ফলাফল বিশ্লেষণ
এসএসসিতে জিপিএ-৫ কেন কমলো?
এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় পাসের হার বাড়লেও কমেছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। গতবারের তুলনায় এবার পাসের হার বেড়েছে ২.৬৫ শতাংশ। তবে, জিপিএ-৫ কমেছে ১৪৪৯টি।
এবারের ফলাফলে অন্যান্য সূচক ইতিবাচক হলেও জিপিএ-৫ কম হওয়ার বিষয়টিকে নেতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কী কী কারণে জিপিএ-৫ কমলো তা খতিয়ে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞাপন
ফলাফলকে সার্বিকভাবে ইতিবাচক বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তবে, জিপিএ-৫ কমার বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন তারা।
জিপিএ-৫ কমার জন্য প্রাথমিকভাবে তিনটি বড় কারণ চিহ্নিত করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এর মধ্যে অন্যতম হলো, পাঁচটি শিক্ষা বোর্ডে গড়ে গণিতের ফল খারাপ হওয়া। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে সিলেট ও কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের সার্বিক ফল খারাপ হওয়াকে। তিন নম্বরে রয়েছে করোনার প্রভাব এবং অনলাইনে ক্লাস করার বিষয়টি। এবারের এসএসসি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২০২২ সালে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। তার আগে প্রায় দুই বছর ঘরে বসে অনলাইনে ক্লাস করেছে তারা।
আরও পড়ুন
এর বাইরেও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বোর্ড সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জিপিএ-৫ কমার সবচেয়ে বড় কারণ সব শিক্ষা বোর্ডে গণিতে খারাপ ফল আসা। পাঁচটি শিক্ষা বোর্ড গণিতে গড়ে পাসের হার ৯০ শতাংশের নিচে। এজন্য জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। তাছাড়া, কিছু বোর্ডে বাংলা ও ইংরেজিতেও ফল খারাপ হয়েছে। সার্বিক ফলের ওপর যার প্রভাব পড়েছে।
বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার পর ২০২৩ সাল থেকে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে ফিরেছে এসএসসি পরীক্ষা। গত বছর ও এবারের ফল তারও আগের দুই শিক্ষাবর্ষের (২০২১ ও ২০২২) ফলের চেয়ে বিশেষ। কারণ, ওই দুই বছর বিশেষ ব্যবস্থায় সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা হওয়ায় ফল স্বাভাবিক হয়েছে।
গণিতে খারাপ ফল
বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সব বিভাগের কমন আটটি বিষয়— বাংলা, ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন, তথ্য ও প্রযুক্তি, পৌরনীতি ও হিসাব বিজ্ঞানে গড় পাসের হার ৯৬ শতাংশের বেশি। বিপরীতে সাধারণ ১০টি শিক্ষা বোর্ডে (কারিগরি বাদে) গণিতে গড়ে পাস করেছে ৯১.১৮ শতাংশ। এটা সার্বিক ফল খারাপ হওয়ার একটি কারণ। কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা গণিতে সবচয়ে খারাপ করেছে। এই বোর্ডে পাস করেছে মাত্র ৮৭.৯৬ শতাংশ।
এছাড়া, সিলেট শিক্ষা বোর্ডে পদার্থ বিজ্ঞান ও আইসিটিতে যথাক্রমে ৯৩.৬১ শতাংশ ও ৯২.৯২ শতাংশ পাস করেছে।
জানতে চাইলে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. রমা বিজয় সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বোর্ডে গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষার্থীরা খারাপ ফল করার কারণে গড় পাসের হার কমেছে। এছাড়া, মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করেছে। যার প্রভাব সার্বিক ফলাফলে পড়েছে।
সিলেট ও কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে খারাপ ফল
ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এবার সিলেট শিক্ষা বোর্ডের ফল অস্বাভাবিক খারাপ হয়েছে। এই শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ৭৩.৩৫ শতাংশ। এই শিক্ষা বোর্ডে খারাপ ফলের কারণে সার্বিক ফল নেতিবাচক দেখাচ্ছে। বোর্ডে সবচেয়ে খারাপ ফল হয়েছে তথ্য ও প্রযুক্তিতে। এ বিষয়ে পাস করেছে ৯২.৯২ শতাংশ। এরপর গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানে। এই দুই বিষয়ে পাসের হার ৯৩.৬১ শতাংশ।
