বছরজুড়ে রাজধানীতে ছিল মশার উপদ্রব। দিন নেই, রাত নেই; ঘরে কিংবা বাইরে; বাসা কিংবা অফিসে— সব জায়গায় ছিল মশার তাণ্ডব। সাধারণত গ্রীষ্মকালে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকলেও এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী ও মৃতের সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি দেখা গেছে।

শীতে আবার কিউলেক্স মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ নগরবাসী। মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) নানা উদ্যোগ নিলেও তা কাজে আসেনি। অপ্রতিরোধ্য মশার কাছে অনেকটা আত্মসমর্পণ করেছে ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ।

মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে শুধু রাত নয়, দিনেও কয়েল জ্বালিয়ে এবং মশারি টাঙিয়ে থাকতে হয়েছে। এ ছাড়া, ওষুধ বা স্প্রে; কিছুতেই ঠেকানো যায়নি মশার উপদ্রব। যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশা নিধনে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা, যন্ত্রপাতি কেনা, ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারকাজে এ টাকা ব্যয় করার কথা।

ঘোষিত ১৬৮ কোটি টাকার মধ্যে ডিএনসিসির মশা নিধনে ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণে মশা নিধনে বরাদ্দ কম রাখা হয়। ডিএসসিসি চলতি অর্থবছরে মশা মারতে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখে। এর মধ্যে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কেনার কথা। বাকি আট কোটি ২৫ লাখ টাকা যন্ত্রপাতি কেনা ও পরিবহন খাতে ব্যয় করার কথা।

এভাবে প্রতি বছরে শত কোটি টাকা খরচ করেও রাজধানীবাসীকে মশার কবল থেকে মুক্তি দিতে পারছে না দুই সিটি কর্পোরেশন। নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও সবকিছু ব্যর্থ করে দিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে বিস্তার হচ্ছে এডিস মশার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জানুয়ারি থেকে চলতি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেশে মোট তিন লাখ ১৮ হাজার ৯৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে এক হাজার ৬৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৯৪ হাজার ৪৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ৯৬৮ জনের।

১৬৮ কোটি টাকার মধ্যে ডিএনসিসির মশা নিধনে ১২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা ছিল। উত্তরের তুলনায় দক্ষিণে মশা নিধনে বরাদ্দ কম রাখা হয়। ডিএসসিসি চলতি অর্থবছরে মশা মারতে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখে। এর মধ্যে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কেনার কথা। বাকি আট কোটি ২৫ লাখ টাকা যন্ত্রপাতি কেনা ও পরিবহন খাতে ব্যয় করার কথা

দেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন পাঁচ হাজার ৫৫১ জন, মারা যান ৯৩ জন। সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয় ২০১৯ সালে। ওই বছর এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন আক্রান্ত হন, মারা যান ১৬৪ জন। ২০২২ সালে আক্রান্ত হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং মারা যান ২৮১ জন। চলতি বছর (২০২৩ সাল) ডেঙ্গু শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যায় আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।

বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা আর শুষ্ক মৌসুমে ধুলার দুর্ভোগ; সঙ্গে বছরজুড়ে যানজটের ভোগান্তি রাজধানীবাসীর যেন নিত্যসঙ্গী। এসব ভোগান্তির সঙ্গে মশার উপদ্রবে রীতিমতো অতিষ্ঠ নগরবাসী। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নানা উদ্যোগ, অভিযানসহ নিত্যনতুন কার্যপরিচালনা করেও হার মানতে হচ্ছে মশার কাছে।

‘মশা মারতে কামান দাগা’—  প্রবাদের প্রচলন রয়েছে মানুষের মুখে মুখে। প্রবাদটির পুরোপুরি বাস্তবে রূপ না দিলেও, কাছাকাছি হেঁটেছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও কিছুতেই কিছু হয়নি ‘মশা’ নামক ক্ষুদ্র প্রাণিটির। কামান না হলেও মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করে ডিএনসিসি। কাজের কাজ—  ‘শূন্য’ বলা যায়।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন যখন ড্রোন ব্যবহারের সার্বিক দিক নিয়ে আরও বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মশা মারতে সনাতনী পদ্ধতি বেছে নেয়। মশা মারতে তারা খাল, নালা, ড্রেনসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ে। ওই সময় ডিএসসিসি জানায়, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য কাজে লাগিয়ে ব্যাঙগুলো পানিতে ভাসতে থাকা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে। সে লক্ষ্যে ছাড়া হয়েছিল হাঁসও। ধারণা করা হয়েছিল, ওইসব স্থানে মশা আর বংশবিস্তার করতে পারবে না। এ ছাড়া, জিঙ্গেল বাজিয়েও মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে তারা। অথচ দুই সিটির সব উদ্যোগই ভেস্তে যায়।

মশক নিধনে উত্তর সিটির ব্যয়

মশা মারার পেছনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের চলতি অর্থবছরের খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডিএনসিসির এবারের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মধ্যে মশা নিধনকাজ পরিচালনার জন্য ৮৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। এর মধ্যে মশার ওষুধ কেনার পেছনে ব্যয় হয় ৪৫ কোটি টাকা। ৩০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয় বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োজিত মশককর্মীদের দিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায়।

