মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া
কাজে আসছে না বিটিআরসির কলা-কৌশল
নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব, বলছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসচেতনতার বিকল্প নেই 

মাত্র ২০ টাকা বিনিয়োগ করে হয়েছিলেন লাখপতি। পরে সেই নেশায় পড়ে একের পর এক বিনিয়োগ করেছেন। তবে, লাভের মুখ আর দেখা হয়নি। উল্টো লোকসান হয়েছে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। অনলাইনে জুয়া খেলার নেশায় পড়ে সব হারানো এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের জীবনের গল্প এটি।

শুধু তিনি নন, জুয়ার নেশায় পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। রাজধানী ঢাকার ওই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দেশের নামকরা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ করি। এরপর উচ্চ বেতনে বিদেশি একটি প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে কাজ শুরু করি। হঠাৎ এক বন্ধুর মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়টি সামনে আসে। কৌতূহলবশত আমিও পরীক্ষামূলকভাবে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করি। পরে মাত্র ২০ টাকা দিয়ে খেলতে নেমে একবারে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পাই।

অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির নেতিবাচক সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনলাইনে গড়ে তোলা হয়েছে অপরাধের বিরাট এ সাম্রাজ্য। পদে পদে দেওয়া হচ্ছে লোভনীয় অফার। যেগুলো মূলত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ। সেই ফাঁদে পা দিয়ে শুধু অর্থ নয়, নৈতিক স্খলনও ঘটছে অনেকের। বারংবার কঠোরতা দেখিয়েও নানা ফাঁকফোকর আর কতিপয় অসাধু ব্যক্তিদের তৎপরতায় শেষপর্যন্ত নীরব পরাজয়ের স্বীকার হতে হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন গ্যাম্বলিং (জুয়া), বেটিং (বাজি) আর ক্যাসিনো

“পুরো বিষয়টি আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। ধীরে ধীরে সেখানে আরও টাকা ইনভেস্ট করি। একপর্যায়ে মারাত্মকভাবে আসক্ত হয়ে পড়ি। জুয়ার অধিকাংশ খেলা হতো রাতে। ফলে আমি আমার অফিসের কার্যক্রমে পিছিয়ে পড়ি। একটা সময় আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরে যাই। একইসঙ্গে অর্থকড়িও লস হতে থাকে। চাকরি চলে যায়। সবমিলিয়ে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা লস করি। কিন্তু এ আসক্তি থেকে কোনোভাবেই বের হতে পারছিলাম না। পরে পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় অনেক কষ্টে বের হয়ে আসতে পারি। তবে, ওই লস এখনও আমাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।”

পরে তিনি ঢাকা পোস্টকে যে তথ্য দেন, তা আসলেই ভয়ংকর। বলেন, “অনলাইন জুয়া দেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, তরুণ-তরুণীসহ অসংখ্য মানুষ এর পেছনে সময় দিচ্ছেন, বিপুল অর্থ ব্যয় করছেন। একপর্যায়ে তারা আমার মতো নিঃস্ব হচ্ছেন। দিনদিন জুয়াড়িদের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।”

কেন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়া— সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির নেতিবাচক সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনলাইনে গড়ে তোলা হয়েছে অপরাধের বিরাট এ সাম্রাজ্য। পদে পদে দেওয়া হচ্ছে লোভনীয় অফার। যেগুলো মূলত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ। সেই ফাঁদে পা দিয়ে শুধু অর্থ নয়, নৈতিক স্খলনও ঘটছে অনেকের। বারংবার কঠোরতা দেখিয়েও নানা ফাঁকফোকর আর কতিপয় অসাধু ব্যক্তিদের তৎপরতায় শেষপর্যন্ত নীরব পরাজয়ের স্বীকার হতে হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন গ্যাম্বলিং (জুয়া), বেটিং (বাজি) আর ক্যাসিনো।

মহামারির মতো দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন জুয়া— বলছেন সংশ্লিষ্টরা / প্রতীকী ছবি

