◑ কর্মব্যস্ততা নেই প্রেসপাড়ায়
◑ ভার্চুয়াল প্রচারে ঝুঁকছে সবাই

নির্বাচন মানে রাস্তা দুই পাশ থেকে অলিগলি সব জায়গায় পোস্টারে ছেয়ে যাওয়া। জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে তো কথাই নেই। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পোস্টারের সেই রমরমা ব্যবস্থা আর নেই। একজন প্রার্থী কত পোস্টার ছাপাতে পারবেন তা নির্ধারণ করা না থাকলেও এবার প্রার্থীরা অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে কম পোস্টার ছাপিয়েছেন। বিরোধী দল না থাকায় প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন না হওয়ায় পোস্টারের কদর কমেছে। এ ছাড়া, কাগজ-কালির দাম বেড়ে যাওয়া, ভার্চুয়াল ও ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচারণা বেশি হওয়ায় পোস্টারের চাহিদা কমেছে। 

প্রেসমালিক, প্রার্থী ও তাদের প্রচার সেলের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দ হওয়ার পর প্রার্থীরা প্রচারণা শুরু করেন। প্রচারে নামতে একজন প্রার্থীর পোস্টার, ব্যানার, লিফলেট ছাপাতে হয়। ভোটারদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পোস্টার, লিফলেট ছাপাতে রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয় প্রেসপাড়ায়। কিন্তু এবার সেই চিরাচরিত উৎসবমুখর নির্বাচনী আমেজ দেখা যায়নি ছাপাখানাগুলোতে। বিরোধী দলের নির্বাচনে না আসা মূলত প্রার্থীদের প্রচারের প্রতি আগ্রহ কম। এ ছাড়া, প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে গুরুত্ব দেওয়ায় কমেছে পোস্টার ছাপার কাজ।

রাজধানীর কয়েকটি নির্বাচনী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে অন্যান্য প্রার্থীর পোস্টার তেমন চোখে পড়েনি। প্রেসমালিকরা জানান, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে একজন কমিশনার পাঁচ থেকে ছয় লাখ পোস্টার ছাপান। কিন্তু ঢাকায় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীরা সর্বোচ্চ ছয় লাখ পোস্টার ছাপানোর অর্ডার করেছেন।

এবার সেই চিরাচরিত উৎসবমুখর নির্বাচনী আমেজ দেখা যায়নি ছাপাখানাগুলোতে। বিরোধী দলের নির্বাচনে না আসা মূলত প্রার্থীদের প্রচারের প্রতি আগ্রহ কম। এ ছাড়া, প্রচারণার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে গুরুত্ব দেওয়ায় কমেছে পোস্টার ছাপার কাজ

রাজধানীর ফকিরাপুল শৈল্পিক প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী মো. জাহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রেসে প্রেসে পোস্টার ছাপানো হিড়িক পড়ে। কিন্তু এবার সেই অবস্থা নেই। কাজ নেই বললেই চলে। কারণ হিসেবে তার ভাষ্য, নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল না থাকায় সরকারদলীয় প্রার্থীরা পোস্টার ছাপাতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। নির্বাচনটা উৎসবমুখর পরিবেশে হলে প্রচারে জোর দিতেন প্রার্থীরা। একপক্ষীয় নির্বাচনের কারণে প্রচারও জমছে না।

ফকিরাপুল মান্নান প্রিন্টিং প্রেসের মালিক আব্দুল মান্নান খান বলেন, গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের চিত্র তুলনা করলে এবার প্রার্থীর সংখ্যা বেশি। সে হিসাবে এবার পোস্টার বেশি ছাপানোর কথা। কিন্তু প্রেসে কোনো কাজ নেই বললেই চলে। যে-সব প্রার্থী আছেন বেশির ভাগই ডামি। এ কারণে তাদের প্রচারণায় আগ্রহ কম, পোস্টারও ছাপাচ্ছে না তারা। শুধু রাজধানী নয়, দেশের সব জায়গায় একই চিত্র বলে জানান মান্নান খান।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান তোফায়েল খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় নির্বাচনী উত্তাপ তেমন নেই। এর প্রভাব পড়েছে প্রচারণায়। প্রার্থীদের মধ্যে গা-ছাড়া একটা ভাব দেখা যাচ্ছে। এ কারণে নির্বাচনী পোস্টার কম ছাপাচ্ছেন তারা।

তিনি বলেন, শুধু পোস্টার নয় প্রার্থীরা লিফলেট, জীবনবৃত্তান্তও ছাপান। কেউ কেউ নিজ নিজ নির্বাচনী ইশতেহার ছাপিয়ে প্রচারণায় বিলি করেন। এবার এগুলো কম ছাপানো হচ্ছে।

বিভিন্ন প্রেসের মালিকরা জানান, রাজধানীর প্রার্থীদের পোস্টার সাধারণত তার নেতাকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ছাপিয়ে থাকেন। যেহেতু নির্বাচনে উত্তাপ নেই তাই তারাও কিছু পোস্টার ছাপিয়ে দায় সারছেন।