জানুয়ারি থেকে চলতি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত দেশে মোট তিন লাখ ১৮ হাজার ৯৮২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এ সময়ে এক হাজার ৬৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ৯৪ হাজার ৪৮ জন, মৃত্যু হয়েছে ৯৬৮ জনের

এ ছাড়া মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। ৭ দশমিক ৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয় ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারণায়। সবমিলিয়ে যা ১২১ দশমিক ৮৪ কোটি টাকায় ঠেকে।

মশক নিধনে দক্ষিণ সিটির ব্যয়

মশা মারতে চলতি অর্থবছরে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কেনা হয়। বাকি আট কোটি ২৫ লাখ টাকা যন্ত্রপাতি কেনা এবং পরিবহন খাতে ব্যয় দেখানো হয়। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) এ খাতে সংস্থাটি খরচ করে প্রায় ৩১ কোটি টাকা।

ডিএসসিসির খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সংস্থাটি এবার মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কেনায় ব্যয় দেখাচ্ছে ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এ খাতে গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ছিল ২৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এ ছাড়া, ফগার, হুইল, স্প্রে-মেশিন ও পরিবহনে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যা ছিল এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা। মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতির পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা গত অর্থবছরের ছিল তিন লাখ টাকা। সবমিলিয়ে মশার সঙ্গে যুদ্ধে মোট ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয় দেখাচ্ছে ডিএসসিসি।

কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যয়েও নেই সফলতা, রাজধানীবাসীর ক্ষোভ

এত টাকা খরচ করেও সিটি কর্পোরেশন নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ। রাজধানীর মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা খাদিজা খাতুন বলেন, পুরো বছর কেটেছে মশার যন্ত্রণায়। বাসায় ছোট বাচ্চা থাকার কারণে দিন-রাত সবসময়ই মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয়েছে। সারা বছর মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের কথা শুধু গণমাধ্যমে শুনি, বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বছরের পুরো সময়ই মশা জ্বালিয়েছে আমাদের।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন যখন ড্রোন ব্যবহারের সার্বিক দিক নিয়ে আরও বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, তখন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন মশা মারতে সনাতনী পদ্ধতি বেছে নেয়। মশা মারতে তারা খাল, নালা, ড্রেনসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ে। ওই সময় ডিএসসিসি জানায়, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য কাজে লাগিয়ে ব্যাঙগুলো পানিতে ভাসতে থাকা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে। সে লক্ষ্যে ছাড়া হয়েছিল হাঁসও। অথচ দুই সিটির সব উদ্যোগই ভেস্তে যায়

আজিমপুরের বাসিন্দা মোবারক হোসেন বলেন, বছরের পুরো সময়ই দেখা গেছে মশার উপদ্রব। মশার শব্দ শোনার পাশাপাশি কামড় খেতে হয়েছে আমাদের। আমার পাঁচতলা একটি বাসা আছে, সেখানে ১৩টি পরিবার থাকে। এসব পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সারা বছর আমরা ভয়ে ছিলাম ডেঙ্গু নিয়ে, এখন শুরু হয়েছে কিউলেক্স মশার যন্ত্রণা। দিন-রাত সবসময় বাসা বাড়িতে মশারি টাঙিয়ে রাখে সবাই। শুনছি, মশা নিয়ন্ত্রণে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিটি কর্পোরেশন। অথচ কাজের কাজ কিছুই হয় না।

যা বলছে দুই সিটি কর্পোরেশন

সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, শুষ্ক মৌসুমে কিউলেক্স মশার উৎপাত বেড়ে যায়। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য মেয়রের নির্দেশে খাল, ডোবা ও জলাশয়ের মালিক সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি হলেও আমরা ডিএনসিসি থেকে পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

‘এদিকে, শুষ্ক মৌসুম শুরু হলেও এখনও ডেঙ্গুর প্রকোপ রয়েছে। তা-ই শুধু কিউলেক্স মশা নয়, এডিস মশা নিধনেও সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। বাসাবাড়ির আশপাশ পরিষ্কার রাখাসহ কোথাও যেন পানি জমে না থাকে এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। সবার চেষ্টায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ বা মশার উপদ্রব রোধ করা সম্ভব হবে। সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে এগুলোর নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।’

তিনি আরও বলেন, মশক নিধনে আমরা আমাদের জায়গা থেকে কাজ করে যাচ্ছি। তবে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জনসম্পৃক্ততা। আমরা আমাদের জায়গা থেকে শুধু কাজ করে গেলে হবে না, এজন্য সবাইকে সচেতন হয়ে নিজ নিজ আঙ্গিনাসহ আওতাধীন জায়গায় মশার বংশবিস্তার যেন না হয় সেজন্য উদ্যোগ নিতে হবে।

মশক নিয়ন্ত্রণে বাস্তব পদক্ষেপ কী— জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, মশক নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সিটি কর্পোরেশনকে দীর্ঘমেয়াদি এবং বছরজুড়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে নিয়মিত কাজ করতে হবে। সেজন্য মশার হটস্পট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি প্রজননস্থল ধ্বংস করার কার্যক্রম নিতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থাকতে হবে দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা।

‘এ ছাড়া, সাধারণ মানুষকে এসব উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ঢেলে সাজাতে হবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে। তাহলে দীর্ঘমেয়াদি সফলতা আসবে।’

এএসএস/এসকেডি/এমএআর/