ঢাকা-১০ আসন
প্রচারণায় এগিয়ে নৌকা ও লাঙ্গল, বাকিরা চলছেন ঢিমেতালে
◑ গণসংযোগে মনোযোগ নৌকার
◑ মাঠ চষে বেড়ানোর চেষ্টা জাপা প্রার্থীর
◑ আম, টেলিভিশন, ছড়ি চলছে ঢিমেতালে
◑ নিজেরাই বলছেন, সীমিত কার্যক্রম চালাচ্ছি
দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশজুড়ে বইছে নির্বাচনী হওয়া। প্রতীক বরাদ্দের পর থেকেই ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। চালাচ্ছেন গণসংযোগ। চাইছেন ভোট। তবে ঢাকা-১০ আসনে নৌকা ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর প্রচার-প্রচারণা একেবারে নেই বললেই চলে। বলতে গেলে, মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার গণসংযোগেই নির্বাচনের আমেজ তৈরি হয়েছে। এছাড়া পোস্টার, হ্যান্ডবিল এবং অন্যান্য প্রচারণা কার্যক্রমেও একক আধিপত্য বজায় রেখেছে নৌকা। অবশ্য বেশকিছু জায়গায় অবস্থান রয়েছে জাতীয় পার্টির। এমন প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ এলাকার সাধারণ মানুষজনও বলছেন, নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকেই নৌকা মনোনীত প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো দলের কোনো প্রার্থীই তাদের কাছে আসেননি।
বিজ্ঞাপন
মূলত, রাজধানীর ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, কলাবাগান, হাজারীবাগ এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১০ আসন। গুরুত্বপূর্ণ স্থান, স্থাপনা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, বিজনেস হাব, বঙ্গবন্ধুর বাড়িসহ বিভিন্ন কারণেই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
ঢাকা-১০ আসনে ভোটের লড়াইয়ে যারা
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-১০ আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচাই-বাছাই শেষে প্রতীক বরাদ্দ পেয়েছেন পাঁচজন। প্রতীক বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিরা হলেন- কে এম শামসুল আলম, ফেরদৌস আহমেদ, মো. বাহারানে সুলতান বাহার, শাহরিয়ার ইফতেখার এবং হাজি মো. শাহজাহান।
এরমধ্যে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) মনোনীত এমপি প্রার্থী কে এম শামসুল আলম আম মার্কা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত এমপি প্রার্থী চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ নৌকা মার্কা, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) মনোনীত এমপি প্রার্থী মো. বাহারানে সুলতান বাহার টেলিভিশন মার্কা, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট মনোনীত এমপি প্রার্থী শাহরিয়ার ইফতেখার ছড়ি মার্কা এবং জাতীয় পার্টি মনোনীত এমপি প্রার্থী হাজি মো. শাহজাহান লাঙ্গল মার্কা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন।
সরেজমিনে যেমন দেখা গেল নির্বাচনী মাঠ
ঢাকা-১০ আসনে পাঁচটি রাজনৈতিক দলের পাঁচজন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার টিকিট পেয়েছেন। নির্বাচনে ভোটগ্রহণে আর বেশিদিন বাকি না থাকলেও মাঠে নৌকা ও লাঙ্গল ছাড়া অন্যান্য এমপি প্রার্থীদের অনেকটাই নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে। পিছিয়ে আছেন প্রচার-প্রচারণাতেও। এমনকি অনেকেরই নেই কোনো পোস্টার, প্রচার-প্রচারণাপত্রও।অবশ্য কয়েকজন প্রার্থীও নির্বাচনী প্রচারণার বিষয়ে সীমিত কার্যক্রমের বিষয়টি অকপটে বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, ধানমন্ডি, জিগাতলা, হাজারীবাগসহ ঢাকা-১০ আসনের আওতাধীন এলাকার অধিকাংশ জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল সড়কেই ঝুলছে পোস্টারে। প্লাস্টিকের দড়িতে পোস্টার লাগিয়ে লম্বালম্বিভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে রাস্তার একপাশ থেকে অপরপাশ পর্যন্ত। এসব পোস্টারের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য প্রার্থী ফেরদৌস আহমেদের পোস্টারই প্রায় ৯০ শতাংশ। আর নিউমার্কেট ও ধানমন্ডির ঘুরে অন্যকোনো প্রার্থীর পোস্টার দেখা যায়নি।
সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট মনোনীত এমপি প্রার্থী শাহরিয়ার ইফতেখারের ছড়ি মার্কার বেশকিছু পোস্টার টানানো দেখা গেছে। তবে ‘দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গড়ি, সমঝোতার রাজনীতি পরিহার করি’ এবং ‘চলুন বদলে দেই সবকিছু’ লেখা এসব পোস্টারের সংখ্যা হাতেগোনার মতো। আবার ঝিগাতলা ও হাজারীবাগ এলাকায় জাতীয় পার্টি মনোনীত এমপি প্রার্থী হাজি মো. শাহজাহানের লাঙ্গল মার্কার পোস্টারও দেখা গেছে। রোববার বিকেলে ঝিগাতলা বাসস্ট্যান্ডে শাহজাহানের বেশকিছু পোস্টার মাটিতে পড়ে থাকতেও দেখা যায়।
এর বাইরে গণসংযোগ কিংবা মাঠে ময়দানে কাজ করার ক্ষেত্রেও নৌকার তুলনায় অন্য প্রার্থীদের সরব অবস্থান দেখা যায়নি। প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা-১০ আসনের আওতাধীন এলাকায় গণসংযোগে একক আধিপত্য ধরে রেখেছেন নৌকার ফেরদৌস আহমেদ। প্রতিদিনই ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা-১০ আসনের আওতাধীন বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাচ্ছেন তিনি। দিচ্ছেন বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি। টিভি পর্দার নন্দিত এ নায়ক পাচ্ছেন যথেষ্ট সাড়াও। চিত্রনায়ক ফেরদৌসকে দেখেই অধিকাংশ সড়কে তৈরি হয় জটলা। মানুষজন দাঁড়িয়ে যান ছবি কিংবা সেলফি তোলার জন্য। আবার বিভিন্ন ট্রাকে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে নৌকার প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে।
