অপরাধী যতই কৌশলীই হোক না কেন অপরাধ করে পার পাওয়া যায় না কিংবা পাপ বাপকেও ছাড়ে না এমন চিরন্তন সত্য বাণী ঘুরেফিরেই বাস্তব জীবনে দেখা যায়। যেমনটা দেখা গিয়েছিল হলিউডের বিখ্যাত ‌‘ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান’ মুভিতেও। ছবিতে কেন্দ্রীয় চরিত্র ফ্রাঙ্ক (অভিনেতা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও) ব্যাংক জালিয়াতি থেকে শুরু করে মেডিকেল সার্টিফিকেট, ল’ সার্টিফিকেট জালিয়াতি করেও দিনের পর দিন আর্থিক অপরাধ করে গেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, নানা নাটকীয়তার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হতে হয় তাকে।

তেমনই বাস্তব জীবনের উদাহরণ হচ্ছেন ফারুক বিন জামান বাবর ওরফে ফরহাদ জামান। অপরাধ লুকাতে ছদ্মনাম ফরহাদ জামান ব্যবহার করে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্যাক্স সার্টিফিকেট, টিআইএন সার্টিফিকেটের, বিনিয়োগ বোর্ডের সনদ, ফায়ার সার্ভিস সনদ, ট্রেড লাইসেন্স তৈরি করে একের পর এক অপকর্ম করে বহাল তবিয়তে ছিলেন দীর্ঘ ১০ বছর। মুভির মতো এখানেও শেষ রক্ষা হয়নি, বেরিয়ে আসে আসল পরিচয়। এবার বিচারের মুখোমুখি হওয়ার পালা।

ইতোমধ্যে প্রায় ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় ফারুক বিন জামান বাবর (প্রকৃত নাম) ও ১০ কাস্টমস কর্মকর্তাসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি চার্জশিট দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মঈনুল হাসান রওশনী। যদিও এখনো তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের নারায়ণগঞ্জ অফিস থেকে প্রথমে অপকর্ম ফাঁস হয়ে। ভুয়া বন্ড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন জাল নথিপত্রে ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানিতে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দিতে গিয়ে মেসার্স এসএম পলি কার্টুন প্যাকেজিংয়ের মালিক ফরহাদ ইবনে জামান ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট খায়রুল ইসলামের অপরাধ প্রথম নজরে আসে কাস্টমস অফিসের

এ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করে যে কোনো অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ পরিচালনা করে থাকে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই মামলারও চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

অন্যদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মঈনুল ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশনের অনুমোদনক্রমে চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়েছে। চার্জ গঠনের পর আদালতে বিচার কাজ শুরু হবে। আমি আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে

কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের নারায়ণগঞ্জ অফিস থেকে প্রথমে অপকর্ম ফাঁস হয়ে। ভুয়া বন্ড লাইসেন্সসহ বিভিন্ন জাল নথিপত্রে ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানিতে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দিতে গিয়ে মেসার্স এসএম পলি কার্টুন প্যাকেজিংয়ের মালিক ফরহাদ ইবনে জামান ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট খায়রুল ইসলামের অপরাধ প্রথম নজরে আসে কাস্টমস অফিসের। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় এলসি খুলে ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৩৭৫ টন ডুপ্লেক্স বোর্ড মিথ্যা বন্ড সুবিধা নিয়ে ওই টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়। প্রথমে কাস্টমস আইনে মামলা হওয়ার পরই কেঁচো খুঁড়তে সাপের দেখা মেলে! কাস্টমস থেকে পুলিশের কাছে তদন্তে গেলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর দায়ের করার মামলার তদন্ত ভার আদালতের নির্দেশনায় যায় দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।

এরপর প্রধান আসামি ফারুক বিন জামান বাবর ওরফে ফরহাদ জামানের বাস্তব পরিচয় ও ঠিকানা না পাওয়ায় কেটে গেছে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর। তদন্ত কাজে গতি আনতে একে একে একে ৮ জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছেন। কিন্তু প্রধান আসামিকে খুঁজে পাওয়া যায়নি কিংবা দুদকের তলবে তিনি হাজিরও হননি।

