বিষাদের বছর শেষে নতুন প্রত্যাশা মালয়েশিয়া প্রবাসীদের
বিষাদেই কেটে গেলো পুরো একটি বছর। করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে বিশ্বজুড়ে চলছে প্রাণপণ চেষ্টা। এরই মধ্যে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন প্রবাসীরা। আর জীবন সংগ্রামের চ্যালেঞ্জ নিয়েই নতুন বছরের যাত্রা শুরু হলো মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি রেমিটেন্স যোদ্ধাদের।
জীবিকার তাগিদে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ প্রবাসে বাস করেন। দেশের নানান উন্নয়নে ভূমিকা রাখে তাদের উপার্জিত অর্থ। করোনার সময়েও রেমিটেন্সের চাকা সচল রেখেছেন এসব প্রবাসীরা, গড়েছেন রেকর্ডও। এত ত্যাগের পরেও কর্মী ছাঁটাই, মালিকের নির্যাতনসহ নানা অনিশ্চয়তার মধ্যেই তাদের দিন কাটে।
বিজ্ঞাপন
এবার সরকারের প্রচেষ্টায় অন্য সময়গুলোর চেয়ে মহামারিতে অনেকটা সুফল ভোগ করেছেন মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসীরা। যার উদাহরণে বলা যায় মালিক পরিবর্তন করার সুযোগ। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রবাসীদের এ সুযোগ করে দিয়েছেন, সফলও হয়েছে। সংক্রমণের মধ্যে কর্মীদের যাতে ছাঁটাই না করা হয় সেজন্য কয়েক হাজার কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে দূতাবাস। যার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে করোনার মাঝে দেশে ফেরত হলেও, মালয়েশিয়া থেকে একজনকেও কাজ হারিয়ে দেশে যেতে হয়নি। এছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ছুটিতে এসে আটকে পড়া প্রবাসীদের মালয়েশিয়া প্রবেশ নিশ্চিত করেছে হাইকমিশন। পাশাপাশি নতুন বছরে নতুন কর্মী নিয়োগের দ্বার উন্মুক্ত হবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০১৯ এ মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি আলোচনার বিষয় ছিলো সেখানে বসবাসরত অবৈধ বিদেশি কর্মীদের বৈধকরণ প্রক্রিয়া। শেষমেশ শর্তসাপেক্ষে ১৬ নভেম্বর থেকে শুরু হয়েছে অবৈধদের বৈধকরণ। রি-ক্যালিব্রেশন নামের এই প্রক্রিয়ায় শ্রমিক বৈধকরণ নিবন্ধনে সরকার আগের মতো কোনো ভেন্ডর বা এজেন্ট নিয়োগ করেনি। সরাসরি দেশটির শ্রম ও মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। যদি কোনো তৃতীয় পক্ষ, এজেন্ট বা দালাল শ্রমিকদের সঙ্গে কোনোরকম প্রতারণা বা জালিয়াতি করে তাহলে তাকে দেশের প্রচলিত আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন দেশটির মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয় বলেছে, শ্রমিক নিয়োগে কোনো ধরনের প্রতারণা বা জালিয়াতি করা হলে দেশটির বেসরকারি কর্মসংস্থান সংস্থা জাতীয় সংবিধান ১৯৮১ সালের ২৪৬ এর ৭ ধারায় প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড ও ২ লাখ রিঙ্গিত যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। সরকার এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হবে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অবৈধ অভিবাসী কর্মী রি-হায়ারিং (পুনঃনিয়োগ) প্রকল্প পরিচালিত হয়েছিল। ওই প্রকল্পে দালাল ও এজেন্টদের কাছে টাকা ও পাসপোর্ট দিয়ে বিভিন্ন দেশের লাখ লাখ অভিবাসী কর্মী প্রতারণা ও জালিয়াতির শিকার হয়েছিলেন। এই প্রতারণার বিষয়টি দেশটির সরকার ও দূতাবাসে অবহিত করা হলেও সংশ্লিষ্ট প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ প্রতারক চক্র অভিবাসী কর্মীদের কাছ থেকে টাকা ও পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয়ার সময় কোনো মানি-রিসিট বা ডকুমেন্টস দেয়নি।
প্রবাসীদের অভিযোগ, গত বছর দালাল ও এজেন্টের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে বৈধতার সুযোগ হারিয়েছেন, খোয়া গেছে পাসপোর্টও। যেহেতু এ বছর ভেন্ডর বা এজেন্ট নিয়োগ না দিয়ে মালিকের মাধ্যমে বৈধতার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাই প্রতারণাও হবে না বলে আশা করছেন তারা। তবে সময়মতো পাসপোর্ট হাতে না পেলে এবারও বৈধতার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেক প্রবাসী।
