ঘটনাবহুল জনপ্রশাসন
নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন, চাকরিও হারিয়েছেন কেউ কেউ
নানা ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে শেষ হতে চলেছে আরও একটি বছর। বিদায়ী বছরটি (২০২৩ সাল) জনপ্রশাসনের জন্য ছিল ঘটনাবহুল। এ বছর নানা কারণে জনপ্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে পদ থেকে সরে যেতে হয়েছে। পদ হারানোর মধ্যে সিনিয়র সচিব থেকে শুরু করে রয়েছেন এসিল্যান্ডও।
কেউ নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে, কেউ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছেন। অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে কেউ কেউ চাকরিও হারিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে ওএসডি সিনিয়র সচিব
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব খাজা মিয়াকে গত জুলাইয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। গত ১১ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রণীত আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে ভোটের মাঠে নেমেছিলেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-১ আসন (নিজ এলাকা) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার ঘোষণা দিয়ে শুরু করেন নির্বাচনী প্রচার। অথচ তার চাকরির মেয়াদ ছিল আরও এক বছর।
আরও পড়ুন
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, অবসর গ্রহণের তিন বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা নির্বাচনের প্রার্থী হতে পারবেন না। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯-এর ২৫ (১) ধারায় (রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ) বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী কোনো রাজনৈতিক দলের বা রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গ-সংগঠনের সদস্য হতে অথবা অন্য কোনোভাবে যুক্ত হতে পারবেন না অথবা বাংলাদেশ বা বিদেশে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো প্রকারের সহায়তা করতে পারবেন না।’
অন্যদিকে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২-এর ১২ (১) (চ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগের কোনো চাকরি থেকে পদত্যাগ করেছেন বা অবসর গ্রহণ করেছেন এবং উক্ত পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণের পর তিন বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে অর্থাৎ অবসর বা পদত্যাগের পর তিন বছর শেষ না হলে কোনো সরকারি চাকরিজীবী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।’
আরও পড়ুন
অথচ তিনি জেনেও এসব বিধিবিধান অমান্য করেছেন। চারিদিক থেকে সমালোচনা শুরু হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব খাজা মিয়াকে ওএসডি করা হয়।
‘সিন্ডিকেটে মন্ত্রীর হাত’ বক্তব্যে সরিয়ে দেওয়া হয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানকে
‘মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলনকারী সিন্ডিকেটের পেছনে একজন নারীমন্ত্রীর হাত রয়েছে’— এমন বক্তব্য দেওয়ার ২৪ দিন পর জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের অবশিষ্ট মেয়াদ বাতিল করে সরকার। গত ১৮ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘নদী দখলদারদের পেছনে রাজনৈতিক শক্তি আছে। মেঘনা নদী থেকে অবৈধভাবে যারা বালি উত্তোলন করছেন, তাদের সঙ্গে চাঁদপুরের একজন নারীমন্ত্রীর সম্পর্ক আছে।’
‘হায়েনারা দল বেঁধে মেঘনায় হামলে পড়েছে। মেঘনা থেকে আবার বালু তোলার চেষ্টা চলছে। এখানে শত শত ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হবে। এতে নদীর ক্ষতি হবে, মাছের ক্ষতি হবে, পরিবেশের ক্ষতি হবে। এদের থেকে নদীকে রক্ষা করা যাচ্ছে না।’ কারও নাম উল্লেখ না করে মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘চাঁদপুরের এক নারীমন্ত্রীর সঙ্গে এদের সম্পর্ক আছে।’
আরও পড়ুন
তিনি আরও বলেন, ‘ইজারা দেওয়ার নামে কর্ণফুলী নদী বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও জেলা পরিষদ জড়িত। সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। কর্ণফুলী নদী পরিবেশের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করে নদীর জমি খণ্ড খণ্ড করে মেরে ফেলা হচ্ছে।’
‘কৃষিবিদ’ হওয়ায় স্পারসো থেকে সরানো হয় আব্দুস সামাদকে
গত ২৩ আগস্ট চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান-৩ এর সফল অবতরণের মাধ্যমে ইতিহাস গড়ে ভারত। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর চতুর্থ দেশ হিসেবে এবং দক্ষিণ মেরুতে প্রথম দেশ হিসেবে মহাকাশযানের সফল অবতরণের মাধ্যমে ইতিহাস স্থান করে নেয় ইসরো।
ওই খবর আসার পরপরই আলোচনায় আসে বাংলাদেশের স্পারসো। ভারতের ওই সাফল্যের পেছনে সব অবদান দেশটির মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরোর। ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এস সোমনাথ একজন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার। আর বাংলাদেশের স্পারসোর চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ একজন ‘কৃষিবিদ’।
আরও পড়ুন
একজন কৃষিবিদ ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে এমন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান করায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এ আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে গত ৫ সেপ্টেম্বর আব্দুস সামাদকে সংসদ সচিবালয়ে বদলি করা হয়।
বিদ্যুৎ খাত নিয়ে প্রতিবেদন : অতিরিক্ত সচিব ও উপসচিব বরখাস্ত
বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন উপসচিবকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। অতিরিক্ত সচিব এস এম হামিদুল হক এবং উপসচিব মোহাম্মদ মাহিদুর রহমানকে গত জুলাইয়ে বরখাস্ত করা হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তৈরি এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হচ্ছে একটি ‘লুটেরা মডেল’। এ ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গত ১৪ বছরে ৯০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ডলার গচ্চা গেছে। ক্যাপাসিটি চার্জের বর্তমান মডেল কোনোভাবেই টেকসই নয়।
ওই প্রতিবেদন আইএমইডির ওয়েবসাইটে প্রকাশের পর এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হলে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়। পরে প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
আইএমইডির পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন সেক্টর-১ এর প্রধান, অতিরিক্ত সচিব হামিদুল হক এবং উপসচিব মাহিদুর রহমান ওই প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রতিবেদনটি ধরে সংবাদ প্রকাশের পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে ওই দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। ওএসডির দিনেই তাদের আইএমইডি থেকে অবমুক্ত করে সেখানে নতুন কর্মকর্তা পদায়ন করা হয়।
আরও পড়ুন
নারীর সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের’ ভিডিও ভাইরাল, ওএসডি যুগ্ম সচিব
এক নারীর সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের’ ভিডিও ছড়িয়ে পড়া নিয়ে আলোচিত যুগ্ম সচিব হাবিবুর রহমানকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। গত ২২ অক্টোবর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, ১৬ অক্টোবর বিকেল থেকে ভিডিওটি ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজে ভিডিওটি আপলোড হলে তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। ওই ঘটনায় প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সমালোচনা শুরু হয়।
২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বরগুনার ডিসি পদে যোগ দেন হাবিবুর রহমান। আড়াই বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০২৩ সালের ৯ জুলাই এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে সরিয়ে উপসচিব পদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে পদায়ন করা হয়। তিনি জেলা প্রশাসক মো. রফিকুল ইসলামের কাছে ৩০ জুলাই দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ৪ সেপ্টেম্বর উপসচিব পদ থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিও পান হাবিবুর রহমান। ২২ অক্টোবর তাকে ওএসডি করে সরকার।
আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চেয়ে প্রত্যাহার হলেন ডিসি
আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে ভোট চেয়ে গত সেপ্টেম্বরে সমালোচিত হন জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. ইমরান আহমেদ। ১১ সেপ্টেম্বর জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌরসভার নতুন ভবন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ইমরান আহমেদ বলেছিলেন, এ সরকার যে উন্নয়ন করেছে সেই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আবারও নির্বাচিত করে ক্ষমতায় আনতে হবে। এটা হবে আমাদের প্রত্যেকের অঙ্গীকার।
অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক বলেন, যোগদানের সময় শুনেছি, আমার নিজ জেলা খুলনা থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে একটা অনুন্নত জেলায় যাচ্ছি। কিন্তু যোগদানের পর দেখলাম সেই অনুন্নত জেলা পরিবর্তন করে দিয়েছেন আমাদের আজকের প্রিয় প্রধান অতিথি (সংসদ সদস্য মির্জা আজম)। এটাকে আধুনিক ও উন্নত জেলায় রূপান্তরিত করেছেন উনার দীর্ঘ কর্মজীবনে। আমরা তার জন্য একটা করতালি দিতে পারি। আমি আসলে এ জেলা নিয়ে স্টাডি (অধ্যয়ন) করে দেখেছি, এক সময় যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই নদ কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণ) করা যেত না। এ জেলা বন্যা ও নদী ভাঙন এবং দেশের তৃতীয় দরিদ্রতম জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই অবস্থা থেকে একজন মানুষ তার এক জীবনে অক্লান্ত পরিশ্রমে এ জায়গায় নিয়ে এসেছেন। তাকে কাছে থেকে না দেখলে এবং এ জেলায় না আসলে বুঝতে পারতাম না। আপনাদের সৌভাগ্য আপনারা এমন একজন নেতা পেয়েছেন।
তার এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন তার এমন বক্তব্য দেওয়া ‘ঠিক হয়নি’ বলে মন্তব্য করেন। বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জেরে ১৪ সেপ্টেম্বর তাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয় সরকার।
‘ঘুষ নির্ধারণ’ করে দেওয়ার ঘটনায় এসিল্যান্ড সাময়িক বরখাস্ত
‘ঘুষ নির্ধারণ’ করে দেওয়ার অভিযোগে পিরোজপুরের নাজিরপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মাসুদুর রহমানকে গত সেপ্টেম্বরে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে সরকার। এর আগে তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করা হয়।
অভিযোগ ওঠে, পিরোজপুরের নাজিরপুরে জমির নামজারি করার জন্য ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তারা ছয় হাজার টাকা ঘুষ নেবেন বলে নির্ধারণ করে দেন এসিল্যান্ড মাসুদুর রহমান। জুলাই মাসে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় কথোপকথনের একটি অডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ওই ঘুষ নেওয়ার কথা বলা হয়। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর সমালোচনা শুরু হয়।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তার সহকর্মীদের নামজারি মামলায় অবৈধ অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত নির্দেশনা প্রদানের অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসকের করা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি অডিও ক্লিপের কথোপকথনের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্তে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
এসএইচআর/এমএআর/