দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিয়ে টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। ২৫ মন্ত্রী ও ১১ প্রতিমন্ত্রী মিলে ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা নিয়ে নতুন সরকারের পথচলা শুরু হয়েছে। 

নতুন মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের অর্ধেকের বেশি সদস্যের ঠাঁই হয়নি। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এই মন্ত্রিসভায় আগের কয়েকজনের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে নতুন মন্ত্রিসভাকে স্মার্ট হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করছেন বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে নতুন মন্ত্রিসভায় আপাত দৃষ্টিতে বিতর্কিত ব্যক্তি নেই। তবে বাণিজ্য, অর্থ ও পররাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পূর্বে অভিজ্ঞতা সম্পন্নদের দিলে ভালো হতো বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। 

এছাড়া বর্তমান সরকারকে বড় দুটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বলে মনে করছেন তারা- ১. প্রধান বিরোধী দল বিএনপি বিহীন নির্বাচনকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি পশ্চিমা দেশগুলো। তাদের সমর্থন আদায় করা সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। ২. দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকানো, মূল্যস্ফীতির হার সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর কমতে না দেওয়া সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সরকারকে ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। 

 

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কে এম মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও অদক্ষতার কারণে আগের মন্ত্রিসভা থেকে ২৮ জন বাদ পড়েছেন। মোট ৩৭ জনের মধ্যে নতুন করে জায়গা পেয়েছেন ১৯ জন। আক্ষরিক অর্থে এই মন্ত্রিসভাকে চমক বলা যায়। তাই এই মন্ত্রিসভা নিয়ে এখনই মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, এবার সরকার সুশাসনের দিকে বেশি নজর দেবে। এটা করতে হলে মন্ত্রী ও তার পরিবারকে আগে দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক প্রফেসর আবুল কাশেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের মন্ত্রীদের চোখে মুখে এক ধরনের চাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ এই নির্বাচনকে এখনও পশ্চিমা দেশগুলো স্বীকৃতি দেয়নি। বিএনপিসহ ১৬টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় এর কিছু না কিছু প্রভাব থাকবে সরকারের পুরো সময়জুড়ে।

প্রফেসর আবুল কাশেম বলেন, নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা যে চাপ দিয়েছে তা অব্যাহত থাকবে। একইসঙ্গে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে বিরোধী জোট। সব মিলিয়ে সরকারকে যেমন বৈশ্বিক চাপ সামাল দিতে হবে তেমনি দেশীয় চাপও সামাল দিতে হবে। মোটকথা এই সরকারের সামনে অর্থনীতি, কূটনীতি ও রাজনীতির চ্যালেঞ্জ থাকবে।

সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনৈতিক সংকট সামাল দেওয়া। এখানে সরকার ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে মত দিয়েছেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের মন্ত্রিসভাকে এক কথায় বলতে হলে স্মার্ট মন্ত্রিসভা বলতে হবে। আপাতত এই মন্ত্রিসভায় বিতর্কিত কেউ নেই। এছাড়া অর্থনৈতিক এই সংকটের মধ্যে সরকার মন্ত্রীদের তালিকা লম্বা করেনি, এটাকেও সাধুবাদ জানতে হবে। তবে তাদের ক্লিন ইমেজ ধরতে রাখতে হবে।

তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমাদের চাপ থাকবে। তবে চীন, রাশিয়ার সমর্থন সরকারকে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে রাখবে। ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক বিষয়টি নিয়ে এখন আলোচনা না করাই ভালো। এটি পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে এখন মনে হচ্ছে বড় ধরনের কোনো নিষেধাজ্ঞা আসবে না। সরকারকে এ বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকাররের ওপর পশ্চিমাদের চাপ আপাত দৃষ্টিতে কমছে না বলেই মনে হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় সরকার কীভাবে বৈশ্বিক চাপ সামাল দেয়। দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে এবং দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় রাখতে বাংলাদেশের বৈশ্বিক সহায়তা ও বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। এছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হবে। অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার ওপর যদি মানুষের আস্থা তৈরি না হয়, তাহলে বিনিয়োগ আসবে না, রেমিট্যান্স কমবে। তখন সমস্যাগুলোর সমাধান কঠিন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে পশ্চিমাদের প্রশ্ন থেকেই যাবে। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে যেমন বৈশ্বিক চাপ সামালাতে হবে, তেমনি রাজনৈতিক চাপও থাকবে। 

তিনি বলেন, পশ্চিমাদের চাপ কেমন হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। কে, কোন ধরনের চাপ দিতে পারে সেটি প্রকাশ না করা পর্যন্ত অর্থনীতিতে এক ধরনের অদৃশ্য চাপও থাকবে। দৃশ্যমান চাপের চেয়ে অদৃশ্য চাপ মোকাবিলা করা কঠিন।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের সামনে ডলার সংকট এখন প্রধান সমস্যা। চলতি বছরও এ সমস্যা চলমান থাকবে। এর প্রভাবে টাকার অবমূল্যায়ন হবে। ফলে আমদানি খরচ বাড়বে। এতে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে অন্য পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। এর ফলে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বাড়বে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হবে। এসবের প্রভাবে নতুন কর্মসংস্থান কমবে।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে হলে টাকার প্রবাহে লাগাম টানতে হবে বলে মত দেন তিনি।

এনএম/এমএসএ