অনলাইন জব স্ক্যাম
‘শুয়ে-বসে দিনে ৩০০০ টাকা আয়’, বিদেশিদের জালে নামিদামিরা
‘অভিনন্দন! প্রাথমিক বাছাইয়ে আপনি আমাদের কোম্পানিতে কাজ করার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। আপনার দৈনিক বেতন তিন হাজার টাকা। বিস্তারিত জানতে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ লিংকে যোগাযোগ করুন।’ সম্প্রতি অনেকে ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে এমন খুদে বার্তা (এসএমএস) পেয়েছেন। এটি পেয়ে কেউ আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছেন, আবার কেউ হয়েছেন বিভ্রান্ত। বেশি টাকা আয় করতে ‘চাকরি’র অফার লুফে নিয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলেই কি প্রতিদিন তিন হাজার আর মাসে ৯০ হাজার টাকা ঘরে বসে আয় করা সম্ভব?
অনলাইনে আকর্ষণীয় চাকরির বিজ্ঞাপন নিয়ে অনুসন্ধানে নামে ঢাকা পোস্ট। সাধারণ নাগরিক হিসেবে যোগাযোগ করা হয় চাকরিদাতাদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে। তাদের পরামর্শে রেজিস্ট্রেশন করে শুরু হয় চাকরি। কাজ শুরুর দুদিনের মাথায় জানা গেল এটি চাকরি নয়, বিনিয়োগ করার একটি প্ল্যাটফর্ম। এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে একবার বিনিয়োগ করলে আর টাকা ফেরত আসে না। মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করলে ছলে-বলে-কৌশলে ব্লক করে দেওয়া হয় অনলাইন (টেলিগ্রাম) গ্রুপ থেকে। এরপর সেই ‘চাকরিজীবী’ ওরফে বিনিয়োগকারী হয়ে পড়েন পুরোপুরি নিঃস্ব…।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক লোক এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মোটা অঙ্কের টাকা খুইয়ে নিঃস্ব হওয়ার সংখ্যা একশর কম নয়। তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। তবে, সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে রাজি হন না অনেকে। ওই তিন ইউনিটে এ সংক্রান্ত মোট ৪০টি মামলা রুজু হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সর্বোচ্চ ২৪ লাখ টাকা খুইয়েছেন
অনলাইন কোম্পানিতে এভাবে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হওয়াদের একজন মো. জাহিদ (ছদ্মনাম)। তিন লাখ নয় হাজার টাকা হারিয়ে রাজধানীর নিউ মার্কেট থানায় মামলা করেছেন তিনি। জানান, মোবাইল এসএমএসের (খুদে বার্তা) মাধ্যমে ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর প্রথমবারের মতো প্রতারণার ফাঁদে পা দেন তিনি। ‘হিল প্লাস নৌল্টন স্ট্রাটেজিস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে অনলাইনে চাকরির প্রস্তাব দেওয়া হয় তাকে। প্রস্তাবে আগ্রহ দেখালে ইউটিউবের তিনটি ভিডিও লিংক দিয়ে তাতে লাইক দিতে বলা হয়। লাইক দেওয়ায় তিনি প্রথমে ১৫০ টাকা করে মোট ৩০০ টাকা আয় করেন। এরপর দুই হাজার টাকা বিনিয়োগ করে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। পরবর্তীতে ‘সি-ফিন্যান্স’ নামের একটি (এপিকে ফরম্যাট) অ্যাপে ওয়ালেট অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয়। অ্যাকাউন্টে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি পর্যায়ক্রমে আরও পাঁচ হাজার, সাত হাজার ৫০০, এক লাখ ৪১ হাজার ১৯১ টাকা জমা করেন। তবে, টাকা তুলতে না পারায় তাকে আরও টাকা জমা করতে বলা হয়।
‘তাদের কথা মতো আবারও আমি সিটি ব্যাংকের রাজশাহী শাখার একটি অ্যাকাউন্টে ৪৮ হাজার ৫০০, সিটি ব্যাংকের গোপালগঞ্জ শাখার একটি অ্যাকাউন্টে এক লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকা পাঠাই। সবমিলিয়ে তিন লাখের মতো খরচ হওয়ার পর ধরে নিই যে প্রতারণার শিকার হয়েছি। পরে নিজ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিই।’
