জুন পর্যন্ত ১৬০০ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের টার্গেট
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ধরতে সক্রিয় হচ্ছে ডিআইএ
অবশেষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়ম এবং জাল সনদ ধরার কাজে গতি ফিরছে। এ বছরের জুনের মধ্যে ১৬০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এর ফলে গত তিন বছর ধরে জমে থাকা জট খুলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে অধিদপ্তর ও কর্মকর্তাদের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রাও অর্জিত হবে।
ডিআইএ কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সারা দেশে ২ হাজার ৩০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৬৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়েছে। ফলে প্রথম ৬ মাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। জানুয়ারি মাস থেকে পরিদর্শনের গতি ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থবছরের ২য় ৬ মাসে যেকোনো উপায়ে বাকি ১৬০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হবে। এজন্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে পরিদর্শনে পাঠানো হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ৩৬ হাজার ৭০০ এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতি, শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়োগে অনিয়ম এবং জাল সনদ শনাক্ত করার দায়িত্ব পালন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একমাত্র প্রতিষ্ঠান ডিআইএ। সেজন্য প্রতি বছর একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গত তিন বছর সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। অর্ধেকে নেমে আসে পরিদর্শনের সংখ্যাও।
আরও পড়ুন
অভিযোগ রয়েছে, সদ্য সাবেক পরিচালকের খামখেয়ালিপনার কারণে এমনটি হয়েছে। তিনি কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে না পাঠিয়ে অফিসে বসিয়ে রাখতেন। ফলে পরিদর্শনের সংখ্যা গত তিন বছরে অর্ধেকে নেমে আসে। আর সর্বশেষ অর্থবছরে এক হাজারের কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হয়। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও জাল সনদ ধরার কার্যক্রম তলানিতে ঠেকেছে।
জানতে চাইলে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (রুটিন দায়িত্ব) বিপুল চন্দ্র সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিআইএ চলতি অর্থবছরে যে পরিমাণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল তা বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে সব কর্মকর্তা পরিদর্শনে আছেন। শুধু সংখ্যায় নয়, পরিদর্শনের প্রতিবেদন যেন মানসম্মত হয় সেদিকে জোর দেওয়া হয়েছে। ফলে পরিদর্শনের জট যেমন কমবে তেমনি অনিয়ম-দুর্নীতি শনাক্তের সংখ্যাও বাড়বে।
সবশেষ দুই অর্থবছরে পরিদর্শন করা হয় ৪ হাজার ৩৮০টি প্রতিষ্ঠান। আর জাল সনদ চিহ্নিত করা হয় ২৬৮ জন শিক্ষকের। এই সময়ে ১৩৭ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৪৭ টাকা আদায়ের সুপারিশ করা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সারা দেশে ৩৬ হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিবছর পরিদর্শন হওয়ার কথা। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে একটি প্রতিষ্ঠান একবার পরিদর্শন করার পর আবার সেই প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে প্রায় ৭-৮ বছর লেগে যায়। তিন বছর ধরে পরিদর্শনের সংখ্যা কমিয়ে সেই জট আরও দীর্ঘ করা হয়েছে।
৫ মাসে পরিদর্শন করা হবে ১৬০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী, বছরজুড়ে কী কী কাজ হবে সে বিষয়ে প্রত্যেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের চুক্তি হয়। যা বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) নামে পরিচিত। সেই চুক্তি অনুযায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৩০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার কথা। কিন্তু ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিদর্শন করা হয়েছে মাত্র ৬৯৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে পরের ৬ মাসের জন্য বেশি পরিমাণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন বাকি রয়ে গেছে। এখন জুনের মধ্যে বাকি ১৬০০ প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
এত অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিআইএ পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, একজন পরিদর্শক যে জেলা বা উপজেলায় যান সেখানে তিনি একসঙ্গে ৪-৫টি বা তার চেয়েও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে আসেন। তাই এই সময়ের মধ্যে শুধু পরিদর্শন নয়, কোয়ালিটি পরিদর্শন করাও সম্ভব।
তিন বছরে ১২০ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত
ডিআইএ ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ৬১৫টি সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন করেছে। এই তিন অর্থ বছরে মোট ১২০ কোটি ৮৬ লাখ ২৩ হাজার টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করে এই টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরতের সুপারিশ করেছে।
