রাত পেরোলেই রাজনৈতিক মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধের একমাস পূর্ণ হবে। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ-বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের পর থেকে তালাবদ্ধ রয়েছে কার্যালয়টি। গত দেড় দশকের মধ্যে এতো দীর্ঘসময় কখনো এটি বন্ধ ছিল না। কবে এই কার্যালয় খোলা হবে এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফেরা যাবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না বিএনপি নেতারা।

বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১/১১ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত সাব-জেলে ৩৭২ দিন কাটানোর পর ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান খালেদা জিয়া। তখন এই পুরোটা সময় গ্রেপ্তার আতঙ্কে বন্ধ ছিল বিএনপি কার্যালয়। এরপর আর কখনো এতো দীর্ঘসময় বন্ধ ছিল না কার্যালয়টি।

২০০৯ সালের পর কয়েকবার বিএনপির অফিসে পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। এসব তল্লাশির পর ১-২ দিন করে কখনো কখনো বিএনপির কার্যালয় বন্ধ ছিল। সবশেষ ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর পুলিশ বিএনপির কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে ভাঙচুর করে এবং দলের প্রায় ৫ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। সেসময় ৪ দিন কার্যালয়টি বন্ধ করে রেখেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

নেতারা আরও বলছেন, ২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষের পর সেদিন রাত ৮টা থেকে গত একমাস কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। কারণ এবারের পরিস্থিতি একেবারে ভিন্ন। বিএনপির এমন কোনো কেন্দ্রীয় নেতা নেই যার নামে মামলা হয়নি। প্রতিদিন নেতাকর্মীদের বাসা-বাড়িতে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নেতাদের না পেয়ে পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ অবস্থায় গ্রেপ্তার আতঙ্কে নেতারা আত্মগোপনে আছেন।

কার্যালয়ের তালা খোলার প্রসঙ্গে তারা বলেন, দেশের বিদ্যমান যে পরিস্থিতি তাতে কবে কার্যালয় খোলা হবে, বলা সম্ভব নয়। তবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে কীভাবে স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফেরা যায়, তা নিয়ে দলের শীর্ষ মহলে চলছে আলাপ-আলোচনা।

বিএনপির মিডিয়া সেলের অন্যতম সদস্য শায়রুল কবির খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক মাস ধরে বিএনপি নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় অফিস বন্ধ। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারাগারে। দলের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এমন কোনো নেতা নেই, যাদের নামে মামলা নেই। প্রতিদিন সারা দেশে কয়েক শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হচ্ছে।

ধুলোর আস্তরণ জমে তালাবদ্ধ কার্যালয়ের মধ্যে পড়েছিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে আসা ইসির চিঠি

তিনি আরও বলেন, এক-এগারো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দীর্ঘদিন আমাদের অফিস বন্ধ ছিল। পরে দেশনেত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে শহীদ জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত করে অফিসে গিয়েছিলেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান দাবি করেন, একমাস ধরে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও বিকল্প পন্থায় তা চলছে।

তিনি আরও বলেন, শুধু তো স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, আর অনেক কিছুই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের নেতাকর্মীরা বাসা-বাড়িতে থাকতে পারছে না। তাদের পরিবারও স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারছে না। অনেক কিছুই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সিলেট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, সরকার আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। তারা (সরকার) বলছে অফিস খুলতে সমস্যা নেই। কিন্তু গত ১৬ নভেম্বর কয়েকজন নেতাকর্মী গেলে তাদেরকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরও এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা-ভাবনা আছে।

আত্মগোপনে কেন্দ্রীয় নেতারা, হতাশ তৃণমূল

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আগে ও পরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, মোহাম্মদ শাহজানান, আলতাব হোসেন চৌধুরী, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ ১৫০ জনের অধিক কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর ২৮ অক্টোবরের পর থেকে সারা দেশে ১৭ হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, ৫০১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির ১৫০ জনের মতো নেতা কারাগারে। এর বাইরে ৫০ জনের মতো নেতার কেউ মারা গেছেন, কেউ অসুস্থ আছেন। কয়েকজন বিদেশে আছেন। কিন্তু দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান সুস্থ আছেন এবং এখন কারাগারের বাইরে আছেন। এ ছাড়া বাকি কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা মহানগরের আব্দুস সালামসহ অন্য নেতারা তো বাইরে আছেন। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর অনুষ্ঠিত হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে তাদের দেখা যায়নি।