আরও পড়ুন
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট, মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ও সিআইডির সাইবার সেল ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক লোক এমন প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মোটা অঙ্কের টাকা খুইয়ে নিঃস্ব হওয়ার সংখ্যা একশর কম নয়। তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। তবে, সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে মুখ খুলতে রাজি হন না অনেকে। ওই তিন ইউনিটে এ সংক্রান্ত মোট ৪০টি মামলা রুজু হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা খুইয়েছেন।
প্রতারণার শিকার হয়েছেন একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রেজেন্টারের স্বামী, বাংলাদেশে গাড়ি অ্যাসেম্বল করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র কর্মকর্তা, চট্টগ্রামভিত্তিক একটি মেরিন সাপ্লাইয়ার প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বর্তমানে নৌ-বাহিনীতে কর্মরত একজন কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেনসহ বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নতুন এ প্রতারণার বিভিন্ন কৌশল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, প্রতারণার কাজটি চলে চীন থেকে। একে ‘চাইনিজ জব স্ক্যাম’, ‘টেলিগ্রাম স্ক্যাম’ নামে সম্বোধন করেন তারা। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো, প্রতারণার এ জাল বিছানো হয় বাংলাদেশিদের দিয়ে। আর প্রতারণার টাকা সংগ্রহ করেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের একটি চক্র।
প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন সমাজের নামিদামিরা
বাংলাদেশে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়ে মামলা করেছেন মোট নয়জন। তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী, বেসরকারি চাকরিজীবী ও সরকারি কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে রয়েছেন- একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রেজেন্টারের স্বামী, বাংলাদেশে গাড়ি অ্যাসেম্বল করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র কর্মকর্তা, চট্টগ্রামভিত্তিক একটি মেরিন সাপ্লাইয়ার প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বর্তমানে নৌ-বাহিনীতে কর্মরত একজন কর্মকর্তা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেনসহ বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা। ঢাকা পোস্টের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী, ভুক্তভোগীরা সর্বনিম্ন তিন লাখ নয় হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৪ লাখ টাকার প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশে প্রতারণার শিকার হওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে প্রথমে তাকে নামিদামি ব্র্যান্ডের মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের কথা বলা হয়। কাজের শুরুতে বাটা, নেসলে, কোকা-কোলা, স্যামসাং- এর মতো ব্র্যান্ডশপ এবং ক্যারোসেল, শপি, লাজাডার মতো আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ও সাবস্ক্রাইব করার কাজ দেওয়া হয়। গ্রাহকরা নামিদামি ব্র্যান্ডের নাম শুনেই উদ্বুদ্ধ হন বিনিয়োগে
ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে ভুক্তভোগী দুজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে, তারা জানান, যেহেতু তারা সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি, ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে— এমন আশংকায় তারা পুলিশের কাছে বিষয়টি জানিয়েছেন। টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো আশাও নেই তাদের।
