সম্ভাবনা জাগিয়েও হোঁচট খেল রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পাইলট প্রকল্পের আওতায় কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করার লক্ষ্য ছিল সরকারের। মিয়ানমারের দিক থেকেও ইতিবাচক সাড়া ছিল। প্রত্যাবাসনে গতি আনতে বন্ধু রাষ্ট্র চীনের দূতিয়ালিও ছিল চোখের পড়ার মতো। তবে, মিয়ানমারের বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠানের কারণে সেই সম্ভাবনা হোঁচট খেয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করাতে গেলে তা টেকসই হবে না। প্রত্যাবাসন শুরু করতে সব ধরনের প্রস্তুতি রেখেছে সরকার। সুযোগ পেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। তবে, কবে নাগাদ এটি শুরু হতে পারে সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারছেন না তারা।
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করাতে গেলে তা টেকসই হবে না। প্রত্যাবাসন শুরু করতে সব ধরনের প্রস্তুতি রেখেছে সরকার। সুযোগ পেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। তবে, কবে নাগাদ এটি শুরু হতে পারে সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, নির্বাচনের আগে প্রথম ধাপে কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করার লক্ষ্য ছিল। সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার কাজও করছিল। প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে এখনও কাজ চলমান। তবে, এক মাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা চলছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিছু লোক পাঠিয়ে দিলাম, দেখা গেল আবার ওখানকার পরিস্থিতির কারণে ফেরত চলে এলো। তাহলে তো লক্ষ্য অর্জন হলো না। হিসেব-নিকেশ করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে, প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে আমরা আশাবাদী।
আরও পড়ুন
ঢাকা ও ইয়াঙ্গুনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে নেপিদোতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মহাপরিচালকপর্যায়ে হওয়া বৈঠকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় শুরুতে প্রায় তিন হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে রাজি হয় মিয়ানমার। পরে যাচাই-বাছাই করে ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের নিতেও রাজি হয় নেপিদো।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, পাইলট প্রকল্পের আওতায় শুরুর ধাপে দুই হাজার আটশোর বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ঠিক করা হয়েছে। এ সংখ্যার সঙ্গে তাদের পরিবারের কিছু সদস্য যুক্ত হতে পারে। অর্থাৎ তিন হাজারের বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গাকে প্রথমে প্রত্যাবাসন করাতে চায় বাংলাদেশ। যদি প্রথম ধাপে সফলতা আসে তাহলে যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় থাকা রোহিঙ্গাদের পরবর্তী ধাপে প্রত্যাবাসন করানোর লক্ষ্য সরকারের।
প্রত্যাবাসনের শুরুতে রোহিঙ্গাদের মনোবল বাড়াতে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দুই দফায় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিরা কথা বলেন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে। আগ্রহী রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে রাজি আছেন বলে বার্তা দেন প্রতিনিধিদের।
চীনের মধ্যস্থতায় প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের চলমান কর্মযজ্ঞের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো থেকে বারবারই বলা হচ্ছে যে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে অনুকূল পরিবেশ এখনও হয়নি।
চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতার। তৃতীয় দফায় বাংলাদেশ সফরে তিনি এবারই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যান। সে সময় কক্সবাজারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আফরিন বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার মতো প্রতিকূল পরিবেশ এখনো মিয়ানমারে নেই।’
আরও পড়ুন
এ প্রসঙ্গে ঢাকার এক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, পশ্চিমারা তো সবসময় একই কথা বলে আসছে। তারা যা-ই বলুক, যদি স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা যায় তাদের কিছু বলার থাকবে না।
গত ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, মিয়ানমারে এখন কিছুটা অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। চীনের উদ্যোগে যে পাইলট প্রকল্প হয়েছিল, আমরা আশা করেছিলাম নির্বাচনের আগে বা ডিসেম্বরে কিছু একটা হবে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা তৈরি হলো। এর আগে অগ্রগতি বেশ ভালো ছিল। তবে, এখনও আমরা আশা করি, যেকোনো সময়ে রোহিঙ্গারা ফেরত যাবে।
‘অনেক প্রতিষ্ঠান চায় না তারা (রোহিঙ্গারা) ফেরত যাক। এটি একটি সমস্যা। কিছু বিদেশি শক্তি আমাদের বলছে যে, ওখানে এখন তাদের পাঠাবেন না।’
অক্টোবরের শেষের দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচ বছরের অর্জিত সাফল্য নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছিলেন, কূটনীতিতে যদি সীমাবদ্ধতা বলেন তাহলে সামনে আসবে রোহিঙ্গা সমস্যা এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দেশে ফেরানোর বিষয়টি। রোহিঙ্গা সমস্যাটি খুব জটিল। তবে, আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, পাইলট প্রকল্পের আওতায় শুরুর ধাপে দুই হাজার আটশোর বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ঠিক করা হয়েছে। এ সংখ্যার সঙ্গে তাদের পরিবারের কিছু সদস্য যুক্ত হতে পারে। অর্থাৎ তিন হাজারের বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গাকে প্রথমে প্রত্যাবাসন করাতে চায় বাংলাদেশ। যদি প্রথম ধাপে সফলতা আসে তাহলে যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় থাকা রোহিঙ্গাদের পরবর্তী ধাপে প্রত্যাবাসন করানোর লক্ষ্য সরকারের
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনের ভূমিকায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।
২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। ওই সময় রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা জানায় রোহিঙ্গারা। ফিরে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা। ফলে ছয় বছরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আরও পড়ুন
চলতি বছর নতুন করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে উদ্যোগ নেয় চীন। এরই অংশ হিসেবে এপ্রিলের মাঝামাঝি কুনমিংয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে বৈঠক করে দেশটি। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, রোহিঙ্গাদের একটি দল নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রাখাইন সফর করবেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত ৫ মে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা রাখাইন সফর করেন। ফিরতি সফরে রোহিঙ্গাদের মনোবল বাড়াতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে তাদের প্রতিনিধিদল পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে সেটি পিছিয়ে দেয় মিয়ানমার। পরবর্তীতে ২৫ মে ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজার ঘুরে যায়।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে নেপিদোতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম দফায় প্রায় তিন হাজারের কিছু বেশি রোহিঙ্গা দিয়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে রাজি হয় মিয়ানমার। শুধু তা-ই নয়, রোহিঙ্গাদের মনোবল বাড়াতে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, মিয়ানমারের আরেকটি প্রতিনিধিদল কক্সবাজার সফর করবে।
আরও পড়ুন
উভয় পক্ষের সম্মতিতে অক্টোবর মাসের শেষের দিকে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের কক্সবাজার আসার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। তবে, হঠাৎ করে ঘূর্ণিঝড় হামুনের ধাক্কায় তা স্থগিত হয়। নভেম্বরের শুরুতে মিয়ানমার থেকে ২৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল কক্সবাজার সফর করেন। প্রতিনিধিদল কক্সবাজার ঘুরে যাওয়ার পরপরই মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এ ছাড়া, প্রতি বছর নতুন করে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে।
এনআই/এসকেডি/এমএআর/