রাত পোহালেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ইতোমধ্যে ১৯ দিনের নির্বাচনী প্রচারণা শেষ করেছেন এক হাজার ৯৭০ প্রার্থী। তাদের মধ্যে ‘কিংস পার্টি’ খ্যাত তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী রয়েছে ১৩৫টি আসনে। দলটির প্রতীক ‘সোনালী আঁশ’। জানা গেছে, হেভিওয়েট প্রার্থীদের কারণে নির্বাচনী মাঠে অনেকটা কোণঠাসা দলটির প্রার্থীরা। তবে, সবকিছু ছাপিয়ে আলোচনায় দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অসহযোগিতা।

কিংস পার্টির প্রার্থীদের অভিযোগ, নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা অসহযোগিতা করছেন। মাঠে নামার আগে আর্থিক সহযোগিতাসহ নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তারা। এ অবস্থায় ভোটের ঠিক আগে নানা আক্ষেপ আর হতাশা ভর করেছে তাদের ওপর। এখন নির্বাচনী মাঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই তৃণমূল বিএনপির ১৩৫ প্রার্থীর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১২টিতে প্রতিযোগিতা করছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা। এর মধ্যে আটটি আসনের প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট। জানা গেছে, দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট নন তারা। নিজেরদের মতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কোনো কোনো এলাকায় বিরোধীদের বাধার মুখে পড়ছেন। তারপরও নির্বাচনী মাঠে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন।

গত ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত আলোচনা সভা থেকে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপার্সন শমসের মুবিন চৌধুরী ও মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেন দলটির বিভিন্ন আসন থেকে প্রার্থী হওয়া নেতারা। তারা জানান, দলের চেয়ারপার্সন ও মহাসচিব তাদের মাঠে নামিয়ে এখন আর খোঁজ নিচ্ছেন না। দল থেকে কোনো আর্থিক সহযোগিতাও পাচ্ছেন না তারা।

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১২টিতে প্রতিযোগিতা করছেন তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীরা। এর মধ্যে আটটি আসনের প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট। জানা গেছে, দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট নন তারা। নিজেরদের মতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কোনো কোনো এলাকায় বিরোধীদের বাধার মুখে পড়ছেন। তারপরও নির্বাচনী মাঠে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছেন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখন পর্যন্ত অংশ নিচ্ছে ২৮টি দল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির পরে প্রার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় তৃতীয় অবস্থানে আছে তৃণমূল বিএনপি। প্রার্থীরা জানিয়েছেন, সেভাবে প্রচারণা চালাতে না পারলেও শমসের মুবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার বেশ জোরেশোরে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী মাঠ।

ঢাকা-১৮ আসনের তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মোহাম্মদ মুফিজুর রহমান। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পোস্টার ছিঁড়ে ফেলাসহ অনেক ঘটনা আছে। কতটুকু বলব আর কতটুকু আপনি লিখবেন? রাতে পোস্টার লাগিয়েছি, সকালে গিয়ে দেখি ছিঁড়ে ফেলেছে। নেতারা কথা শোনে, কিন্তু কর্মীরা তো শোনে না। নির্বাচনের পরও তো আমরা এলাকাতে থাকব। ওদের সঙ্গে সংঘর্ষ করে শান্তি নষ্ট করা যাবে না। ওরা আমাদের পোস্টার ছিঁড়ে, আমরা বারবার লাগাই। একটি পোস্টার ছাপানো থেকে শুরু করে সুতা, আঠা, পলিথিন, লেবার কস্ট— সবকিছু মিলে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা খরচ হয়।

দলীয়ভাবে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো সহযোগিতা এখন পর্যন্ত পাইনি। পাব বলেও আশা নেই। যা করছি, নিজেদের উদ্যোগেই। দলের চেয়ারপার্সন-মহাসচিব যোগাযোগ করেন না। উনারা আমাদের এলাকার জনসংযোগের জন্য কখনও আসেননি। আমাদের যেভাবে বলা হয়েছিল, তার যদি ১০ শতাংশও পেতাম তাহলে মনে কোনো দুঃখ ছিল না! উনারা আমাদের পয়সা দেবেন, জনসভা করার জন্য আমাদের এলাকা ভিজিট করবেন— এমন নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন কোনো খবর নেই। নিজের উদ্যোগে যা পারছি, তা-ই করছি।

ঢাকা-১৯ আসনের তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মাহাবুবুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের পোস্টার-ফেস্টুন সবকিছু তারা ছিঁড়ে ফেলেছে। মাইক বাজাতে প্রথমে বাধা দিয়েছিল। পরে থানায় অভিযোগ করার পর আর বাধা দেয়নি। তবে, পোস্টার-ফেস্টুন এলাকার কোথাও নেই। সব তারা ছিঁড়ে ফেলেছে। দেখে মনে হবে এ এলাকায় তৃণমূল বিএনপির কোনো প্রার্থী নেই।

তিনি অভিযোগ করেন, দল থেকে কোনো খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে না। যোগাযোগও রক্ষা করা হচ্ছে না।

ঢাকা-১২ আসনের তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী নাঈম হাসান বলেন, রাতের আঁধারে আমাদের পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি। তারা বলছে, স্পেসিফিকভাবে বলতে কে ছিঁড়েছে। ঢালাওভাবে অভিযোগ করলে হবে না। নির্দিষ্ট করে বললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অথচ রাতের আঁধারে কে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলল, কীভাবে বের করব? সারা রাত ধরে তো পাহারা দেওয়া যায় না।

