◑ একেক সময় একেক রকম সিদ্ধান্ত ক্ষমতাসীনদের
◑ কী করবে— বুঝতে পারছে না তৃণমূল আওয়ামী লীগ

আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় প্রতীক ব্যবহার করছে না। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো—  কোনো এমপি বা মন্ত্রীর সন্তান এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। অন্যদিকে, নেতারা নির্বাচনে অংশ নিলে বহিষ্কার করছে বিএনপি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, কোনো দল কোনো ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না?

উপজেলা নির্বাচনকেন্দ্রিক ক্ষমতাসীন দলের এমন নির্দেশনায় মন্ত্রী ও এমপিরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নির্বাচন করা থেকে নিরুৎসাহিত করছেন। এতে নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে, ক্ষমতাসীনরা বিষয়টি ‘দলীয় কৌশল’ বলে মনে করছেন।

দল হিসেবে কাউকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা যায় কি না— ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোনটা করলে প্রশংসা করবেন? আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন, সবসময় একটা উলটা প্রশ্ন করতে অভ্যস্ত। আমাদের কৌশল নিয়ে আপনার কথা বলার দরকার নেই।’

জানা যায়, দলীয়প্রধানের নির্দেশনা পেয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ১৮ এপ্রিল ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনানুষ্ঠানিক এক বৈঠক করেন। বৈঠকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সন্তান, পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয় ও নিজস্ব লোক উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে জানানো হয়। এমনকি তারা কারও পক্ষে কাজও করতে পারবেন না বলে সাংগঠনিক সম্পাদককে নির্দেশনা দেওয়া হয়। দলের সাধারণ সম্পাদকের এই নির্দেশনা সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলকে জানিয়ে দেওয়া হয়। মন্ত্রী-এমপিরাও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নির্বাচন করার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেন। তবে, ঢাকা পোস্টের পর্যবেক্ষণ বলছে, মাত্র তিনজন ছাড়া কেউই কেন্দ্রের নির্দেশনাকে গুরুত্ব দেননি।

দলের সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিয়ে নাটোরের সিংড়ায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলকের শ্যালক লুৎফুল হাবীব ভোট থেকে সরে দাঁড়ান। এ ছাড়া চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজগারের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে সহিদুল ইসলাম এবং নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী আয়েশা ফেরদৌস নির্বাচন থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করেন।

কোনো এমপি বা মন্ত্রীর সন্তান এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। উপজেলা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের এমন নির্দেশনায় মন্ত্রী ও এমপিরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নির্বাচন করা থেকে নিরুৎসাহিত করছেন। এতে নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে, ক্ষমতাসীনরা বিষয়টি ‘দলীয় কৌশল’ বলে মনে করছেন

মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর এমন নির্দেশনা ব্যক্তির গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ কি না এবং দল এমন নির্দেশনা দিতে পারে কি না— এমন প্রশ্ন রাখা হয় সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দল যেটি করছে সেটি হচ্ছে লোক দেখানো। এটি করে লাভ হয় না। এটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে। অনেকটা ক্রসফায়ারের মতো।

‘ক্রসফায়ার দিয়ে অনেক সন্ত্রাসীকে আপনি মেরে ফেলতে পারেন। অনেক বাহবা কুড়াতে পারেন। এর পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে, সেটিও আমাদের দেখতে হবে। এমন ভাবে চাপ প্রয়োগ করলে ভবিষ্যৎ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এর প্রভাব পড়বেই’— বলেন এই সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা।

দলীয় সূত্র মতে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে। সব কৌশলই নির্বাচনকেন্দ্রিক, হয় অংশগ্রহণমূলক, না হয় ভোটার টানার কৌশল। তবে, বিভিন্ন সময় নেওয়া এমন কৌশলে বেকায়দায় পড়তে হয় তৃণমূল আওয়ামী লীগকে। কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্বও তৈরি হয়। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করলেও এমপি-মন্ত্রীদের নিকটাত্মীয়রা কেন্দ্রের নির্দেশনা উপেক্ষা করেছেন। তাদের সংখ্যাই বেশি।

উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান এমপি। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ‘এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক মনে করি না।’

শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান ও চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান শফিক খান মাদারীপুর সদর উপজেলায় চেয়ারম্যানপ্রার্থী হয়েছেন। আসিবুর রহমান খান আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। পাভেলুর রহমান শফিক খান সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। তাদের প্রার্থিতা নিয়ে দলের ভেতরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে শাজাহান খানের ছেলের প্রার্থিতা নিয়ে অল্পবিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে শাজাহান খানে কথা কাটাকাটিও হয়েছে বলে জানা যায়। প্রকাশ্যে শাজাহান খান দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বললেও অনেক তৃণমূল নেতা কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেননি।

তৃণমূল আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের নেত্রীও চান রাজনীতিবিদদের সন্তানরা রাজনীতি করুক। তিনি নিজেও উৎসাহ দিয়েছেন। ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে তৈরি করতে বলেছেন। তিনি রাজনীতিবিদদের সন্তানদের জনগণের কাছে যেতে বলেন। কেউ বাবার পরিচয়ে রাজনীতি করতে পারে, কিন্তু দিনশেষে তাকে মাঠে-ময়দানে যেতে হয়, কাজ করতে হয়। রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে হয়। তবে, ব্যতিক্রমও আছে।

‘আমার কথা হচ্ছে, নির্বাচন তো সবার জন্য উন্মুক্ত। সবাই এতে অংশ নেবে। যার যোগ্যতা আছে তিনি বিজয়ী হবেন। জনগণই সেই সিদ্ধান্ত নেবে’— বলেন তৃণমূলের এই নেতা।

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)– এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কাউকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা নির্বাচনী অপরাধের মধ্যে পড়ে। উপজেলা নির্বাচনের নামে আইন ভঙ্গের একটা মহোৎসব চলছে। এটা আমাদের কাঙ্ক্ষিত নয় যে পরিবারতন্ত্র হবে, আমাদের এমপিরা-মন্ত্রীরা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। এটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এটা আইনসম্মতও নয়।’

এমপি শাজাহান খানের ছেলের প্রার্থিতা নিয়ে অল্পবিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে শাজাহান খানে কথা কাটাকাটিও হয়েছে বলে জানা যায়। প্রকাশ্যে শাজাহান খান দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বললেও অনেক তৃণমূল নেতা কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেননি

‘উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ার কথা। কিন্তু এটা হচ্ছে না। সবকিছুতেই আইন ভঙ্গ হচ্ছে। মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়দের নির্বাচন করতে না দেওয়ার বড় কারণ হলো— নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক করা এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। এখন যে ব্যবস্থা, এটা তো রোগের উপসর্গ। রোগটা হলো— কেন মানুষ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে? কারণ, এখানে মধু আছে। এসব পদ-পদবি পেলে অনেক রকম সুযোগ-সুবিধা মেলে। অর্থবিত্তের মালিক হওয়া যায়। অন্যায় করে পার পাওয়া যায়। ফায়দাভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করলেই এসব পদ-পদবি পাওয়ার আকর্ষণ কমে যাবে। আমরা রোগের পরিবর্তে রোগের উপসর্গ নিয়ে কাজ করছি। আইনকানুন, বিধিবিধান সবকিছু উপেক্ষা করছি।’

এমএসআই/এমএআর