জানা যায়, ভয়াল এ থাবা থেকে দেশের তরুণ প্রজন্মসহ সব-বয়সীদের রক্ষা করতে বারবার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টরা। তবে, শেষ পর্যন্ত সফলতার মুখ দেখা যায়নি। বন্ধ করে দেওয়ার পরও কোনো না কোনোভাবে ফের বিভিন্ন জুয়া ও বাজির অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম উন্মুক্ত হচ্ছে অনলাইনে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে বেশ সতর্ক এসব কার্যক্রমের মূলহোতারা। এখন আর আগের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে এসব ছড়ানো হচ্ছে না। মূলহোতারা থাকছেন আড়ালে-আবডালে। বিদেশে থেকে খুব স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে পরিচালনা করছেন তাদের কার্যক্রম। অন্যদিকে, দেশে থাকা তাদের এজেন্টরা সুকৌশলে করছেন সহযোগিতা। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকার মালিক হচ্ছেন তারা (দেশীয় এজেন্ট)। এ টাকার প্রায় শতভাগ লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোভনীয় অফারের নানা ভিডিও এবং বুস্ট করা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অধিকাংশ জুয়া বা বেটিং সাইটগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এসব সাইটে বুঝে না বুঝে একটি মাত্র ক্লিকে অ্যাপস কিংবা ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে শুরুতে সদস্য টানতে অবলম্বন করা হচ্ছে কৌশল। অল্প টাকায় লাখপতি হওয়া বা দ্বিগুণ মুনাফার লোভে অন্ধকার এ জগতে পা বাড়াচ্ছে মানুষ। একসময় লোভে পড়ে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করেন তারা। তখনই বেরিয়ে আসে আসল রূপ। মোটা অঙ্কের টাকা মুহূর্তেই হারিয়ে যায় জুয়ার বোর্ডে। লোভ আর নেশায় বুঁদ হওয়ার পরপরই হঠাৎ লাপাত্তা হয়ে যায় এসব নামসর্বস্ব ওয়েবসাইট। শুরু হয় আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে সামনে এসেছে এমন কিছু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশার চিত্র।

দেশে সহজেই মিলছে ক্যাসিনো ও বেটিং ওয়েবসাইট

বেটিং, ক্যাসিনো বা জুয়া দেশে নিষিদ্ধ হলেও খুব সহজেই এক্স বেট, জেটউইন বাংলাদেশ, মাইজেট, ক্রিকেক্স, বাজি ৩৬৫ ক্যাসিনোসহ (অন্যান্য বেটিং ও ক্যাসিনো ওয়েবসাইটের নাম ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করা হলো) অনেক বেটিং ও ক্যাসিনোর ওয়েবসাইটে খুব সহজেই যুক্ত হওয়া যাচ্ছে। এসব সাইটে টাকা ডিপোজিট করে স্লটস, ই-গেমস, টেবিল গেম, কার্ড গেম, ভিডিও পোকার ও লাইভ ক্যাসিনোতে অংশ নেওয়া যাচ্ছে।

জেটউইনের বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ন্যূনতম ২০০ টাকা ডিপোজিট করে এ কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। টাকা লেনদেন করা যায় বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। শুধু ওয়েবসাইট নয়, প্লেস্টোরেও রয়েছে এসব অ্যাপ। যারা স্থায়ীভাবে টাকা ডিপোজিট করেন তারা সবসময় অ্যাপসের মাধ্যমেই বেট, ক্যাসিনো কিংবা অন্যান্য কার্যক্রমে অংশ নেন।

শুধু শহর নয়, গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ অনলাইন জুয়ার থাবা। এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে— বলছেন বিশেষজ্ঞরা / ছবি- সংগৃহীত  

যেভাবে জড়িয়ে পড়ছেন তরুণরা

অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেকার, অসচ্ছল, কম শিক্ষিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষ অনলাইনে এসব জুয়া খেলায় আকৃষ্ট হচ্ছেন। মূলত দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে তাদের এ পথে আসা। শহরাঞ্চলের শিক্ষিত ও উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরাও জড়িয়ে পড়ছেন অনলাইন প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে। এসব কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং আর্থিক ক্ষতির পর পুনরায় ফিরে এসেছেন— এমন একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের।

বেটিং, ক্যাসিনো বা জুয়া দেশে নিষিদ্ধ হলেও খুব সহজেই এক্স বেট, জেটউইন বাংলাদেশ, মাইজেট, ক্রিকেক্স, বাজি ৩৬৫ ক্যাসিনোসহ (অন্যান্য বেটিং ও ক্যাসিনো ওয়েবসাইটের নাম ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করা হলো) অনেক বেটিং ও ক্যাসিনোর ওয়েবসাইটে খুব সহজেই যুক্ত হওয়া যাচ্ছে। এসব সাইটে টাকা ডিপোজিট করে স্লটস, ই-গেমস, টেবিল গেম, কার্ড গেম, ভিডিও পোকার ও লাইভ ক্যাসিনোতে অংশ নেওয়া যাচ্ছে

নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, “করোনার সময় বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। ওই সময় এলাকার এক বন্ধুর কাছ থেকে অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়টি প্রথম জানতে পারি। শুরুতে আগ্রহ না থাকলেও পরবর্তী সময়ে লাভের গল্প শুনে ধীরে ধীরে আমিও আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। পরে বাড়ি থেকে অনলাইনে কোচিংয়ের কথা বলে প্রথম পাঁচ হাজার টাকা ইনভেস্ট করি। প্রতিদিন আমি সেখানে পাঁচবার স্পিন ঘুরানোর সুযোগ পেতাম। এর বাইরে অন্যান্য খেলায় অংশ নিতে অতিরিক্ত টাকা দিতে হতো। সব লেনদেনই হতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। লাভ-লস দুটোই হতো। একটা সময় আমি আসক্ত হয়ে পড়ি। হঠাৎ একদিন দেখি ওয়েবসাইটটি নাই। ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ি। অনেক কষ্টে পরে এসব সামাল দিয়েছি। তবে, জুয়ার ওই অভ্যাস থেকে বের হতে পারিনি।”

