দখল, পরিচর্যার অভাব, অবৈধ দোকান আর ময়লা-আবর্জনায় মলিন অবস্থা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক আমতলা গেটের। মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষায় যে স্থানে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা অনেক বীর; সেই স্থানের এমন বেহাল অবস্থায় সাধারণ মানুষ, শিক্ষাবিদসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আফসোসের সীমা নেই।

ধরতে গেলে বছরের ১২ মাসই দখলদারদের দৌরাত্ম্য থাকে স্থানটি ঘিরে। কেবল ২১ ফেব্রুয়ারির আগে ও পরের কয়েকদিন আমতলা গেট দখলমুক্ত দেখা যায়। এরপর আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায় ঐতিহাসিক ‘আমতলা গেট’। নিমিষেই অবৈধ দোকানে সয়লাব হয়ে যায় পুরো চত্বর। এমনকি ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেও রক্ষা পায় না স্থানটি। দখলমুক্ত করতে সকালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও বিকেলে ফের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এখানে সকালে সিটি কর্পোরেশন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে।

আমতলা গেটের সামনে দোকান নিয়ে বসা কিছু ভাসমান দোকানি জানান, স্থানটি নিয়ন্ত্রণ করে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। তাদের সাপোর্ট ছাড়া এখানে কেউ দোকান নিয়ে বসতে পারে না। অবশ্য, সেজন্য প্রতিদিন পরিশোধ করতে হয় নির্ধারিত পরিমাণের চাঁদা। দোকানভেদে ১০০ টাকা থেকে শুরু করে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয় প্রভাবশালী মহলকে। তারাই ‘মেনেজ’ করেন থানা-পুলিশ কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। তাই উচ্ছেদ অভিযান কিংবা অন্যান্য নির্দেশনা অনেকটা ‘থোরাই কেয়ার’ করেন তারা! চোর-পুলিশ খেলার মতো এসব অভিযানে তারা বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছেন।

সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেব্রুয়ারি মাসে একটু বেশি সমস্যা হয়। এ ছাড়া, অন্যান্য সময় কেউ ফিরেও তাকান না। তাই এ মাসে একটু সমস্যা হয়। তবে, এসব বিষয়ে কথা বেশি বলার সুযোগ নেই। মুহূর্তেই ঘিরে ধরেন কয়েকজন। কেন এসব তথ্য প্রয়োজন, এ বিষয়ে প্রতিবেদককে মুখোমুখি হতে হয় বেশ কয়েকজনের জেরার।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কী ঘটেছিল আমতলা গেটে

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (বাংলা ৮ ফাল্গুন ১৩৫৮) মাতৃভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর সূচনা হয়েছিল অনেক আগে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে তৈরি হয়েছিল পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থিত পাকিস্তানের এ দুটি অংশের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগতসহ অসংখ্য মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। তারপরও ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা ইসলামীকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়— উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। তবে, এমন ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান/পূর্ব বাংলা) মানুষজন। বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে জন্ম হয় তীব্র ক্ষোভের। ফলে পূর্ব বাংলায় ভাষা রক্ষার আন্দোলন দ্রুত দানা বাঁধে। সেই আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশসহ ইত্যাদি কার্যক্রম বেআইনি ও নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের শেষে চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ই ফাল্গুন ১৩৫৮)। পুলিশের ১৪৪ ধারার আদেশ অমান্য করে ছাত্র, প্রগতিশীল কিছু রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষ মিলে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি আমতলা গেটের কাছে আসলে পুলিশ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রফিক, সালাম, বরকত, আব্দুল জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে। বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য এ ত্যাগ বিশ্বের বুকে তৈরি করে অনন্য নজির। বাংলা ভাষা পায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার সম্মান।

অবশ্য, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও বড় জায়গা দখল করে রেখেছে এ আমতলা প্রাঙ্গণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থেও (পৃষ্ঠা-৯৬) উঠে এসেছে এ আমতলার ইতিহাস। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৪৮ সালের মার্চের ১৬ তারিখ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রসভায় আমরা সকলেই যোগদান করেছিলাম। হঠাৎ কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করে বসল সভাপতির আসন গ্রহণ করার জন্য। সকলেই সমর্থন করল। বিখ্যাত আমতলায় এই আমার প্রথম সভাপতিত্ব করতে হলো। অনেকেই বক্তৃতা করল।’ 

এত ঐতিহাসিক ঘটনার পরও অরক্ষিত ও অবহেলিত এ ঐতিহাসিক আমতলা গেট।

দোকানের ময়লা-আবর্জনা এবং চায়ের পানিতে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের গেটের কাছে সাদা রঙের বড় গেটটির অবস্থান। এটি আমতলা গেট নামে পরিচিত। গেটের ওপরে কালো রঙের একটি ছোট ব্যানারে লেখা রয়েছে— ‘ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলার ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, এই দিনে ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে।’

