তীব্র গরমে আক্রান্ত শিশুরা, সুরক্ষায় যেসব পরামর্শ চিকিৎসকদের
দেশের অধিকাংশ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। প্রত্যেক দিন তাপমাত্রার নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। তীব্র গরমে ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। এ অবস্থায় শিশুদের সুরক্ষায় রোদ পরিহারের পাশাপাশি যত্রতত্র পানি, রাস্তার পাশের খোলা জুস-শরবত পান থেকে বিরত থাকা এবং আইসক্রিম না খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
গতকাল মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়, ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকায় রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা বেড়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, রাজধানীতে বেড়েছে শূন্য দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ প্রতিদিনই তাপমাত্রার পারদ উঁচুতে উঠছে।
বিজ্ঞাপন
এদিকে, রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট (শিশু হাসপাতাল), মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর’বি)-সহ বিভিন্ন হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে এসব হাসপাতালে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। গত কয়েকদিনের গরমে শুধু ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে ভর্তি আছে দুই শতাধিক শিশু। মুগদা হাসপাতালের শিশু বিভাগেও ইতোমধ্যে রোগীতে সব শয্যা পূর্ণ হয়ে গেছে।
শিশুদের স্বাস্থ্যসুরক্ষায় এ সময় কী করা প্রয়োজন— ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে শিশুবিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চাওয়া হয়। তাদের পরামর্শগুলো নিম্নে দেওয়া হলো-
রোদ-গরমে শিশুদের যথাসম্ভব বাসায় রাখতে হবে
প্রচণ্ড এ গরমের মধ্যে শিশুদের সুরক্ষায় যথাসম্ভব বাসায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, গত কয়েকদিনের গরমে শিশুদের কষ্ট বেশি হচ্ছে। এ গরমের কারণে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। এক্ষেত্রে অন্যান্য বয়সীদের তুলনায় শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি। বর্তমানে আমার হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে শুধু ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশু ভর্তি আছে ১৬ জন। এছাড়া জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়ার রোগী তো আছেই। অন্যান্য সময়ের তুলনায় আক্রান্তের এ হার আমরা অস্বাভাবিক বলছি।
“প্রচণ্ড রোদ ও গরমে শিশুদের যথাসম্ভব বাসায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কোনোভাবেই যেন তাদের বাইরে বের করা না হয়। কারণ, গরমে বাচ্চারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাইরে বের হলে অবশ্যই বাসা থেকে বিশুদ্ধ পানি নিতে হবে, প্রয়োজনে ছাতা ব্যবহার করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, যত্রতত্র পানি বা রাস্তার পাশের খোলা জুস, শরবত বা আইসক্রিম শিশুদের খাওয়ানো যাবে না। বাজারে এখন নানা ধরনের ড্রিংকস কিনতে পাওয়া যায়। সেগুলো বিশুদ্ধ পানি দিয়ে তৈরি কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
সতর্কতার পরামর্শ দিয়ে মুগদা হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ঈদ-পরবর্তী সময়ে ফুড পয়জনিং (খাদ্যে বিষক্রিয়া) রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও আমরা বেশি পাচ্ছি। এজন্য অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি বাসায় পানি খাওয়ানোর ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যতটুকু সম্ভব পানি ফুটিয়ে, এরপর ফিল্টার করে পান করা নিরাপদ।
শিশুদের ঘাম যেন গায়ে না শুকায়
তীব্র গরমের এ সময়ে শিশুদের ঘাম যেন গায়েই না শুকায়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশিষ্ট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মো. আজিজুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, হঠাৎ করে মাত্রাতিরিক্ত গরম পড়ার কারণে বাচ্চাদের শরীরে ঘাম বেশি হয়। ঘামটা যখন তাদের শরীরে শুকায় তখনই বাচ্চাদের সর্দি-কাশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এজন্য ঘাম হলে সাথে সাথে শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে হবে। পাশাপাশি পানি ও তরল জাতীয় খাবার বেশি বেশি খাওয়াতে হবে।
“বর্তমানে অতিরিক্ত গরমে ডায়রিয়ার পাশাপাশি সর্দি-কাশি নিয়েও অসংখ্য রোগী আমাদের কাছে আসছেন। একটু সিরিয়াস অবস্থা হলেই রোগীরা আমাদের কাছে আসেন। এর বাইরেও অসংখ্য রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা স্থানীয় ফার্মেসিগুলো থেকে ওষুধ এনে খাচ্ছেন। খোঁজ নিলে দেখতে পাবেন, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে বাচ্চারা কোনো না কোনো অসুখে আক্রান্ত।”
