শীতের সকালে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোও বড় চ্যালেঞ্জ— মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা / ছবি- সংগৃহীত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর স্থানীয় সরকার, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও একাদশ সংসদের রেকর্ডসংখ্যক উপনির্বাচনসহ হাজারের বেশি নির্বাচন সম্পন্ন করেছে এ কমিশন।

দায়িত্ব নেওয়ার পর সব নির্বাচনেই নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে ইসি। ভোটে অন্যায়, অনিয়ম হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়াসহ ভোট বাতিল করার নজির স্থাপন করেছে বর্তমান কমিশন। তবে, সবকিছু ছাপিয়ে সংসদ নির্বাচন ঘিরে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আউয়াল কমিশনকে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার পাশাপাশি শীতের সকালে সব কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পৌঁছানো এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার নির্বাচনের মাঠে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ নিবন্ধিত বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে না। ফলে কেন্দ্রে ভোটার আনার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ইসি। সেই সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক সংকটও। যা জটিল করতে পারে ভোটের সার্বিক পরিস্থিতি। নির্বাচনে অংশ না নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচির সামনে দাঁড়িয়ে যথাসময়ে ভোট করতে সার্বিক প্রস্তুতি নিয়েছে আউয়াল কমিশন।

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করতে পারে তারা। ভোট বাধাগ্রস্ত করতে জ্বালাও-পোড়াওসহ সহিংসতাও বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা মোকাবিলা করে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ করা ইসির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আবার সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ভোটারদের মধ্যেও ভীতি তৈরি হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এবার বড় বিরোধী দল (বিএনপি) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। শুধু অংশগ্রহণ না করে বসে থাকেনি তারা। নির্বাচনের বিরোধিতাও করে যাচ্ছে এবং ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এটা মোকাবিলা করতে নির্বাচন কমিশন সিরিয়াসলি কাজ করে যাচ্ছে।’

পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সাথে সকাল ৬টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসারের নিকট ব্যালট পেপার হস্তান্তর করা হবে / ছবি- সংগৃহীত

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সকাল বেলা কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার পাঠানোও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। কারণ, যেদিন নির্বাচন হবে সেদিন প্রচুর শীত থাকবে। শীতের সময় গ্রামের রাস্তাগুলোতে বড় বড় গাছ থাকে। সে কারণে কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে এলাকা। কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তায় সকাল বেলা নির্বাচনী মালামাল নিয়ে যাওয়া চ্যালেঞ্জ। অনেক এলাকা আছে উপজেলা থেকে ১০ থেকে ২০ মাইল দূরে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে ভালোভাবে হিসাব করতে হবে।’

‘আমার মতে, যেসব কেন্দ্রে সকালে ব্যালট পেপার পাঠানো যাবেন না সেসব জায়গার ঝুঁকি না নেওয়াই ভালো। তবে, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় নির্বাচন কমিশন সুবিধা পাবে। পার্বত্য জেলাগুলোতে এবং চরাঞ্চলে মালামাল পাঠানো কষ্ট হবে। আর নির্বাচনের দিন যদি বিরোধী দলের অবরোধ থাকে, তাহলে সহিংসতা হতে পারে। এজন্য এটিও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলে আমার কাছে মনে হয়। আমার বিশ্বাস, বিষয়গুলো বিবেচনায় নেবে কমিশন।’

‘আমরা জানি, জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কমিশন প্রচার-প্রচারণায় যাচ্ছে, ভোটারদের আশ্বস্ত করে যাচ্ছে। এ ছাড়া, মোবাইল ও টেলিভিশনে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে। পাশাপাশি প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। এগুলো কমিশনকে মোকাবিলা করতে হবে।’

ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে বলে মনে করেন— এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এ সিইসি বলেন, ‘আগের থেকে এবার ভোটার উপস্থিতি কম হবে। কারণ, বড় একটা রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যাচ্ছে না। তাই তাদের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ভোট দিতে যাবে না। এ হিসাবে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশি। সেক্ষেত্রে তারা ভোটার নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। সব প্রার্থী ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারলে ভোটার উপস্থিতি খারাপও হবে না। আমার হিসাবে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট পড়তে পারে। এবার অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হতে পারেন।’

সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা / ছবি- সংগৃহীত

বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। দলটিকে নির্বাচনে আনতে না পারা কি বর্তমান কমিশনের ব্যর্থতা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। এ দেশের নির্বাচন কমিশন কখনই রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থায় থাকে না। যারা পরাজিত হন, তারা কমিশনের কঠোর সমালোচনা করেন। যারা জিতে যান তাদের আবার কোনো কথা থাকে না। আমাদের সময় একটা প্রেক্ষাপট ছিল, ফলে সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল।’

‘বাংলাদেশের প্রত্যেকটা নির্বাচনের প্রেক্ষাপটই আলাদা আলাদা ছিল। কাজেই আমাদের কমিশন সফল ছিল আবার বর্তমান কমিশন ব্যর্থ হয়েছে, এটা বলা ঠিক হবে না। মূলত, কমিশন কোনো রাজনৈতিক দলকেই খুশি করতে পারে না। বর্তমান নির্বাচন বাস্তবতার ভিত্তিতে হচ্ছে। এখানে অনেক দল অংশগ্রহণ করছে না বিধায় বর্তমান কমিশনকে দোষারোপ করা যাবে না।’

এদিকে, রাজনৈতিক সংকটের মধ্যেই নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এ সুযোগে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত হয়েও ভোটের লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন পদধারী নেতা, সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্যরা। নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর শক্তিশালী প্রার্থী না থাকায় বেশির ভাগ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছেন আওয়ামী লীগেরই মনোনীত ও মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্ররা। এ অবস্থায় দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন ওই সব আসনের নেতাকর্মীরা। ভোটের লড়াইয়ে কেউ কাউকে ছাড়ও দিচ্ছেন না। আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে এবং এটা আরও প্রকট হতে পারে— মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

তবে, নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র কিংবা অন্য যেকোনো দলের প্রার্থীকে ছাড় দিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। আচরণবিধি ভঙ্গ করায় প্রার্থীদের শোকজ, তলব ও মামলা করার সিদ্ধান্তও দিয়েছে আউয়াল কমিশন। সর্বশেষ এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেছে কমিশন। বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় নির্বাচনে এর আগে কোনো প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেনি ইসি। এবার আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে লক্ষ্মীপুর-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান পবনের প্রার্থিতা বাতিল করে নজির স্থাপন করেছে ইসি।

অভিযোগ রয়েছে, অনেক প্রার্থী বারবার আচরণবিধি ভঙ্গ করলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখিয়েছে কমিশন। 

দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে ব্যালট বাক্স ও পেপার হস্তান্তরের কাজ / ফাইল ছবি 

ইসি জানায়, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে থাকবে বিভিন্ন বাহিনীর প্রায় সাড়ে সাত লাখ সদস্য। এর মধ্যে আনসার পাঁচ লাখ ১৬ হাজার, পুলিশ (র‌্যাবসহ) এক লাখ ৮২ হাজার ৯১ জন, কোস্ট-গার্ডের দুই হাজার ৩৫৫ ও বিজিবির ৪৬ হাজার ৮৭৬ সদস্য নিয়োজিত থাকবে। অন্যদিকে, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে গত ৩ ডিসেম্বর থেকে মাঠে নেমেছে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ভোট অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে এরই মধ্যে বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার, ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি, এসআইসহ সারা দেশের পুলিশ ও প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদলও করেছে ইসি। শুক্রবার থেকে মাঠে নেমেছেন সাড়ে ৬০০ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট।

এদিকে, শুক্রবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরা-১ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ফিরোজ আহম্মেদ স্বপনের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ দিয়েছে ইসি। ইসির আইন শাখার উপসচিব মো. আব্দুছ সালাম নির্দেশনাটি পাঠান। সেখানে কলারোয়া উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মামলা রুজু করার জন্য। 
 
এসআর/এসকেডি