গেটের একেবারে সামনে থেকে শুরু করে আশপাশে পসরা সাজিয়ে বসেছে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪৫টির মতো ভাসমান দোকান। এসব দোকানে চা, পরোটা, ডিম সেদ্ধ, স্যুপ, সিগারেট, প্লাস্টিকের সামগ্রী, বালিশ, কম্বল, ফলের জুস, পাটি, ভাত, তরকারি, কিছু মেলামাইন ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ওয়ানটাইম প্লেট বিক্রি হচ্ছে। এসব দোকানের ময়লা-আবর্জনা এবং চায়ের দোকানের পানিতে ওই জায়গায় তৈরি হয়েছে স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। গেটের একপাশে টানানো রয়েছে ভাষা আন্দোলনের বড় দুটি ছবি। সেখানেও বসেছে দোকান। সামনের ফুলের বাগানের নিরাপত্তা বেড়ার ভেতরে থেকে একজন পরিচালনা করছেন দোকানের কার্যক্রম। মোটকথা, দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এটিই ভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্মৃতিবিজড়িত জায়গা।

আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি জায়গা সুন্দরভাবে সংরক্ষণের দাবি

আমতলা গেটের দুরবস্থা নিয়ে আফসোসের কথা জানালেন সাধারণ মানুষ। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চা পান করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী লিটন হোসেন বলেন, প্রতিটি দেশের ইতিহাস ও গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিটি জায়গা খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করা হয়। অথচ বাংলাদেশে বিষয়টি ভিন্ন। এত অর্থবহ ও গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গার বেহাল অবস্থা। আমরা প্রায় এখানে আসি। এ অবস্থা দেখলে খুব কষ্ট লাগে। মনে হয়, দেখার যেন কেউ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কলেজের এক শিক্ষক বলেন, ভাষা আন্দোলন দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা। এর হাত ধরে পরবর্তী সময়ে স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। অথচ এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান বছরে অধিকাংশ সময় অবৈধ দোকানে ভরা থাকে। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যারা জড়িত তাদের উচিত ভালোভাবে বিষয়টি দেখা।

জুনায়েদ আহমেদ নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, মাঝেমধ্যে এখানে উচ্ছেদ অভিযান চলে। পরে আবার দখল হয়ে যায়। এর পেছনে যারা জড়িত তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। তবে, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টিতে ভালোভাবে নজর দেওয়া উচিত। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা ভাষার ইতিহাস। এটি অনেক বড় আবেগের জায়গা। আমতলা গেটের সংরক্ষণে সবাইকে যথার্থ ভূমিকা পালন করা উচিত। এমনকি সাধারণ মানুষকেও এ বিষয় নিয়ে সামনে এগিয়ে আসা উচিত। 

যা বলছেন দায়িত্বশীলরা

ভাষা শহিদদের স্মৃতিবিজড়িত ও রক্তস্নাত স্থান আমতলা গেটের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রশাসন। বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আসাদুজ্জামানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরবর্তীতে খুদে বার্তা পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

আমতলা গেটের দুরবস্থার বিষয়টি ‘লজ্জাজনক’ বলে মন্তব্য করেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত আমতলা গেটে দুরবস্থা অত্যন্ত লজ্জাজনক। আমরা প্রায়শই দেখি এটির যথাযথ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। জাতীয়ভাবে এর সংরক্ষণ করা উচিত। এখন আমতলা গেট যে অবস্থায় রয়েছে সেটি খুবই অগ্রহণযোগ্য।

‘আমি মনে করি, শুধু ভাষা শহিদদের জন্য নয় বরং আমাদের জাতীয় চেতনার জন্য আমতলা গেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মর্যাদার সঙ্গে এর সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। শহিদ মিনারকে যেমন সবসময় সংরক্ষণ করা হয়  তেমনি আমতলা গেটও একটি সংরক্ষিত কেন্দ্র হিসেবে গণ্য করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত এ আমতলা গেট ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে অব্যবস্থাপনা নিয়ে অসহায়ত্বের কথা জানান স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এখানে আমাদের উচ্ছেদ অভিযান রেগুলার (নিয়মিত) চলে। আমার ওয়ার্ডে এ সমস্যা প্রকট। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের এখানেই নয় বরং শিল্পকলা ও এর আশপাশেও সমস্যাটি রয়েছে। আমরা নিয়মিতভাবে এলাকা ভেদে প্রতি সপ্তাহে অভিযান পরিচালনা করি।’

সকালে উচ্ছেদ হলে বিকেলেই আগের অবস্থায় কীভাবে ফিরে আসে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব কোন বাহিনী নেই যে তাদের (হকার/দখলদার) পুনরায় বসা থেকে আমরা ঠেকাব। আমরা যখন নিজেরা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করি তখন সঙ্গে পুলিশ থাকে। যার কারণে তখন আমরা উচ্ছেদ করতে পারি। রাস্তায় তো সার্বক্ষণিক থাকা সম্ভব না।’

সমস্যার সমাধানে কী ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন— জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায় অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার। তারা যদি স্থানীয় থানা পুলিশের ওপর আমতলা গেটের দায়িত্ব দেন তাহলে খুবই ভালো হয়। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মানুষ অন্য চোখে দেখে। সে হিসেবে ডিএমপি যদি বিষয়টি দেখে তাহলে খুবই ভালো হয়।

আরএইচটি/এমজে/এমএআর/