পাসের হারে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড। এ বোর্ডে গড় পাসের হার ৭৯.২৩ শতাংশ। এখানে পাসের হার কমার অন্যতম কারণ গণিতে অস্বাভাবিক খারাপ ফল। এ বোর্ডে গণিতে পাস করেছে ৮৭.৯৬ শতাংশ। এটি সব শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল।
জানতে চাইলে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. নিজামুল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গণিতে প্রশ্ন তুলনামূলক কঠিন হওয়ায় স্মরণকালের মধ্যে খারাপ ফল করেছে কুমিল্লা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা। এজন্য এ বোর্ডের মোট জিপিএ-৫ কমেছে। গণিতে এত খারাপ হওয়ার কারণ কী তা উদঘাটন করতে হবে।
করোনার সময়ের প্রভাব এখন পড়েছে
গত ৫ বছরের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালে গড় পাসের হার ছিল ৮২.৮৭ শতাংশ। ২০২০ সালের ব্যাচটি করোনা শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষা শেষ করেছিল। ফলে তাদের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব পড়েনি। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে পাসের হার ছিল ৯৩.৫৮ শতাংশ। সেই বছর সংক্ষিপ্ত সিলেবাস ও সংক্ষিপ্ত নম্বরে পরীক্ষা হয়। ২০২২ সালে পাসের হার ছিল ৮৭.৪৪ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ছিল ৮০.৩৯ শতাংশ। এবার পাসের হার ৮৩.০৪ শতাংশ। এ চিত্র বলছে, করোনার আগে আর পরের বছরগুলোর ফল কাছাকাছি।
আরও পড়ুন
জিপিএ-৫ কম হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, এবার ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গণিত বিষয়ের পরীক্ষা কঠিন হয়েছে। এজন্য আমার স্কুলের সার্বিক পাস ও জিপিএ-৫ কমেছে। এছাড়া, এবার যারা পাস করেছে তারা যখন করোনার সময়ে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে পড়ত, তখন অনলাইনে ক্লাসের কারণে অনেকের ভিত্তি একটু দুর্বল ছিল।
সার্বিক ফলাফলে খুশি শিক্ষামন্ত্রী
অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর মতে, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবারের এসএসসির ফল ভালো হয়েছে। ফলের সার্বিক দিকে বিশ্লেষণ করলে ভালো দিক বেশি। সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নানা পদক্ষেপের কারণে এমন ফল অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
ফলাফল প্রকাশের পর মন্ত্রী বলেন, করোনার আগের বছর ২০১৯ বা তার আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ওই সময় পাসের হার সাধারণত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের ঘরে থাকত। মাঝে ২০২১ ও ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার বেড়ে ৯০ শতাংশের বেশি হয়। এর কারণ ছিল সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া। গত বছরের মতো এবার পূর্ণ সিলেবাস ও পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা হয়েছে। তাই এ বছর আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষায় ফেরায় ফল ৮০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে। এটাকে স্বাভাবিক ফল বলা যায়। এবার, জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে, তবে এটাকে খারাপ ফল বলা যাবে না।
প্রসঙ্গত, এবার ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৮৯.৩২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৮৯.২৫ শতাংশ, যশোরে ৯২.৩২ শতাংশ, কুমিল্লায় ৭৯.২৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮২.৮০ শতাংশ, বরিশালে ৮৯.১৩ শতাংশ, দিনাজপুরে ৭৮.৪০ শতাংশ, সিলেটে ৭৩.৩৫ শতাংশ ও ময়মনসিংহে ৮৪.৯৭ শতাংশ। এ থেকে দেখা যায়, যশোর বোর্ডে পাসের হার এ বছর সবচেয়ে বেশি। আর সর্বনিম্ন পাসের হার সিলেট বোর্ডে।
এনএন/কেএ