প্রতিষ্ঠান বাড়ছে বেশি, জনবল সেভাবে বাড়ছে না
ডিআইএর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে এ দপ্তরের মাধ্যমে ৭৭৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন হয়। ২০২৪ সালে পরিদর্শন হচ্ছে ২৩০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সামনের বছর সেই সংখ্যা ২৫০০ এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ২৬০০ হবে। এ সংখ্যাটি ক্রমান্বয়ে বাড়বে।
ডিআইএ ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ওই সময় সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭ হাজার ৫০০। কিন্তু এখন সেই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৬ হাজার ৭০০। কিন্তু অবকাঠামো ও জনবল সেভাবে বাড়েনি।
আরও পড়ুন
প্রতিষ্ঠানটি ২০১০-১১ অর্থ বছরে ১ হাজার ১৩২, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৭০, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৬০৪, ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে ১ হাজার ৬৮৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ তিন অর্থবছরে ৯ হাজার ২৯৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে ৪৩৩ জন শিক্ষকের জাল সনদ চিহ্নিত করে ডিআইএ। একই সঙ্গে জাল সনদে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকের বেতন ভাতা হিসেবে নেওয়া ৫৮ কোটি ৮৯ লাখ ৮৯ হাজার ১০৭ টাকা আদায় করার সুপারিশ করে ডিআইএ।
সবশেষ দুই অর্থবছরে পরিদর্শন করা হয় ৪ হাজার ৩৮০টি প্রতিষ্ঠান। আর জাল সনদ চিহ্নিত করা হয় ২৬৮ জন শিক্ষকের। এই সময়ে ১৩৭ কোটি ৯২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৪৭ টাকা আদায়ের সুপারিশ করা হয়।
ডিআইএর আলোচিত যত প্রতিবেদন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও অনিয়মকারীদের জন্য এক আতঙ্কের নাম পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি জন্মলগ্ন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়ম নিয়ে কাজ করেছ।
ডিআইএর কয়েকটি প্রতিবেদন দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে রাজধানীর আইডিয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিবেদন অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটি আইডিয়াল স্কুলে ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০২ কোটি টাকার অর্থ আত্মসাৎ, ৪০০ শিক্ষক কর্মচারীর অবৈধ নিয়োগ, সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের অবৈধ নিয়োগ, ভর্তি বাণিজ্য এবং নানা খাত থেকে নেওয়া বিভিন্ন পরিমাণ অর্থের উৎস খুঁজে বের করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে দেখানো হয়, আইডিয়ালের অধ্যক্ষ মূল শাখা ছাড়া বাকি দুটি শাখার দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। এছাড়া দুর্নীতি থেকে অর্জিত অর্থে রাজধানীর আফতাবনগরে গড়ে তুলেছেন এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এছাড়া, বসুন্ধরা ও উত্তরায় দুটি প্লট, আফতাবনগর ও সূত্রাপুরে দুটি ফ্ল্যাট এবং ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। তার রয়েছে একটি ডেভেলপার কোম্পানিও।
ডিআইএর এ প্রতিবেদনের পর চাকরি হারান ওই স্কুলের প্রভাবশীল কর্মচারী আতিকুল ইসলাম। তার নিয়োগ কীভাবে অবৈধ ছিল তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে।
এর আগে রাজধানীর আরেক আলোচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মনিপুর স্কুলের দীর্ঘদিনের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ চাকরি হারান ডিআইএর প্রতিবেদনের জেরে।
এছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশে যাত্রাবাড়ীর আইডিয়াল স্কুল পরিদর্শন করে ডিআইএ। পরিদর্শনকালে দপ্তরটি দেখতে পায় ৫ বছরে সাড়ে ৬ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন অধ্যক্ষ মো. আবু ইউসুফ। এরপর তাকে বরখাস্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করে দপ্তরটি।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলে অবৈধ ভর্তি ও আর্থিক অনিয়মের বিষয়েও প্রতিবেদন দেওয়া হয় ডিআইএ থেকে।
যেসব কাজ করে ডিআইএ
>> সরকারি বেতন ভাতা ও মঞ্জুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার যথার্থতা যাচাই করা।
>> অনুমতি ও স্বীকৃতির শর্তাদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পালিত হচ্ছে কি না তা যাচাই করা।
>> সরকারের প্রশাসনিক আদেশ ও নির্দেশগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যথাযথভাবে পালন করছে কি না তা যাচাই করা।
>> শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা মাফিক পরিদর্শন এবং প্রয়োজনীয় উপদেশ দেওয়া।
>> সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক কার্যকলাপ তত্ত্বাবধান এবং কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তা তদন্ত করা।
>> শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অধীনস্থ দপ্তর, সংস্থা ও শিক্ষা বোর্ডসহ যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (সরকারি/বেসরকারি) অভিযোগ/অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করা।
এনএম/এসকেডি