৩০০ কোটির টাকার বাজার এখন ১০০ কোটিতে

প্রেসমালিকরা জানান, ২০০৮ সালে সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়। এরপর ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে সব দল অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচন ছিল নিরুত্তাপ। ফলে, পোস্টারের বাজার সংকুচিত হয়েছে। মাঠের প্রচারণা এখন চলে গেছে ভার্চুয়াল জগতে। ২০০৮ সালে শুধু পোস্টারের বার্ষিক বাজার ছিল ৩০০ কোটি, সেই বাজার এখন ১০০ কোটি টাকায় নেমেছে।

বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনে টানা তিন মাস প্রেসপাড়ায় দম ফেলানোর সুযোগ ছিল না। একই নির্বাচন ২০২৩ সালে হচ্ছে। সেখানে প্রেসপাড়ায় কাজ নেই বললেই চলে।

২০০৮ সালে সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হয়। এরপর ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে সব দল অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচন ছিল নিরুত্তাপ। ফলে, পোস্টারের বাজার সংকুচিত হয়েছে। মাঠের প্রচারণা এখন চলে গেছে ভার্চুয়াল জগতে। ২০০৮ সালে শুধু পোস্টারের বার্ষিক বাজার ছিল ৩০০ কোটি, সেই বাজার এখন ১০০ কোটি টাকায় নেমেছে

তিনি বলেন, আগে শুধু পোস্টারের বার্ষিক বাজার ছিল ৩০০ কোটি টাকার মতো। এখন সেই বাজার ১০০ কোটি টাকার ঘরে নেমে এসেছে। এর প্রধান কারণ, প্রার্থীরা প্রচারের জন্য এখন পোস্টারের বিকল্প পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

মূল প্রচারণা সামাজিক মাধ্যমে

এক সময় নির্বাচন মানেই মিছিল, ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ও মাইকিং ছিল প্রচারণার মূল মাধ্যম। কিন্তু এক দশকে এ চিত্র পাল্টে গেছে। পোস্টার, ব্যানারের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে জোর প্রচারণা। পোস্টারের পরিবর্তে ডিজিটাল ব্যানার বা ডিজিটাল মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন প্রার্থীরা। নির্বাচনী এলাকায় অবস্থান করার ভোটারদের কাছে ফেসবুকের মাধ্যমে প্রার্থীর লিফলেট পৌঁছে যাচ্ছে। ইউটিউবেও চলছে প্রার্থীদের জোর প্রচারণা।

ঢাকা-১৭ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের প্রচার সেলের এক কর্মকর্তা জানান, এখন রাস্তার পোস্টার দেখে কেউ ভোট দেয় না। এ ছাড়া, এ এলাকা উচ্চবিত্ত, শিক্ষিত লোক বেশি। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সবচেয়ে বড় মাধ্যম ভার্চুয়ালি মেসেজ পৌঁছানো। সেজন্য আমরা ফেসবুক, ইউটিউব, ইমোতে প্রার্থীর লিফলেটের সঙ্গে তার নির্বাচনী বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি।

তিনি আরও জানান, ঢাকার গুলশান, বনানী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকাকে ১৫টি জোনে ভাগ করে ফেসবুকে বুস্ট করে আরাফাতের নির্বাচনী বার্তা পৌঁছে দিচ্ছি। এ ছাড়া, এ এলাকায় বসবাস করা ভোটারদের নম্বরে এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা দেওয়া হচ্ছে। মোট কথা, সরাসরি প্রচারের চেয়ে ভার্চুয়ালি প্রচারণায় জোর দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিমের প্রচারণার সঙ্গে যুক্ত শাহজালাল শামীম বলেন, ‘যত দূর জানি, এখন পর্যন্ত ঢাকা-৮ নির্বাচনী এলাকায় চার লাখের বেশি পোস্টার ঝুলানো হয়েছে। তবে, নির্বাচনে যদি বিএনপি আসতো পোস্টার হয়তো দ্বিগুণ ছাপাতে হতো।’

‘পোস্টারে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়। এ কারণে পোস্টার ব্যবহার করা না হয়, এমন একটা নির্দেশনা রয়েছে। তাই আমরা পোস্টার ব্যবহার না করে ডিজিটাল মাধ্যমে বেশি  প্রচারণা চালাচ্ছি।’

নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ ৩৯টি দল অংশ নিয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপিসহ অধিকাংশ দল বয়কট করায় মাত্র ১২টি দল অংশ নেয় এবং ১৫২ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেন। ওই বছরও ছাপাখানাগুলোতে কাজের চাপ তেমন ছিল না। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৮টি, ২০০১ সালে ৫৫টি এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৪২টি দল অংশ নেয়। তখন বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সব দলই নির্বাচনে অংশ নেয়।

এনএম/এমএআর/