তারা আরও বলেন, হরতাল-অবরোধের মধ্যে বিভিন্ন সময় ঝটিকা মিছিল করতে দেখা গেছে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন সদস্যকে। বাকিরা সবাই আত্মগোপনে চলে গেছেন। অথচ এসব নেতারা বিভিন্ন সময় সভা-সমাবেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়েছেন, গুলি এলে বুক পেতে নেওয়ার মতো বক্তব্য দিয়েছেন। আর এখন মাঠ ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আর প্রতিদিন সারা দেশে কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে শত-শত নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এর বাইরে আগামী দিনের দলের কর্মপরিকল্পনা কি সেটাও স্পষ্ট নয় তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে। সব মিলিয়ে দিন-দিন হতাশ হয়ে পড়ছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে থাকলে আন্দোলন কতদূর চালিয়ে নেওয়া সম্ভব— জানতে চাইলে সেলিমা রহমান বলেন, এবার আন্দোলন করছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ও সাধারণ মানুষ। আর আপনারা জানেন দলের মহাসচিবসহ কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ নেতা কারাগারে। এ অবস্থায় পরবর্তী পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে আলোচনা চলছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বিএনপির এক নেতা বলেন, কেন্দ্র থেকে কর্মসূচি ঘোষণা হচ্ছে, আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী পালন করে যাচ্ছি। কিন্তু এরপর কি হবে, দলের পরিকল্পনা কী, বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি, তার কিছুই আমরা জানি না। যার ফলে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের হতাশ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দলের বিভিন্ন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হচ্ছে— আমাদের কর্মসূচিগুলো জনসম্পৃক্ততা করে এগিয়ে নেওয়ার। কর্মসূচির ধরণ পরিবর্তনের আলোচনা চলছে। তবে সিদ্ধান্তগুলো এখনও আমাদের কাছে আসেনি।

তাকিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিকদের দিকে

গত বেশ কয়েক বছর ধরে সব দলের অংশগ্রহণে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা কূটনীতিকরা।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারত-চীন ও রাশিয়ার অবস্থান আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তারা এই বর্তমান সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বগুলো যে অবস্থান নিয়েছে তা থেকে সরে আসছে বলে এমন বার্তা নেই বিএনপির কাছে। তাই এখনই বিএনপি হাল ছেড়ে দিচ্ছে না। অনেক কিছু হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলেও মনে করছেন তারা।

নেতারা আরও দাবি করেন, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে বিএনপি। যদিও এই সময়ে দলের কয়েকজন নেতা যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। কিন্তু কূটনীতিকরা তো সবকিছু করে দেবে না।

কারণ, মাঠের কার্যক্রম তো দলকে পরিচালনা করতে হবে। তাই সিনিয়র নেতারা সক্রিয় না হলে দিন শেষে হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে বিএনপিকে, মনে করেন তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, বিদেশিরা তো আমাদের দেশে এসে নির্বাচন করে দেবে না। পশ্চিমা বিশ্বগুলো অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। অন্যদিকে ভারত-চীন সেটা বলছে না। তারা তাদের স্বার্থের কথা বলে যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে ভারতের যে দাদাগিরি, সেটা চলমান রাখতে হলে তো শেখ হাসিনাকে দরকার। সেই জন্য তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে কথা বলছে না। উল্টো শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তারা দেশের জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করছে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সব ঠিক না করে তো কিছু করা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, গত সপ্তাহে বিএনপির স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে দলের কার্যালয় খোলার একটা প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মনে করেন— এখনি কার্যালয় খোলার সময় হয়নি। এ ছাড়া স্বাভাবিক কর্মসূচিতে ফেরা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তবে ৩০ নভেম্বরের পর থেকে কর্মসূচির ধরন পরিবর্তন হবে। 

এএইচআর/এমজে