পাসপোর্ট নিয়ে প্রবাসীদের সংশয় কাটাতে এবং কর্মক্ষেত্রে যেন সঠিক সময়ে ভিসা রিনিউ করতে পারেন সে লক্ষ্যে সব নীতিমালা অনুসরণ করে ছুটির দিনসহ দূতাবাস কর্মীরা দিন-রাত কাজ করে করোনার মধ্যেও প্রায় এক লাখ পাসপোর্ট বিতরণ করেছেন।
সূত্র জানায়, সিএমসিও এবং এসওপি নির্দেশনা মেনে প্রতিদিন ১৩শ পাসপোর্ট বিতরণ করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে গ্রহণ করা হচ্ছে ১৫শ নতুন পাসপোর্টের আবেদন। এছাড়া পাসপোর্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও অন্যান্য সেবা নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে।
বৈধ হতে নতুন পাসপোর্টের আবেদন বৃদ্ধি পেয়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। প্রবাসীদের হাতে দ্রুত পাসপোর্ট পৌঁছে দিতে পাসপোর্ট কার্যক্রম সময়োপযোগী করতে অ্যানালগ থেকে অনলাইনের মাধ্যমে ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। মালয়েশিয়ার সরকার স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম-এসওপি ঘোষণার মাধ্যমে অধিক গণজমায়েতকে নিষিদ্ধ করেছে। তবুও প্রবাসীদের পাসপোর্টের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনা মহামারিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দূতাবাসের কর্মীরা পাসপোর্ট বিতরণ করে যাচ্ছেন।
বিদেশি দূতাবাসগুলো মধ্যে একমাত্র মালয়েশিয়ায় ডাকযোগে পাসপোর্টের আবেদন গ্রহণ চালু রেখেছে বাংলাদেশ হাইকমিশন। পাসপোর্ট বিতরণে অনলাইন বুকিং সিস্টেমসহ পাসপোর্ট সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা সমাধানের বিষয়টি সহজ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে পাসপোর্ট অ্যান্ড ভিসা শাখার প্রধান মো. মশিউর রহমান তালুকদার জানান, মালয়েশিয়া সরকার টানা লকডাউন ঘোষণার পাশাপাশি কন্ডিশনাল মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার (সিএমসিও), স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেম (এসওপি) জারি রেখেছে। এসব সরকারি বিধিমালা অনুসরণ করে পাসপোর্ট সার্ভিস স্বাভাবিক রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জ।
তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের কর্মক্ষেত্র স্বাভাবিক ও নিবিড় করতে পাসপোর্ট সংক্রান্ত সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে এবং দ্রুত পাসপোর্ট বিতরণে দূতাবাস আন্তরিকভাবে কাজ করছে।’
মালয়েশিয়ায় নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মো. গোলাম সারওয়ার বলেছেন, ‘পাসপোর্ট দ্রুত ডেলিভারি দিতে ইতোমধ্যে হাইকমিশনে ছয় জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং আরো লোকবল নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মালয়েশিয়া পোস্ট অফিসের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে, যাতে করে দূরে কর্মরত কর্মীদের কাছে সহজে পাসপোর্ট পৌঁছে দেয়া যায়।’
বৈধকরণ নিয়ে রাষ্ট্রদূত জানান, রিক্যালিব্রেশন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ নিয়োগদাতা বা মালিক নির্ভর। না জেনে না বুঝে কারো সঙ্গে আর্থিক লেনদেন না করার পরামর্শ দেন তিনি। এ ছাড়া নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে মালয়েশিয়ার আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহবান জানান হাইকমিশনার মো: গোলাম সারওয়ার।
এ ছাড়া নতুন বছরের শুরুতে নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরে ‘গোপন’ ফোন অ্যাপ চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বহু-ভাষিক অ্যাপটি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি কর্মীদের অধিকার লঙ্ঘনকারী অসাধু নিয়োগকারীদের, বিশেষত কোভিড-১৯ পদ্ধতি লঙ্ঘনকারীদের নজরে রাখতে সক্ষম হবে বলে জানিয়েছেন মানবসম্পদ মন্ত্রী দাতুক সেরি এম সারাভানান।