ঘরে বসে আয়ের ফাঁদ পাতা হয় যেভাবে
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতারক চক্র একজন গ্রাহকের মোবাইলে চাকরি দেওয়ার এসএমএস দেওয়ার পর একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলে অথবা একটি লিংকে চাপ দিতে বলে। লিংকে ক্লিক করলে নিজেকে কাস্টমার কেয়ার অপারেটর হিসেবে পরিচয় দিয়ে নানা তথ্য চান একজন নারী। তিনি গ্রাহকের নাম-পরিচয়, মোবাইল নম্বর, বিকাশ/নগদ নম্বর, এনআইডি নম্বর ও ঠিকানা জানতে চান। এসব তথ্য দিলে তাকে অ্যাড করা হয় একটি কথিত মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানের টেলিগ্রাম গ্রুপে। মূল প্রতারণা হয় এখানে।
গ্রুপে ঢোকানোর পর ওই গ্রাহককে প্রথমে অভ্যর্থনামূলক কথা বলে একটি সহজ কাজ করতে দেওয়া হয়। তিনটি ইউটিউব চ্যানেলের লিংক দিয়ে বলা হয়, এ লিংকগুলোতে গিয়ে ভিডিওতে লাইক এবং পেজ সাবস্ক্রাইব করে টেলিগ্রাম গ্রুপে স্ক্রিনশট দিতে হবে। গ্রুপে লাইক ও সাবস্ক্রাইব করার স্ক্রিনশট পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ ওয়ালেটে পাঠানো হয় ১৫০ টাকা। গ্রাহক বিকাশ বা নগদ নম্বর দিয়ে তা ক্যাশ-আউট করতে পারেন।
বলা হয়, গ্রাহক যদি দুই হাজার টাকা বিনিয়োগ করে তাহলে দুই হাজার ৮০০ টাকা আয় করতে পারবেন। ১৫ হাজার টাকা জমা করলে লাভসহ ১৮ হাজার টাকা পাবেন। এক লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা পাবেন। একপর্যায়ে গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ লাখের মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে বলা হয়। কেউ যদি লোভ সামলাতে না পেরে টাকা জমা দেন, পরবর্তীতে টাকা না দিয়ে নানা অজুহাতে সেই বিনিয়োগের টাকা আর ফেরত দেওয়া হয় না গ্রাহককে। সর্বশেষ টেলিগ্রাম গ্রুপ থেকে তাকে ব্লক করে দেওয়া হয়
এতে গ্রাহকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে নেয় ভুয়া প্রতিষ্ঠানটি। দ্বিতীয় ধাপে তাদের একটি অ্যাপ ইনস্টল করে অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয়। এরপর এ ধরনের আরও তিনটি সহজ কাজ দেওয়া হয়। কাজ করলে টাকা জমা হয় অ্যাকাউন্ট ওয়ালেটে। কিন্তু তারা কেউ টাকা তুলতে পারেন না। টাকা তোলার জন্য কাজের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় নতুন শর্ত। বলা হয়, গ্রাহক যদি দুই হাজার টাকা বিনিয়োগ করে এ তিনটি কাজ সম্পন্ন করে তাহলে দুই হাজার ৮০০ টাকা আয় করতে পারবেন। আর ১৫ হাজার টাকা জমা করলে লাভসহ ১৮ হাজার টাকা পাবেন। ২৮ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা, ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে ৬৫ হাজার টাকা, ৮০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে এক লাখ ১২ হাজার টাকা এবং এক লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে দুই লাখ ২৫ হাজার টাকা পাবেন। এভাবে প্রতি ধাপে কাজের সঙ্গে বিনিয়োগের অর্থের পরিমাণ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে গ্রাহকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ লাখের মোটা অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে বলা হয়। কেউ যদি লোভ সামলাতে না পেরে টাকা জামা দেন, পরবর্তীতে টাকা না দিয়ে নানা অজুহাতে সেই বিনিয়োগের টাকা আর ফেরত দেওয়া হয় না গ্রাহককে। সর্বশেষ টেলিগ্রাম গ্রুপ থেকে তাকে ব্লক করে দেওয়া হয়।
মাত্র ২৬০০ পেয়ে ২ লাখ টাকার বড় বিনিয়োগ, অতঃপর...
