আইডিয়ালে ডায়েরি-ক্যালেন্ডার কেনাকাটায় ৩৬ লাখ টাকার দুর্নীতি
- বহিষ্কৃত সেই আতিকের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি
- ডায়েরি-ক্যালেন্ডার কেনাকাটায় ছয় ধরনের অনিয়ম
- অধিকতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ
রাজধানীর আলোচিত মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ডায়েরি-ক্যালেন্ডার ছাপানো নিয়ে ৩৬ লাখ টাকার দুর্নীতি হয়েছে। সরকারি এক তদন্তে ডায়েরি-ক্যালেন্ডার কেনাকাটায় অনিয়ম করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। সেই কেলেঙ্কারিতে নাম এসেছে সদ্য বহিষ্কৃত আলোচিত আতিকুর রহমানের নাম। ডায়েরি-ক্যালেন্ডার কেনাকাটায় ছয় ধরনের অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত কমিটি। অধিকতর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে।
জানা গেছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার তৈরির জন্য ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে দরপত্র আহ্বান করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দরপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর সর্বনিম্ন এবং শর্ত পূরণকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত হওয়ার কথা থাকলেও এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে দরপত্র মূল্যায়নের সঙ্গে জড়িতরা তাদের পরিচিত এবং কমিশনের নিশ্চয়তা দেওয়া প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করে।
বিজ্ঞাপন
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর তৎকালীন অধ্যক্ষ, আতিক ও সিনিয়র কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে অভিযোগ করেন একজন অভিভাবক। অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুই মন্ত্রণালয়ের দুজন সচিবের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়। কমিটি সম্প্রতি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের কপি ঢাকা পোস্টের কাছে এসেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে ৩৬ লাখ টাকা দুর্নীতির করার পাঁয়তারা হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। একই সঙ্গে মূল্যায়ন কমিটি মূল্যায়নের পুরো প্রক্রিয়া নিজেদের মতো করেছে। কমিটির দুজন সদস্য মারা গেলেও নতুন কমিটি না করে তদন্ত চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে তিন নম্বর দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়েছে। ক্রয় সংক্রান্ত সব কাগজপত্রে প্রতিষ্ঠানটির উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খানের স্বাক্ষর না থাকলেও অন্তরালে থেকে ক্রয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তার সরাসরি সম্পৃক্ততা থাকার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
আরও পড়ুন
স্কুলের সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি লিফট কেনাকাটায় দুর্নীতি, অবৈধ ভর্তি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক তদন্তে আতিকের নিয়োগ অবৈধ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আতিকের সম্পৃক্ততা পাওয়া প্রসঙ্গে স্কুলের একজন সিনিয়র শিক্ষক ঢাকা পোস্ট বলেন, তার বহিষ্কারের পর তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে লাভ কী? অবৈধ নিয়োগ, ভর্তি বাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো খাত নেই যেখানে আতিকের হাত ছিল না। তাকে শুধু বহিষ্কার নয়, তার বিরুদ্ধে অর্থ তছরুপের মামলা করা উচিত।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের ডায়েরি ও বর্ষপঞ্জি ক্রয়ে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। দুই খাতে সর্বনিম্ন দরদাতাদের কাজ দেওয়া হয়নি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য না হয়েও অধ্যক্ষের যোগসাজশে কলকাঠি নেড়েছেন প্রতিষ্ঠানটিতে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া উপসহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান। ক্রয় কমিটির তিন সদস্যের দুজন অনেক আগে মারা গেলেও নতুন কমিটি গঠন না করেই কাজ দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে কাজ দেওয়ায় এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৬ লাখ টাকা বাড়তি গুনতে হয়েছে। তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
যারা ছিলেন তদন্ত কমিটিতে
গভর্নিং বডির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বাবুল মিয়াকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন- প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক দেবাশিস কুমার দাস এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব পারভেজুর রহমান। গত ১৩জুলাই তদন্ত কমিটির সদস্যরা সরেজমিন প্রতিষ্ঠানে তদন্ত করে একটি রিপোর্ট জমা দেয়।
দরপত্রে যেভাবে কারসাজি করা হয়
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চলতি বছরের ডায়েরি ও বর্ষপঞ্জি ক্রয়ের জন্য গত বছরের ২০ আগস্ট পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সাতটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ডায়েরি সরবরাহ করার জন্য ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ৭১৪ টাকার সর্বোনিম্ন দরপত্র জমা দেয় ‘আবরণ প্রিন্টাসর্’। কিন্তু ৫১ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৬ টাকা দরপত্র জমা দেওয়া ‘ট্রাস্ট কালার প্রিন্ট ও অ্যাকসেসরিজ’-কে কাজ দেওয়া হয়। একইভাবে ক্যালেন্ডার সরবরাহ করার জন্য ২২ লাখ ছয় হাজার ৯০০টাকা সর্বনিম্ন দরপত্র জমা দেয় ‘জারা প্রিন্টার্স’। এ প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে চতুর্থ সর্বনিম্ন দরদাতা ‘মাস্টার সিমেক্স পেপার লি.’-কে ৪৩ লাখ ২১ হাজার টাকায় কাজ দেওয়া হয়। অবাক করা বিষয় হলো, ‘মাস্টার সিমেক্স পেপার লি.’ ৪১ লাখ ২০ হাজার ৫১৪ টাকায় দরপত্র জমা দিলেও প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ দেওয়া হয় ৫১ লাখ ৪৯ হাজার ৭৪৬ টাকায়। একইভাবে ‘ট্রাস্ট কালার প্রিন্ট ও অ্যাকসেসরিজ’ ২৫ লাখ ৬৮ হাজার টাকায় দরপত্র জমা দিলেও কাজ দেওয়া হয় ৪৩ লাখ ২১ হাজার টাকায়। দুই প্রতিষ্ঠানের জমা দেওয়া দরপত্রের চেয়ে প্রায় ২৮ লাখ টাকার বেশি দরে কাজ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