এদিকে, বিদেশি কর্মীর ভিসার মেয়াদ শেষে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার সময় সঞ্চিত বেতনের অংশ ফেরত দিবে কোম্পানি। ফলে মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও কমে আসবে প্রবাসীদের।
শ্রমিকদের অর্থ সঞ্চয়, পালিয়ে যাওয়া থেকে সুরক্ষা, স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক বিনিময় হ্রাসের মতো কিছু ইতিবাচক ফলাফল হতে পারে। তবে আরও কিছু দিক বিবেচনা করা উচিত।
এফএমএম-এর সভাপতি দাতুক সোহা থিয়ান লাই
এক গবেষণায় দেখা যায়, অন্যান্য দেশের শ্রমিকের তুলনায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের পারিশ্রমিক খুবই কম। কিন্তু বাংলাদেশি শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় সবচেয়ে বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা বিভিন্নভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। যেমন, অল্প পারিশ্রমিক, কারণ ছাড়া নোটিশে চাকরি থেকে প্রত্যাহার, সময়মতো বেতন না দেওয়া, পরিমিত খাবার না দেওয়া, স্বল্পস্থানে অনেক শ্রমিকের আবাস ও জোরপূর্বক চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া। বর্তমানে অভিবাসী শ্রমিকদের কম বেতন একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ।
এ অবস্থায় অভিবাসন খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধিকরণে শ্রমিকের স্বার্থ ও অধিকারে সরকার, নিয়োগকর্তা, হাইকমিশন, এনজিও ও অভিবাসন শ্রমিকের মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন অভিবাসীরা।
মালয়েশিয়া প্রবাসী আজিজ উদ্দিন বলেন, একজন অভিবাসী ইচ্ছে করে অবৈধ হয় না। দালারচক্র ইচ্ছে করে তাকে অবৈধ করে। বৈধ করে দেওয়ার নামে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও আট থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। তখন এই শ্রমিকের আর কিছু করার থাকে না।
জানা গেছে, বৈধ হতে প্রায় ৩৫.৪ শতাংশ শ্রমিক পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ঋণ নেয়, ১৮.৭ শতাংশ টাকা ধারক থেকে ঋণ নেয়, স্থানীয় ব্যাংক থেকে ৭.২ শতাংশ, ভূমি বন্ধক রেখে ২.৬ শতাংশ এবং বিদেশি ব্যাংক থেকে ০.৩ শতাংশ ঋণ নেয়।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদেশি অভিবাসীদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ৯.৬০ শতাংশ, অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের মধ্যে ২৮.০৮ শতাংশ এবং অ-অভিবাসীদের জন্য এটি ১৭.৫২ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে, ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের মধ্যে ১২.৬৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু বিদেশি অভিবাসীদের ক্ষেত্রে এটি ৭.১১ শতাংশ কমিয়েছে।
বর্তমানে বিদেশি অভিবাসীদের গড় মাসিক আয় ৩২ হাজার ৮১৫ টাকা, যখন গড় মাইগ্রেশন খরচ প্রায় দুই লাখ ৭৬ হাজার টাকা। পুরুষ অভিবাসীদের গড় খরচ তিন লাখ ৪২ হাজার টাকা, মহিলা অভিবাসীদের জন্য এর গড় ৮৮ হাজার ৮৭৭ টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন মাইগ্রেশন, ঋণ এবং সুদের খরচ, এই দৃশ্যকল্পের জন্য দায়ী।
ইউপিএম ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক মো. আব্দুর রউফ বলেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে মাইগ্রেশন খরচ বিশ্বের সর্বোচ্চ এবং বেতন পরিসীমা সর্বনিম্ন। অভিবাসন খরচ কমাতে পদক্ষেপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত তাদের পরিবারের সুবিধা হবে না। বাংলাদেশি অভিবাসীরা খুব কম টাকা উপার্জন করে এবং তাদের বেশিরভাগ উপার্জনই পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় করতে হয়। দেশের অর্থনীতি তারা ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। তাই তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখভালের দায়িত্ব সরকারের ওপরই বর্তায়।
২০২১ সাল বৈধ কর্মীদের জন্য হতে পারে অপার সম্ভাবনাময় একটি বছর। ২০২০ সালকে নিয়ে করা হিসাবের যোগ-বিয়োগের বাস্তব ফল যাই হোক, এটি সত্য অবৈধদের জন্য মালয়েশিয়ায় বসবাসের সুযোগ দিনে দিনে কেবল সংকোচিত হবে।
এমএইচএস