তিনি আরও বলেন, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ হলো বাইরের খাবার। এখন বাইরে প্রচণ্ড ধুলাবালি থাকে, যেগুলো বাতাসের মাধ্যমে উড়ে গিয়ে খাবারে গিয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন
“অনেকেই গরমের কারণে বেশি পরিমাণ ঠান্ডা পানি ও কোল ড্রিংকস পান করেন। এগুলোও অসুস্থতার বড় কারণ। এগুলোর মাধ্যমে জ্বর-সর্দি ও কাশি বেড়ে যায়। এমন অসংখ্য রোগী আমরা নিয়মিত পাচ্ছি। তাই ঠান্ডা জাতীয় কিছু খাবারের ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।”
পর্যাপ্ত লবণ পানি-স্যালাইন খাওয়ার পরামর্শ
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশি গরমের কারণে শুধু শিশুরাই নয়, বড়রাও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে গরমের সময় যারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে কাজ করেন তাদের জন্য ঝুঁকিটা একটু বেশি। তারা ডিহাইড্রেশন (পানিশূন্যতা) ঝুঁকিতে থাকেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হন; ডায়রিয়া আর সর্দি-কাশি তো আছেই। এজন্য একটানা এক ঘণ্টার বেশি রোদে থাকা যাবে না।
“প্রচুর পরিমাণ পানি পান করতে হবে। সম্ভব হলে পরিমাণ মতো লবণ মিশিয়ে পান করা উচিত। আরও ভালো হয় যদি দু-একটা ওরস্যালাইন খাওয়া যায়। কারণ, গরমে ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে লবণ বের হয়ে যায়। শুধু পানি পান করলে সেটা অনেক সময় ঘাটতি পূরণ করতে পারে না। তাই লবণ মিশিয়ে পানি পান করলে উপকার পাওয়া যায়।”
এ বি এম আব্দুল্লাহর মতে, অনেকে পিপাসা মেটাতে রাস্তাঘাটের লেবুর শরবত, আখের শরবতসহ নানা ধরনের পানীয় পান করেন। অথচ এগুলোতে ব্যবহার হওয়া পানি বিশুদ্ধ কি না, আমরা কেউই জানি না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ পানি বিশুদ্ধ হয় না। এগুলো খেয়েই মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুধু পানি আর শরবত নয়, এ সময়ে বাইরের সবধরনের খোলা খাবার যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। গরমে বের হওয়ার সময় অবশ্যই বাসা থেকে বেশি তাপে ফোটানো ও ফিল্টার করা পানি বোতলে করে নিয়ে বের হতে হবে।
“গরমের সময় যারা বাইরে বের হবেন, তারা একটু ঢিলেঢালা কাপড় পরার চেষ্টা করবেন। কারণ, জামা-কাপড় বেশি টাইট হলে শরীর থেকে গরমটা সহজে বের হতে পারে না”— পরামর্শ এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের।
তাপপ্রবাহ থাকবে আরও এক সপ্তাহ
এদিকে, আবহাওয়া নিয়ে কোনো সুসংবাদ দিতে পারছে না বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর। আগামী এক সপ্তাহ পর্যন্ত চলমান তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি। সেই সঙ্গে আবহাওয়া অফিসের ৪৪টি স্টেশনের মধ্যে ৪০টির ওপর দিয়ে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়, ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা এ মৌসুমের সর্বোচ্চ। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা বেড়েছে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মার্চ, এপ্রিল ও মে— এ তিন মাস হচ্ছে গরমের। এর বাইরেও যদি বৃষ্টি না থাকে তাহলে জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসও গরমের মাস বলা হয়। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে কালবৈশাখীর বৃষ্টি থাকে এবং জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে বর্ষাকালের বৃষ্টি থাকে। কালবৈশাখীর বৃষ্টির স্থায়িত্ব কম এবং জুন, জুলাই ও আগস্টের বৃষ্টির স্থায়িত্ব বেশি। কালবৈশাখীর বৃষ্টিতে তাৎক্ষণিকভাবে তাপমাত্রা কমে যায়। বর্তমানে যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে তাপমাত্রা আরও কিছুটা বাড়তে পারে।
সারা দেশে বৃষ্টি কবে হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কালবৈশাখীর বৃষ্টি কখন হবে, এটা আগে থেকে বলা মুশকিল। যে সিস্টেমগুলো বাংলাদেশের বাইরে তৈরি হয়, সেগুলোর বিষয়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা আগে পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেগুলো তৈরি হয়, সেগুলোর বিষয়ে পূর্বাভাস দিতে বেশি সময় পাওয়া যায় না। তবে, দেশের ভেতরে যে সিস্টেমগুলো তৈরি হয়, সেগুলোর বিষয়ে স্পষ্টভাবে পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয় না। দেশ ও দেশের বাইরে তৈরি হওয়া সিস্টেমগুলোর বিষয়ে আমাদের মডেলগুলো যে ধারণা দেয়, তা বিশ্লেষণ করে আমরা পূর্বাভাস দিই। তবে, এটা যে শতভাগ প্রতিফলিত হবে, সেটারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আমাদের সিস্টেম অনুযায়ী, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ভালো কোনো বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে না— বলেন এ আবহাওয়াবিদ।
টিআই/এসকেডি