বাংলাদেশে প্রতারণার শিকার হওয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, গ্রাহককে আকৃষ্ট করতে প্রথমে তাকে নামিদামি ব্র্যান্ডের মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের কথা বলা হয়। কাজের শুরুতে বাটা, নেসলে, কোকা-কোলা, স্যামসাং- এর মতো ব্র্যান্ডশপ এবং ক্যারোসেল, শপি, লাজাডার মতো আন্তর্জাতিক ই-কমার্স সাইটের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে লাইক, কমেন্ট, শেয়ার ও সাবস্ক্রাইব করার কাজ দেওয়া হয়। গ্রাহকরা নামিদামি ব্র্যান্ডের নাম শুনেই উদ্বুদ্ধ হন বিনিয়োগে।
মুহাম্মদ মাহমুদ হাসান নামের এক ভুক্তভোগী জানান, তার কাছে ২০২৩ সালের নভেম্বরে দৈনিক তিন হাজার টাকা আয় করার মেসেজ আসে। মেসেজে দেওয়া লিংকের মাধ্যমে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলে তাকে বলা হয়, এটি ‘টেকনোবাড়ি’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা আইটিবিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিংয়ের কাজ করে। পরে মাহমুদ ফেসবুকে সার্চ দিয়ে দেখেন এ নামে আসলেই একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখতে পান, টেকনোবাড়ির অফিস মিরপুর-২ এর ‘এ’ ব্লকের ১৪৬ নম্বর বাসায়। যেহেতু প্রতিষ্ঠানটির ঢাকায় অফিস আছে, এ বিশ্বাস থেকে তিনি ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। তবে, টাকা তুলতে পারেননি। এ টাকা তুলতে আরও ২৬ হাজার ৭০০ টাকা দাবি করে কথিত প্রতিষ্ঠানটি।
আরও পড়ুন
মাহমুদ হাসান বলেন, ‘এভাবে বিভিন্ন ধাপে আমার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নেওয়া হয়। পরে কোনো কথা না বলে আমাকে টেলিগ্রাম গ্রুপ থেকে ব্লক করে দেওয়া হয়।’
যে কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া হয় টাকা
ঢাকা পোস্টের হাতে আসা কয়েকটি মামলার তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, ভুয়া ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রথমে দু-তিনবার ১৫০ টাকা করে দেওয়া হলেও পরবর্তীতে আর টাকা তোলা যায়নি। যদি কোনো গ্রাহকের ওয়ালেটে এক লাখ বা তার অধিক ব্যালেন্স থাকে, তাকে বলা হয় ১০ লাখ টাকার বেশি হলে তিনি ক্যাশ-আউট করতে পারবেন। এজন্য তাকে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। এরপর বিনিয়োগ ও লাভের টাকা একসঙ্গে পাবেন।
অনলাইন জব স্ক্যাম সংক্রান্ত একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (এসআই পদমর্যাদা) ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা যেসব ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছি তারা লাখ লাখ টাকা উপার্জন করলেও সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা উত্তোলন করতে পেরেছেন। টাকা উত্তোলন করতে গেলেই টেলিগ্রামের অ্যাডমিন প্যানেল থেকে তাদের ঠুনকো ভুলের অজুহাত দেখিয়ে অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেওয়া হয়।’
আরও পড়ুন
“যারা ১০ লাখের (টাকা) বেশি বিনিয়োগ করে ফেলেন, তাদের সঙ্গেও করা হয় অদ্ভুত এক ধরনের প্রতারণা। কেউ মোটা অঙ্কের টাকা উত্তোলন করতে চাইলে সবচেয়ে প্রচলিত যে সমস্যার কথা বলা হয়, সেটি হচ্ছে ‘ইনকমপ্লিট প্রোফাইল’। টাকা উত্তোলনের সময় বারবার নোটিফিকেশন দেওয়া হয়। বলা হয়, প্রোফাইলে দেওয়া তথ্যের ঘাটতিগুলো দ্রুত পূরণ করুন। কখনও কখনও গ্রাহকের ই-টিন সার্টিফিকেট চাওয়া হয়। সব তথ্য দেওয়ার পরও টাকা তুলতে গেলে ‘প্রোফাইলে ৯৬-৯৭% তথ্য দেওয়া হয়েছে’ বলে জানানো হয়। ‘প্রোফাইলের তথ্য ১০০% দেওয়া হয়নি’ অজুহাতে আর টাকা উত্তোলন করা যায় না।”