দল থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বলতে পারেন, আমাদের নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তারা দূর থেকে নাটক দেখছে। উনাদের কথা হচ্ছে, আপনারা তো নমিনেশন ফর্ম নেওয়ার সময় বলেছিলেন নিজ অর্থে নির্বাচন করবেন। তাহলে এখন কেন আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন? কোনো প্রবলেম হলে তখন আপনারা বলবেন। আমাদের তো নতুন দল, আমাদের সেভাবে টাকা-পয়সা ওঠেনি। নমিনেশন ফর্ম বিক্রি করে টাকা উঠেছে ৩০ লাখ। এ টাকা যদি আপনাদের ভাগ করে দিই, তাহলে কত টাকা করে পড়ছে?  এসব কথা বলছেন তারা। আর্থিক কোনো সহযোগিতা দিচ্ছেন না তারা। এজন্য আমরা কাজ করতে পারছি না। প্রতিকূল অবস্থায় নিজেই সব মোকাবিলা করছি।

ঢাকা-১৫ আসনের প্রার্থী খন্দকার মো. ইমদাদুল হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যার আছে, সে প্রচারণা চালাচ্ছে। যার নেই, সে চালাচ্ছে না। আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। প্রার্থী হয়েছি, নিজের লাভের জন্য তো দেশকে নষ্ট করা যায় না। আমরা যদি এখন বয়কট (ভোট বয়কট) করি, তাহলে তো নির্বাচন হবে না। ১০০ প্রার্থী তো আমাদের আছে। তারা নির্বাচন করতে প্রস্তুত আছে। কী দরকার আছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার?

ঢাকা-৫ আসনের প্রার্থী আবু হানিফ হৃদয় বলেন, নির্বাচনী প্রচারণা কিছুটা করতে পেরেছি। কিন্তু ওরা আমাদের পোস্টারগুলো ছিঁড়ে ফেলছে। এখানে আওয়ামী লীগেরই তিনজন প্রার্থী। দুজন স্বতন্ত্র, একজন দলীয়। ওরা তিনজন মিলে আমার ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। কিছুটা প্রচারণা চালাতে পারলেও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে।

দলীয় সমর্থন ও সহযোগিতার বিষয়ে তার মুখে শোনা যায় ভিন্ন সুর। আবু হানিফ হৃদয় বলেন, আমি যতটুকু দেখছি, মহাসচিব খুবই আন্তরিক। মহাসচিব সবার খোঁজখবর রাখেন। তিনি একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। তাকে এলাকায় মাঠে-ঘাটে কাজ করতে হচ্ছে। অনেকেই তাকে ফোন দেন। কিন্তু সবার ফোন রিসিভ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। অনেকের সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। তবে, মহাসচিব অত্যন্ত আন্তরিক। তিনি আমাদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।

ঢাকা-১ আসনের তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মুফিদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার এখানে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়েছেন। তাদের সঙ্গে আমিও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। কেউ কোনো ধরনের ডিস্টার্ব করছে না। দলীয় সহযোগিতা পাওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি তো আমার বলে বলিয়ান।’ কিন্তু আপনার দলের অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, তারা দল থেকে সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে মুফিদ খান বলেন, ‘আমিও শুনেছি। দলের লিডাররা সুযোগ নিয়েছেন, দল থেকে কিছু দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেওয়া হয়নি। আসলে কে সুযোগ নিল, আর কে নিল না— এ নিয়ে আসি ভাবি না। আমি কাউকে কিছু দিই না, কারও কাছ থেকে নিইও না। আগেই বলেছি, আমি আমার বলে বলিয়ান। দল আমাকে নমিনেশন দিয়েছে, সরকারি বিধিবিধান অনুযায়ী নির্বাচন করছি।’

গত ২৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে তৃণমূল বিএনপির নির্বাহী চেয়ারপার্সন অন্তরা হুদা দলের তহবিল থেকে টাকা তছরুপ করেছেন বলে অভিযোগ করেন প্রার্থীরা। ‘তৃণমূল বিএনপির সব প্রার্থীর সঙ্গে মতবিনিময় ও আলোচনা সভা’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে দলের কো-চেয়ারপার্সন কে এ জাহাঙ্গীর মাজমাদার এবং সভাপতি হিসেবে দলের ভাইস চেয়ারপার্সন মেজর (অব.) ডা. শেখ হাবিবুর রহমানের অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও তারা অংশ নেননি। সভায় বিভিন্ন আসনে তৃণমূলের প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।

ওই সভায় যশোর-৫ আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মেজর (অব.) আবু নসর মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, দেশে সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছি এবং করছি, তাতে বাধা তৈরি করেছেন দুই বেইমান শমসের মুবিন ও তৈমুর আলম। নজিরবিহীন অসমন্বয় করে আমাদের উলঙ্গ করে তারা মাঠে ছেড়ে দিয়েছেন। শমসের, তৈমুর ও অন্তরা হুদা দলের তহবিল থেকে টাকা তছরুপ করে আমাদের উলঙ্গ করে নির্বাচনী মাঠে যে তামাশা করছেন, জাতির কাছে তার হিসাব দিতে হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে আমরা কঠোর হতে বাধ্য হব। ৬০ প্রার্থীকে নিয়ে আমি আমরণ অনশনে যেতে বাধ্য হব।

তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপার্সন শমসের মুবিন চৌধুরী সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) ও মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করছেন। তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপির সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা। গত ১৯ সেপ্টেম্বর দলের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নাজমুল হুদার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদাকে দেওয়া হয় নির্বাহী চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব। তিনি মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে দলের প্রার্থী হয়েছেন। যদিও তার পৈতৃক আসন ঢাকা-১।

এমএইচএন/এসকেডি