নৌকার পর প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন জাতীয় পার্টির মো. শাহজাহান। হাজারীবাগ, রায়েরবাজার এলাকায় পোস্টার টানানোসহ তিনি অংশ নিয়েছেন গণসংযোগেও। রোববার বিকেলে ট্রাক-পিকআপে চড়ে ঝিগাতলায় পথসভা এবং নির্বাচনী প্রচারণাও চালান তারা। আর বাকি প্রার্থীদের গণসংযোগ কিংবা নির্বাচনী প্রচারণা সাড়া ফেলতে পারেনি ভোটের মাঠে।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষ
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে ভোটের পরিবেশ এবং প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষজন। বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নির্বাচনে না আসা নিয়েও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই। আবার আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শহরে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে এমন মন্তব্যও করেন অনেকে।
নিউমার্কেট এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুরো শহরজুড়েই উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। মানুষজন ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। প্রচার-প্রচারণায় অন্যান্য প্রার্থীর চেয়ে নৌকার প্রার্থী এগিয়ে আছেন। অধিকাংশ দিনই আমরা নৌকার প্রার্থীকে এলাকায় দেখতে পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারাদেশে উন্নয়নের যে জোয়ার বইয়েছেন সেটি অব্যাহত রাখার জন্য নৌকার বিকল্প নেই। আমরা প্রত্যাশা করি বিপুল ভোটে ঢাকা-১০ আসনে ফেরদৌস আহমেদ জয়লাভ করবেন। এই আসনে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহিংসতা বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আমরা দেখিনি।
নজরুল ইসলাম নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, রাস্তাঘাটে নৌকার প্রার্থীর গণসংযোগ এবং প্রচার-প্রচারণা ছাড়া অন্য কিছু চোখে পড়েনি। আমাদের-১৮ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা ভোট চাইতে এসেছিলেন। অন্য কারো দেখা আমরা পাইনি।
নির্বাচন একতরফা হচ্ছে এমন কথাও বলেন অনেকেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাকরিজীবী বলেন, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। সরকার ঘোষণা দিয়ে ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করছে। এতে করে বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের যে গণতান্ত্রিক ধারা চলমান ছিল সেটি ব্যাহত হয়েছে। আসলে একতরফা নির্বাচনে মাধ্যমে সরকার গঠন করে দেশের উন্নয়নে খুব বড় ভূমিকা রাখা যায় না।
নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সুন্দর পরিবেশে ভোট গ্রহণসহ অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই একটি সহিংস পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সরকার বিরোধী যারা রয়েছেন তাদের অধিকাংশেরই স্বাভাবিক জীবনযাপন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় একটি সুন্দর নির্বাচন অসম্ভব।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে কোনো ধরনের অশান্তি তৈরি না হোক, তেমনটি প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।
নিজেদের অবস্থান নিয়ে যা বলছেন প্রার্থীরা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে প্রার্থীরা জনগণের কাছে যাওয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। গণসংযোগ ছাড়াও উঠান বৈঠক, পথসভায় মনোযোগ দিচ্ছেন তারা।
ঢাকা-১০ আসনের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত এমপি পদপ্রার্থী ফেরদৌস আহমেদ বলেন, নির্বাচনের মাঠে কাউকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ঢাকা-১০ আসন দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে এই আসন থেকে মনোনয়ন দিয়েছেন সেজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। উৎসবমুখর পরিবেশে নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আমরা নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। কাউকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। নির্বাচনকে ঘিরে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আচরণবিধি মেনে শেষ সময় পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাব। জয়ের বিকল্প কোনো কিছু নেই। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করার।
ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) মনোনীত এমপি প্রার্থী কে এম শামসুল আলম বলেন, আমরা সাধ্যমতো নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা তো রুলিং পার্টি (ক্ষমতাসীন) না। এত বেশি কিছু করার সুযোগ আমাদের নেই। তবে নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকব।
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ) মনোনীত এমপি প্রার্থী মো. বাহারানে সুলতান বাহার বলেন, আমার কার্যক্রম খুবই অল্প এবং সীমিত। তবে যথাসম্ভব মাঠে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তবে নির্বাচন ঘিরে নিজের গণসংযোগ ব্যাপারে সন্তোষ প্রকাশ করে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট মনোনীত এমপি প্রার্থী শাহরিয়ার ইফতেখার বলেন, আমি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাচ্ছি। তাদের সঙ্গে কথা বলছি। এরইমধ্যে অনেকগুলো উঠান বৈঠক করেছি। গণসংযোগের ব্যাপারে সন্তুষ্ট।
তবে এবিষয়ে কথা বলতে জাতীয় পার্টি মনোনীত এমপি প্রার্থী হাজি মো. শাহজাহানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
আরএইচটি/জেডএস