যেভাবে পাওয়া যায় ফরহাদ জামানের প্রকৃত পরিচয়

৯ম তদন্ত কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পাওয়ার পর মামলার সব নথি পুনরায় পর্যালোচনা শুরু করেন দুদকের উপ-পরিচালক মঈনুল। বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য গ্রহণের জন্য আসামি ফরহাদ ইবনে জামানের ঠিকানায় নোটিশ দেওয়া হলেও তিনি কখনই হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদান করেননি। এমনকি ওই নামে কোনো ব্যক্তিকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ফরহাদ ইবনে জামানের কোনো হদিস না পাওয়ায় ইসলামী ব্যাংকের সাভার শাখা ও ন্যাশনাল ব্যাংকের বাবুবাজার শাখায় পাওয়া ফরহাদ ইবনে জামানের জাতীয় পরিচয়পত্র (১৫৯২৮৩০৬৩৭০৮২) সংগ্রহ করা হয়। এরপর দেখা যায়, ওই নম্বরটি মিলাদুন্নবী নামে এক ব্যক্তির। যার সঙ্গে ফরহাদ ইবনে জামিনের দাখিলকৃত নাম ও ঠিকানার মিল নেই। অর্থাৎ জাতীয় পরিচয়পত্রটি ভুয়া।

২০১৩ সালের মামলায় আসামি হলেও আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ফাস্ট অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট রেহানা আক্তারকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

পরবর্তীতে আসামি ফরহাদ ইবনে জামানের প্রকৃত পরিচয় নিশ্চিত হতে তার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসএম পলি কার্টুন অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের নামীয় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকে হিসাব খোলার আবেদনপত্রে থাকা মোবাইল নম্বরের রেজিস্ট্রেশন ধরে জাতীয় পরিচয় নম্বর (১৯৮০৫১১৪৩৫০২৯৯১৬) পাওয়া যায়। সেখানে তার নাম পাওয়া যায়, ফারুক বিন জামান বাবর, বাড়ি লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগঞ্জে। ফারুক বিন জামান বাবরই আসামি ফরহাদ ইবনে জামান কিনা সেটা আরও যাচাই করতে উত্তরা ব্যাংকের পান্থপথ শাখার হিসাব খোলার কপি ও ছবিসহ অন্যান্য নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়। যার সঙ্গে আসামি ফরহাদ ইবনে জামানের চেহারা ও জন্ম তারিখ এবং স্ত্রী ও মায়ের নামের মিল পাওয়া যায়। এরপর যোগাযোগের জন্য আসামি ফারুক বিন জামান বাবরের বক্তব্য গ্রহণের নোটিশ দেয় দুদক। তারপরও তাতে সাড়া দেননি তিনি।

অন্যদিকে ফারুক বিন জামান বাবরই মামলার আসামি ফরহাদ ইবনে জামান কি-না সেটা আরও নিশ্চিত হতে বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়ার জন্য সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাভার শাখা ও ন্যাশনাল ব্যাংকের বাবুবাজার শাখা থেকে জব্দ করা নথিপত্রসহ অন্যান্য নথিপত্র ও সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের হস্তলিপি শাখার মতামত নেওয়া হয়। তাদের মতামত অনুসারে ফারুক বিন জামান বাবর ও ফরহাদ ইবনে জামান একই ব্যক্তি বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ফরহাদ ইবনে জামান নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্ব নেই। ফারুক বিন জামান বাবরই অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পূর্বপরিকল্পিতভাবে নিজের প্রকৃত নাম পরিচয় গোপন করে ফরহাদ ইবনে জামান নাম ধারণ করেন এবং প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভুয়া রেকর্ডপত্র তৈরি করেন।