তিনি আরও বলেন, লোকসান থেকে বের হতে পরে আমার মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বিক্রি করে দিই।

জুয়ার টাকা জোগাড়ে হয়েছে হত্যা, ঘটেছে আত্মহত্যাও

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজবাড়ীর কালুখালীতে বিকাশের এক এজেন্টকে হত্যার ঘটনা ঘটে। জানা যায়, অনলাইনে জুয়া খেলায় হেরে নগদ টাকা পাওয়ার আশায় বিকাশের এজেন্ট শরিফ খাঁনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জড়িত থাকার অভিযোগে মো. তরিকুল ইসলাম (২০) নামের এক অনলাইন জুয়াড়িকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

বিষয়টি নিয়ে পাংশা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার সুমন কুমার সাহা বলেন, গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার সময় স্থানীয় বিকাশ এজেন্ট ও মুদি-দোকানদার শরিফ খাঁনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে জড়িত আসামি মো. তরিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আসামি জানায়, নিহত শরিফ খাঁন ও তিনি (তরিকুল ইসলাম) একই বাজারের দোকানদার। তিনি অনলাইনে জুয়া খেলায় আসক্ত। অনলাইনে জুয়া খেলে বহু টাকা হেরে যাওয়ায় বিকাশের এজেন্ট শরিফ খাঁনকে হত্যা করে নগদ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

ন্যূনতম ২০০ টাকা ডিপোজিট করেই অনলাইন জুয়া খেলায় অংশ নেওয়া যায়। এ কারণে এমন নেশায় আকৃষ্ট হচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা / ফাইল ছবি    

অন্যদিকে, গত বছরের ৩ নভেম্বর আত্মহত্যা করেন ছোট পর্দার অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু। পরে র‌্যাব জানায়, ওই আত্মহত্যার পেছনের কারণ অনলাইন জুয়া। বিগো লাইভ নামক একটি অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলতেন অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু। বিগত তিন বছরে জুয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ খুইয়েছেন তিনি। পরে আর্থিক সংকটে পড়ে যাওয়ায় বন্ধু মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন রুফি ওরফে উরফি জিয়ার কাছ থেকে নানা সময় টাকা নেন হিমু। সর্বশেষ হিমুর বাসায় জিয়াউদ্দিন এলে এসব বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। ওই ঘটনায় হিমুর বন্ধু জিয়াউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত বছরের ৩ নভেম্বর আত্মহত্যা করেন ছোট পর্দার অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু। পরে র‌্যাব জানায়, ওই আত্মহত্যার পেছনের কারণ অনলাইন জুয়া। বিগো লাইভ নামক একটি অ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলতেন অভিনেত্রী হুমায়রা হিমু। বিগত তিন বছরে জুয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ খুইয়েছেন তিনি। পরে আর্থিক সংকটে পড়ে যাওয়ায় বন্ধু মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন রুফি ওরফে উরফি জিয়ার কাছ থেকে নানা সময় টাকা নেন হিমু। সর্বশেষ হিমুর বাসায় জিয়াউদ্দিন এলে এসব বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে আত্মহত্যা করেন তিনি

জুয়ার ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রণ ‘প্রায় অসম্ভব’ : সাইবার পুলিশ

বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে জুয়ার ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রণ করাটা ‘অনেকটা অসম্ভব’ হিসেবে দেখছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপির) সিআইডির সাইবার ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রেজাউল মাসুদ, এ বিষয়গুলো হচ্ছে বাউন্ডারি লেস ক্রাইম। যার নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডি নেই। এক দেশে ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়, আরেক দেশে চালানো হয় আর লেনদেন করা হয় আরেক দেশে। এগুলো সংঘবদ্ধ অপরাধ। সত্যি কথা বলতে, তেমনভাবে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া এসব জুয়াকে কেন্দ্র করে আগে ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়েতে লেনদেন হতো। এখন দেশীয় বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে। এ সংক্রান্ত অ্যাপসের রেজিস্ট্রেশনও খুব সহজ করা হয়েছে। এজন্য অনলাইন জুয়াগুলো একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

