২০২২ সালের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আটজন তরুণ নিখোঁজ হন। তাদের পরিবার কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধারে কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামক নতুন এক জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব টের পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সংগঠনটির সক্রিয়তা যাচাই করতে গোয়েন্দা কার্যক্রমের ভিত্তিতে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পারে যে, সংগঠনটির সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।

শুরুতে জঙ্গিদের দুর্বল করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও র‌্যাব ডিজির মুখে স্বস্তির কথা শোনা গেলেও ১৩ মাস আগে ঢাকার আদালত চত্বর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গির সন্ধান এখনও মেলেনি। মেলেনি দুর্ধর্ষ ও চতুর জঙ্গিনেতা মেজর (অব.) জিয়ার সন্ধানও। তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারা নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো

এরপর নড়েচড়ে বসে এলিট ফোর্স র‍্যাব ও ডিএমপির সিটিটিসিসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। নতুন জঙ্গি সংগঠনটির শক্তি দুর্বলে শুরু হয় একের পর এক অভিযান। পাহাড় থেকে সমতল পর্যন্ত অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন সংগঠনটির আমির আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ, সামরিক শাখার প্রধান রনবীরসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা। পাহাড়ে অভিযানের পর সংগঠনটি কার্যত দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চলতি বছর সংগঠনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জঙ্গি সংগঠন’ আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

র‌্যাবের দেওয়া তথ্য মতে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে  জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৯৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত বছর ৪৬ জনকে, চলতি বছর ৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত র‌্যাবের অভিযানে হিজবুত তাহরীর দুই, জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) চার, আনসার আল ইসলামের ২১ এবং অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মূল ফটক থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি / ছবি- ঢাকা পোস্ট

অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) দেওয়া তথ্য মতে, চলতি বছর বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের মোট ৪৪ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের এ ইউনিট। এর মধ্যে হিজবুত তাহরীর নয়, জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আট, আনসার আল ইসলামের নয়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) পাঁচ, আল্লাহর দলের সাত, নব্য জেএমবির এক, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজিবি) এক, তাওহীদুল উলূহিয়্যাহর (আল-জিহাদী) চার সদস্য রয়েছেন।

জামায়াতুল আনসারের বিরুদ্ধে অভিযান না হলে হলি আর্টিজানের চেয়েও বড় নাশকতা হতে পারত বলে দাবি করেছিলেন র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন

অন্যদিকে, ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের তথ্য মতে, চলতি বছর ২৭ মামলায় ১১৮ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জামায়াতুল আনসারের ১৫ সদস্য।

জামায়াতুল আনসারের বিরুদ্ধে অভিযান না হলে হলি আর্টিজানের চেয়েও বড় নাশকতা হতে পারত বলে দাবি করেছিলেন র‌্যাব মহাপরিচালক (ডিজি) অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের শান্তি বিনষ্ট করতে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কতিপয় সদস্যকে একীভূত করে ২০১৯ সালে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া নামের নতুন জঙ্গি সংগঠন তৈরি করে। এ সংগঠনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল। সংগঠনের সদস্যরা কেএনএফ কর্তৃক প্রশিক্ষণ নিয়ে পরবর্তীতে নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, ‘জঙ্গিগোষ্ঠীর কিছু কিছু ঘুমন্ত সেল এখনও রয়ে গেছে। তারা আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করছে। জঙ্গি একেবারে নির্মূল করতে পারিনি, কিন্তু জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়াকে গত ৯ আগস্ট নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।’

র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার আনসার আল ইসলামের ছয় জঙ্গি সদস্য / ছবি- ঢাকা পোস্ট

শুরুতে জঙ্গিদের দুর্বল করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও র‌্যাব ডিজির মুখে স্বস্তির কথা শোনা গেলেও ১৩ মাস আগে ঢাকার আদালত চত্বর থেকে ছিনিয়ে নেওয়া দুই জঙ্গির সন্ধান এখনও মেলেনি। মেলেনি দুর্ধর্ষ ও চতুর জঙ্গিনেতা মেজর (অব.) জিয়ার সন্ধানও। তাদের গ্রেপ্তার করতে না পারা নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রথম জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে। এরপর বিভিন্ন সময় ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা হলেও সফল হয়নি জঙ্গিরা। ত্রিশালের নয় বছর পর দিন-দুপুরে ফিল্মি স্টাইলে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে খোদ রাজধানীতে।

২০২২ সালের ২০ নভেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালতপাড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালে শুনানি শেষে হাজতখানায় নেওয়ার পথে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের গেটের সামনে দায়িত্বরত পুলিশের চোখে স্প্রে করে দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় সহযোগীরা।

ওই ঘটনার পর এক জঙ্গির আত্মসমর্পণ এবং দুই দফায় পালাতে ব্যর্থ হওয়া ১০ জঙ্গিকে রিমান্ডে নেওয়া হলেও পালাতে সক্ষম দুই জঙ্গির সন্ধান মেলেনি। আতঙ্কের বিষয়, পালাতে সক্ষম দুজন ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগের আজিজ মার্কেটে জঙ্গিদের হাতে নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন ‘আল্লাহর দল’র পাঁচজন সদস্যকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) / ছবি- সংগৃহীত

পরবর্তীতে প্রশ্ন ওঠে, দুই আসামিসহ অন্য আসামিদের কেন ডান্ডাবেড়ি ছাড়া আদালতে নেওয়া হলো। বিভিন্ন দিক থেকে আসা সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত চত্বরের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। তবে, ১৩ মাসেও দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করতে না পারার বিষয়টি ‘অত্যন্ত আতঙ্কজনক’ বলে উল্লেখ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘১৩ মাসেও ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি আসামিকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় ঝুঁকি কিন্তু রয়ে গেছে। হয়তো দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে, গ্রেপ্তারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নাশকতার আতঙ্ক থেকেই যায়। সফল জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের মধ্যে এ ঘটনা অনেক বড় দুর্বলতা বলে পরিলক্ষিত হয়।’

যোগাযোগ করা হলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক আবদুর রব খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের প্রস্তুতির অভাব ছিল। সেটা যদি এখন ঠিক হয়েও যায়, তারপরও ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গি গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত অস্বস্তি থেকে যায়। এ ছাড়া, নিরাপত্তা উদ্বেগ ও নাশকতার একটা শঙ্কা থাকে। শুনেছি, রেড অ্যালার্টও জারি করা হয়েছিল, কিন্তু এখনও ধরা না পড়া অ্যালার্মিং।’

গ্রেপ্তার জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ / ছবি- সংগৃহীত 

ছিনতাই হওয়া জঙ্গিরা কোথায়— জানতে চাওয়া হলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নতুন জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল আনসার এখন অনেকটা দুর্বল। তাদের নিয়ে আমরা নিরাপত্তা শঙ্কা দেখছি না। তবে, ঢাকার আদালত চত্বর থেকে পালানো দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারে সবধরনের চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ ঢাকার সাভারে একটি অভিযান পরিচালনা করা হয়। সেখানে যেতে না যেতে তারা পালিয়ে যায়। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’

জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনতাই হওয়া দুই জঙ্গিকে পুনরায় গ্রেপ্তারে র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।

জেইউ/এমজে/এমএআর/