে-ই কাজ করুক না কেন সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও তদন্তের মধ্যে আনতে হবে।

‘শুধু স্টাফ অফিসারের তদন্ত করলেই চলবে না, সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও মহাপরিচালকসহ সবার বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। এর মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এটি হলো বিভাগীয় পদক্ষেপ।’

‘যেহেতু নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্যের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ আহরণের বিষয়টি উঠে এসেছে, সেই কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনকেও তদন্তে এখতিয়ারভুক্ত হওয়া উচিত। কারণ, এখানে বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের আহরণ হয়েছে। এজন্য এটি প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। দুদকের তদন্তের পাশাপাশি জড়িতদের চিহ্নিত করে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত।’

ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, শুধু বিআইবিএম ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তই যথেষ্ট নয়। কারণ, এগুলো বিভাগীয় পদক্ষেপ এবং এ পদক্ষেপের মাধ্যমে কোনো দুর্নীতি নিয়ন্ত্রিত হয় না। কাজেই বিভাগীয় অনুসন্ধান হোক, পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমেও তদন্ত হওয়া উচিত। কারণ, এখানে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের বিষয় আছে।

সব অভিযোগ মিথ্যা, দাবি শাহীনুজ্জামানের

এসব অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্টাফ অফিসার শাহীনুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। কেউ চাইলে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে পারে। কমিটি ইতোমধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছে।’ ‘তদন্ত রিপোর্ট দেখার পরামর্শ দিয়ে ফোন কেটে দেন তিনি।

এসআর/এমজে