“এটি নিয়ন্ত্রণে টাকা-পয়সার লেনদেন কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অপারেটররাই পারবেন এসব কার্যক্রম বন্ধ করতে। তারা যদি নির্দিষ্ট এজেন্ট কিংবা নির্ধারিত নম্বরের লেনদেন তদারকি করেন তাহলে অস্বাভাবিক ক্যাশ-ইন, ক্যাশ-আউট কিংবা টাকা ট্রানজেকশনের বিষয়টি ধরতে পারেন। তারা সচেষ্ট হলে অনলাইন জুয়া ৫০ শতাংশ বন্ধ হয়ে যাবে।”

সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া অনলাইন জুয়া খেলা বন্ধ ‘অনেকটা অসম্ভব’— বলছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা / ফাইল ছবি

কীভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব— এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওয়েবসাইট বা অ্যাপস বন্ধের জন্য মূল ভূমিকা পালন করতে হবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে। পাশাপাশি ইউটিউব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয় সেগুলোও বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অভিযান, মামলা ও রিমান্ডের পরিমাণও বাড়িয়ে দিতে হবে।

যেসব পরামর্শ দিচ্ছে সাইবার পুলিশ

অনলাইনে এসব অপরাধের ভয়াল থাবা থেকে নিজেদের বাঁচাতে এবং অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণে মোটা দাগে চারটি পরামর্শ দিচ্ছেন এ পুলিশ কর্মকর্তা। সেগুলো হলো-

১. মোবাইল ব্যাংকিং সিস্টেমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
২. জুয়ার সাইটগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিটিআরসিকে আরও শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে।
৩. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ধরপাকড়, মামলা, রিমান্ডসহ কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে। 
৪. সামাজিকভাবে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

কাজে আসছে না বিটিআরসির কৌশলও

বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অনলাইন বেটিং ওয়েবসাইট চক্রগুলো অনেকটা চতুরতার সঙ্গে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে। সবসময় ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে তারা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. খলিল-উর-রহমান বলেন, আমরা এসব বিষয়ে প্রতিনিয়ত কার্যকর ভূমিকা পালন করছি। একটি ওয়েবসাইট ব্লক করে দেওয়ার পর তার সঙ্গে সামান্য একটি ডট যুক্ত করে নতুন করে সেটি (ওয়েবসাইট) ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আমরা ২৬ হাজার ওয়েবসাইট ব্লক করেছি। প্রতিদিন আমাদের টিম এসব কার্যক্রম বন্ধে নজরদারি রাখছে। তারপরও তারা নানাভাবে অনলাইন জুয়াকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।

বিটিআরসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা প্রায় ২৬ হাজার ওয়েবসাইট ব্লক করেছে। এরপরও চলছে অনলাইন জুয়ার আসর / ফাইল ছবি

“শুধু আমরাই নয়, দেশের মানুষকেও এগুলো প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। অভিভাবকদেরও সন্তানদের কার্যক্রমের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকলে খুব দ্রুত বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব”— মনে করেন এ কর্মকর্তা।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত ও শক্ত তদারকি না করলে অনলাইনের এসব অপরাধ দমন করা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ, তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ ধারায় অধিকাংশ বেটিং, গ্যাম্বলিং, ক্যাসিনো ওয়েবসাইট ও অ্যাপস নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে। তাই কঠোরতার পাশাপাশি তথ্য-প্রযুক্তির বিভিন্ন খাতে জোরদার করতে হবে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। এছাড়া এসব কার্যক্রমে জড়িত দেশীয়দের মুখোমুখি করতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। তবেই কিছুটা হলেও কমতে পারে এসব কার্যক্রম।

সাইবার বিশেষজ্ঞ ও ডিকোডস ল্যাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ মঈনুদ্দীন বলেন, প্রযুক্তির এ যুগে আপনি চাইলেই এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। ব্যক্তিপর্যায়ে জনসচেতনতা তৈরি ছাড়া এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। কারণ, এসব জায়গায় বিনিয়োগ করা খুবই সহজ। শুরুতে অল্প টাকা দিতে হচ্ছে। যেমন- আপনি ২০ থেকে ১০০ টাকা দিয়ে অনলাইনে জুয়া খেলা শুরু করতে পারেন।

অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে র‌্যাবের হাতে আটক চারজন / ফাইল ছবি

“কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে এগুলো মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়বে। গ্রামাঞ্চলের একেবারে নিম্নপর্যায়ের ব্যক্তিরাও এতে জড়িয়ে পড়ছেন, যা খুবই ভয়াবহ।”

“তরুণ-তরুণীদের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরির পাশাপাশি পাঠ্যক্রমেও এসব বিষয়ের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে হবে। আর দেশে যারা এসব কার্যক্রম ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাদের মুখোমুখি করতে হবে কঠোর শাস্তির। এমন বেশকিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে অন্য কেউ এ পথে পা বাড়ানোর সাহস দেখাবেন না। এসব অপরাধের টুঁটি এখনই চেপে ধরতে হবে”— মন্তব্য এ অপরাধ বিশেষজ্ঞের। 

আরএইচটি/