সর্বনিম্ন দুই দরদাতাকে কাজ না দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫ লাখ ৮১ হাজার ১৩২ টাকা। ডায়েরি ও বর্ষপঞ্জি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দেওয়ার কারণ হিসেবে ‘জাল ব্যাংক লিকুইড’ সনদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত কাগজ আতিকুর রহমানসহ দরপত্র কাজে জড়িত কেউ তদন্ত কমিটিকে দেখাতে পারেনি।
প্রতিবেদন আরো বলা হয়েছে, দাখিল করা দরপত্রসমূহ উন্মুক্ত করার সময় দরপত্র লিপিবদ্ধ করে সেখানে উপস্থিত সকলের স্বাক্ষর নেওয়া হয়। কিন্তু স্বাক্ষরিত সেই কাগজটি তদন্ত কমিটি খুঁজে পায়নি। এ কাগজ আতিকের কাজে সংরক্ষিত রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের জিবি সদস্য (কলেজ) মো. মিজানুর রহমান, দাতা সদস্য খন্দকার মুস্তাক আহমেদ, জিবি অভিভাবক সদস্য (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেন এবং সংরক্ষিত মহিলা শিক্ষক সদস্য মাকসুদা আক্তারের স্বাক্ষরে দরপত্র মূল্যায়ন শেষ করা হয়। তদন্ত কমিটির কাছে আমজাদ হোসেন ও মিজানুর রহমান জানান, আতিকুর রহমান খান মূল্যায়ন সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি প্রস্তুত করে দিলে তারা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সরল বিশ্বাসে দরপপত্র মূল্যায়ন সংক্রান্ত কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী ডেস ডিডাকশন বকেয়া (ডিডিও) হিসেবে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। তিনি ক্রয় কার্যক্রম যাচাই-বাছাই না করে চেকে স্বাক্ষর করেন। ক্রয়ের ক্ষেত্রে পিপিএ- ২০০৬ ও পিপিআর- ২০০৮ মানা হয়নি। দুটি ভিন্ন দরপত্রের সর্বনিম্ন দরদাতাদের কাজ না দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩৫ লাখ ৮১ হাজার ১৩২ টাকা। এ ক্ষতির জন্য প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ,দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদনে স্বাক্ষরকারী চার সদস্য ও উপসহাকারী প্রকৌশলী আতিকের দয়িত্বহীনতার প্রমাণ মিলেছে।
ক্রয় সংক্রান্ত সব কাগজপত্রে আতিকের স্বাক্ষর না থাকলেও অন্তরালে থেকে ক্রয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার সম্পৃক্ততা থাকার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
আতিক তদন্ত কমিটির কাছে নিজেকে পিপিএ- ২০০৬ ও পিপিআর- ২০০৮ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করেছেন। যে কারণে তিনি আইডিয়ালের সব ধরনের ক্রয়, বিজ্ঞাপন, দরপত্র দলিল প্রণয়ন, দরপত্র উন্মুক্তকরণ ও মূল্যায়নে ক্রয় কমিটিকে সব ধরনের সাচিবকি সহায়তা দিয়ে থাকেন। তবে, স্কুল কমিটি তাকে লিখিত কোনো দায়িত্ব দেয়নি।
৬ ধরনের অনিয়ম পেয়েছে তদন্ত কমিটি
তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র এবং ক্রয় কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের জবানবন্দি পর্যালোচনা করে ছয় ধরনের অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছে। দরপত্র উন্মুক্ত কমিটির দুজন সদস্য মৃত্যুবরণ করা সত্ত্বেও কমিটি পুনর্গঠন করা হয়নি এবং সভাপতিসহ গভর্নিং কমিটিকে এ বিষয়ে জানানো হয়নি। দরপত্র মূল্যায়নের জন্য কোনো মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়নি, সংশ্লিষ্ট তিনটি প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা দরপত্রগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত ব্যাংক লিকুইডিটি সনদ কোনো ধরনের যাচাই ছাড়াই জাল উল্লেখ করে বাতিল করা যথাযথ হয়নি। উপসহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান ক্রয় কাজের সঙ্গে জড়িত না থেকেও তিনি দরপত্র সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রস্তুত করে তা নিজের কাছে গচ্ছিত রেখেছেন, যা বিধিসম্মত হয়নি। উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী ডিডিও হিসেবে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি এবং ক্রয় কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে পিপিএ- ২০০৬ ও পিপিআর- ২০০৮ যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ
দুটি ভিন্ন দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ না দিয়ে প্রতিষ্ঠানের আর্থিকভাবে হয়েছে ৩৫ লাখ ৮১ হাজার ১৩২ টাকা। এ আর্থিক ক্ষতির জন্য প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ, দরপত্র মূল্যায়ন প্রতিবেদনে স্বাক্ষরকারী চার সদস্য এবং উপসহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খানের দায়িত্বহীনতা প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু কাগজপত্রের কোথাও আতিকের স্বাক্ষর না থাকলেও অন্তরালে থেকে ক্রয় সংক্রান্ত অনেক সিদ্ধান্ত নিতে তার সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার আলামত পাওয়া গেছে। বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের জন্য অধিকতর তদন্তের প্রয়োজন। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক উপসচিব বাবুল মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন করে কিছু বলা নেই। আমরা যা পেয়েছি তা তদন্ত প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলেছি। প্রতিষ্ঠান এখন কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আরো অধিকতর তদন্ত হওয়া উচিত। স্কুল কর্তৃপক্ষ চাইলে এ তদন্ত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।’
এ বিষয়ে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমানকে একাধিকার ফোন করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এনএম/এমএআর