পরবর্তীতে আরও জানা যায়, আসামি ফারুক বিন জামান বাবরের নামে বিভিন্ন থানায় একাধিক প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলা চলমান ছিল। ফারুক বিন জামান বাবরই প্রকৃতপক্ষে আসামি ফরহাদ ইবনে জামান তা নিশ্চিত হওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক চার্জশিটের অনুমোদনপত্রে আসামি ফরহাদ ইবনে জামান নামের সঙ্গে ফারুক বিন জামান বাবরের নাম সংযোজন করে চার্জশিটের দাখিল করা হয়।

ফারুকের সঙ্গে চার্জশিটভুক্ত আসামি হয়েছেন ১০ কাস্টমস কর্মকর্তা

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসএম পলি কার্টুন অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক ফারুক বিন জামান বাবর ওরফে ফরহাদ জামান ২০১৩ সালের ১৭ জুন প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া বন্ড লাইসেন্স তৈরি করেন। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির জন্য লিয়েন ব্যাংক হিসেবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাভার শাখায় ৯টি এলসি খোলেন। প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া বন্ড লাইসেন্স করে ৫টি এলসির বিপরীতে পণ্য আমদানি করে নারায়ণগঞ্জের আদমজী ইপিজেড থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাস করেন। এতে সরকারের ১ কোটি ২৯ লাখ ১১ হাজার ৪৪ টাকা এবং অপর ৪টি এলসির বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্য খালাস করে সরকারের ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার ৬০০ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেন তিনি।

এভাবে মোট ১ কোটি ৮৫ লাখ ৬০ হাজার ৬৭৭ টাকা শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন ফারুক বিন জামান বাবর।সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাভার শাখায় খোলা মোট ৯টি এলসির বিপরীতে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া বন্ড লাইসেন্সসহ অন্যান্য নথিপত্র তৈরি করে ওই অর্থ হাতিয়ে নেন তিনি।

চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন, মেসার্স এসএম পলি কার্টুন অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক ফারুক বিন জামান বাবর ওরফে ফরহাদ ইবনে জামান, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কুমিল্লা শিপিং এজেন্সির পরিচালক মো. আলাউদ্দিন, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মেসার্স ইসলাম অ্যাসোসিয়েটসের মালিক মো. খাইরুল ইসলাম, ঢাকার (পূর্ব) কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগের রাজস্ব কর্মকর্তা রতন কুমার মৈত্র, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের রাজস্ব কর্মকর্তা মোছাম্মৎ রুখসানা বেগম, সাতক্ষীরা কাস্টমস হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সেলিম চৌধুরী, সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তা রেনু রঞ্জন পাল, অবসরপ্রাপ্ত রাজস্ব কর্মকর্তা একেএম মজিবুর রহমান. মো. কেরামত আলী ফকির, সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা রেজাউল করিম সরদার, মো. ফরিদ উদ্দীন, খন্দকার গোলাম মোর্তজা ও সাবেক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭৩/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

মামলার আসামিদের মধ্যে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কুমিল্লা শিপিং এজেন্সির পরিচালক মো. আলাউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

মামলায় আসামি হলেও চার্জশিট থেকে অব্যাহতি পান ব্যাংক কর্মকর্তা

২০১৩ সালের মামলায় আসামি হলেও আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ফাস্ট অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট রেহানা আক্তারকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। 

কারণ হিসাবে দুদক সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) অনুমোদনের জন্য ‘বিজনেস ম্যানুয়েল’ এর ৪.৪ ধারার অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বন্ড লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই। আমদানিকারক আসামি ফরহাদ ইবনে জামান ওরফে ফারুক বিন জামান বাবরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডে মেসার্স এসএম পলি কার্টুন অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের অনুকূলে ৯টি ঋণ পত্র খোলা হয়।

২০১৩ সালে এলসি খোলার সময় আসামি ফরহাদ ইবনে জামান ওরফে ফারুক দিন জামানের দাখিলকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের সঠিকতা যাচাই করার ক্ষমতা ব্যাংকের ছিল না, সে কারণে ওই জাতীয় পরিচয়পত্রের ওপর ভিত্তি করেই এলসি ইস্যু করে। এ জন্য সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ফাস্ট অ্যাসিসট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট রেহানা আক্তারকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আরএম/এসকেডি