এসব সমস্যা সমাধানে অনেক সময় গ্রাহককে একটি টেলিগ্রাম নম্বর দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কথিত মালিকের সঙ্গে চ্যাট করতে বলা হয়।
সাত লাখ টাকা হারানো রাজধানীর পরীবাগ এলাকার আজিজুর রহমান নামের এক ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি সামাদ নামের একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাকে প্রোফাইলের তথ্যে নানা অসঙ্গতির কথা জানান। এরপর তিনি বলেন, আমি যদি আরও তিন লাখ টাকা বিনিয়োগ করি, তাহলে একসঙ্গে ১০ লাখ টাকা তুলতে পারব। আমাকে পাঁচ দিন সময় দেওয়া হয় টাকা জমা দেওয়ার জন্য। পাঁচ দিনের মধ্যে সেই টাকা জমা দিলেও তারা আমার পাওনা টাকা আর দেয়নি। শেষমেশ আমাকে ব্লক করে দেওয়া হয়।’
বনানীর আশিক হোসেন নামের এক গ্রাহক যখন ছয় লাখ টাকা তোলার চেষ্টা করেন, তাকে বলা হয়, আপনার উপার্জিত টাকার পরিমাণ অনেক বেশি। এ টাকা দেশে পাঠাতে ২৫ শতাংশ আয়কর দিতে হবে। আপনি আরও তিন লাখ টাকা ওয়ালেটে ক্যাশ-ইন করলে সব টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। “আমি সাত দিনের মধ্যে সেই টাকা দিয়ে দিই। পরবর্তীতে টাকা উত্তোলন করতে না পারলে তারা আমাকে জানায়, আমার মেসেজে কিছু ইংরেজি বানান ভুল হয়েছে। এ কারণে ভেরিফিকেশন করা যাচ্ছে না যে আমি প্রকৃত গ্রাহক কি না। পরে ‘সন্দেহজনক’ উল্লেখ করে তারা আমার অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়।”
আরও পড়ুন
আশিক হোসেন বলেন, “আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে ছয়-সাতজন ছিল। একজন অ্যাডমিন, একজন কাস্টমার সার্ভিস এজেন্ট এবং বাকিরা আমার মতো সাধারণ গ্রাহক। আমি তিন লাখ টাকা দেওয়ার পর ভেবেছিলাম আর দেব না। তবে, আমাদের বলা হলো এ কাজগুলো গ্রুপভিত্তিক। সবাই একসঙ্গে বিনিয়োগ করলেই টাকা পাব। একজন যদি বিনিয়োগ না করে তাহলে কেউই টাকা পাবে না। আমি যখনই পিছিয়ে পড়তাম, গ্রুপের অন্য সদস্যরা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হতো। তারা বলতো, আমার জন্য তাদের লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। আল্লাহ্র দোহাই দিয়ে টাকা জমা দিতে বলতো। কথায় কথায় কোরান-হাদিসের রেফারেন্স দিত। ‘ইনশাআল্লাহ্’, ‘মাশাআল্লাহ্’ বলতো। এ ছাড়া গ্রুপের সদস্যরা প্রায়ই নিজেদের টাকা পাওয়ার স্ক্রিনশট পোস্ট করতো। স্ক্রিনশট দেখে আসলই মনে হতো। একপর্যায়ে তাদের প্রতি বিশ্বাস রেখে আমি বিনিয়োগ শুরু করি। তবে, পরে মনে হয়েছে তারাও প্রতারক দলের সদস্য।”
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রুপভিত্তিক কাজ দেওয়াও প্রতারণার একটি কৌশল। গ্রুপে এক বা দুজন গ্রাহক থাকেন, বাকি সবাই প্রতারকদের সহযোগী হিসেবে ভুয়া গ্রাহক সেজে থাকেন।
আরও পড়ুন
মূলহোতা কে, কোথা থেকে চলে প্রতারণা
অনলাইন জব স্ক্যামের সঙ্গে কারা জড়িত এবং কোথা থেকে এ প্রতারণা চলে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রমাণসহ কোনো তথ্য নেই। তবে, বৈশ্বিক নানা বিষয় যাচাই-বাছাই করে তাদের ধারণা, এটি চীনের নাগরিকদের কাজ। চীন থেকেই পরিচালিত হচ্ছে এ ব্যবসা।
প্রতারণার সঙ্গে জড়িত এমন বেশ কয়েকটি ওয়েবসাইট ভিজিট করে দেখা গেছে, প্রতিটি ওয়েবসাইটের কন্টেন্টগুলো পড়তে দুটি ভাষা নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে। একটি ইংরেজি, অপরটি চীনা ভাষা।
সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্প্রতি এ ধরনের প্রতারণার অভিযোগে কেরানীগঞ্জ ও দেশের উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা এসএমএস ও ফোন-কলে চাকরির প্রলোভন দিত। তারা দেশের বাইরে থেকে অ্যাপসটা ডেভেলপ করে আনে। তবে, এমন প্রতারণায় বাংলাদেশের অনেকে জড়িত। আমরা মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) দেওয়া প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন এজেন্টকে ধরেছিলাম। যেহেতু এটি একটি অর্গানাইজড ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, কয়েকটি দেশের অপরাধীরা কয়েকটি লেভেলে জড়িত, এ কারণে এক স্তরের অপরাধীরা অন্যদের সম্পর্কে জানে না। মূল অপরাধীরা দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাদের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায় না।
বিষয়টি নিয়ে বিস্তর তদন্ত করছে ডিবির সাইবার ক্রাইম বিভাগ। তাদের তদন্ত অনুযায়ী, মূলত এ অ্যাপগুলো চীনা নাগরিকদের তৈরি। অ্যাপ বা টাকা আয়ের বিষয়ে কোনো গ্রাহক যদি কোনো সমস্যায় পড়েন, তাদের কল সেন্টার অপারেটরের মাধ্যমে সহায়তা করা হয়। অধিকাংশ সময় কল সেন্টারের সদস্যরা মোবাইলে মেসেজ দেওয়ার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করেন। মোটা অঙ্কের বিনিয়োগকারী হলে তারা পাকিস্তানের +৯২... নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কল দিতেন। এখন পর্যন্ত যেসব ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা সবাই জানান যে, কল সেন্টারের এজেন্টরা মেয়ে। তারা ফোনে ইংরেজিতে কথা বলেন। তাদের হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইলেও মেয়ের ছবি দেওয়া। তাদের নাম সার্চ দিয়ে ফেসবুকে রিকোয়েস্ট এবং তাদের ফ্রেন্ড হিসেবে অ্যাডও করেছেন অনেকে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে ‘ঘরে বসে আয়’ শীর্ষক প্রতারণার সঙ্গে জড়িত ঝ্যাং জি ঝাহ্যাং নামের এক চীনা নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছিল ডিবি। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। তার ও তার চক্রের কাছ থেকে জব্দ করা মোবাইলের বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টে ৫০ কোটি টাকার লেনদেন এবং বিদেশে টাকা পাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এর চেয়ে বেশি তথ্য তার কাছ থেকে পায়নি ডিবি।
এ ছাড়া কানাডায় একই ধরনের প্রতারণার অভিযোগে চীনা ব্যবসায়ীদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। নিজেদের ওয়েবসাইটে কানাডার অ্যালবার্টা প্রদেশের এডমন্টন পুলিশ তাদের নাগরিকদের অনলাইন জব স্ক্যামের বিষয়ে একটি বার্তা দেয়। এতে সবাইকে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি জানানো হয় যে, ২০২২ সালে এডমন্টন শহরের মোট ১৪৮ জন এ অনলাইন জব প্রতারণার শিকার হয়ে পুলিশে অভিযোগ দিয়েছেন। তারা সবাই মিলে প্রায় তিন লাখ ৫৯ হাজার ৮৩১ কানাডিয়ান ডলার খুইয়েছেন।
সিটিটিসির সাইবার অপরাধ বিভাগের ইন্টারনেট রেফারেল টিমের প্রধান সহকারী পুলিশ কমিশনার ইমরানুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ ধরনের প্রতারণায় টাকা হারিয়ে অনেকে পুলিশের কাছে আসছেন। আমরা চক্রের বাংলাদেশি সদস্য এমএফএস এজেন্ট ও ফ্রিল্যান্সারদের চিহ্নিত করেছি। কিছু টাকার লোভে তারা এ চক্রের সঙ্গে কাজ করছে। তারাই বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করে যাচ্ছি। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।
‘প্রতারণার এ কৌশল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। মূলহোতা বিদেশিদের চিহ্নিত করার চেষ্টা অব্যাহত আছে, যদিও কাজটি অত্যন্ত জটিল। আমরা প্রতারণার টাকা সংগ্রহকারী অভিযুক্ত এমএফএস অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধ করতে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। এ ছাড়া আমরা সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। এমন প্রতারণা বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।’
চলবে...
এআর/এমএআর/