দিনটি ছিল ১২ নভেম্বর। সকালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সামনের করিডোরে অঝোরে কাঁদছিলেন এক নারী। কান্না দেখে অনেকেই কারণ জানতে ছুটে যান তার কাছে। ঘটনাটি দৃষ্টি এড়ায়নি সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজারও। তিনি কান্নারত নারীর কাছে গিয়ে জানতে চাইলে ওই নারী জানান, স্বামী তার তিন মাসের সন্তানকে প্রতারণা করে নিয়ে গেছেন। ১৮ মাস ধরে শিশু সন্তানকে দেখেন না। নবজাতক শিশুকে মায়ের দুধপানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তিনি কোনো খবরও জানেন না।

শিশুর মা আরও জানান, শিশুটির জিম্মা নিতে আদালতে মামলা করেছিলেন। হাইকোর্ট পেরিয়ে মামলাটি এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। কিন্তু কবে শুনানি হবে কেউ বলতে পারছেন না। 

এরপর আপিল বিভাগে অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজাসহ আইনজীবীরা সারিবদ্ধভাবে মেনশন লাইনে দাঁড়িয়ে যান। একেবারে শেষে রাবেয়া আক্তার পলিও দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে আপিল বিভাগের ডায়াসের সামনে আসেন রাবেয়া। কিন্তু কোনো কথা না বলে বিচারপতিদের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। একজন মায়ের কান্নায় আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে এক বেদনাবিধুর পরিবেশ তৈরি হয়।

মায়ের অঝোরে কান্না দেখে বিচারপতিদেরও মন নরম হয়ে আসে। প্রধান বিচারপতি এ কান্নার কারণ জানতে চান। রাবেয়া আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘তিন মাসের শিশু সন্তানকে হারিয়ে ১৮ মাস ধরে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি।’ এটুকু কথা বলার পর আর তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। তাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা। তিনি আপিল বিভাগের সামনে ঘটনা খুলে বলেন। মানবিক কারণে রাবেয়া আক্তারকে বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দিতে চান বলেও আদালতকে জানান।

শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ২০ মাসের শিশু সন্তানকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মা রাবেয়া আক্তারের কাছে বুঝিয়ে দিতে নির্দেশ দেন

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রাবেয়া আক্তারকে আশ্বস্ত করেন। আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় একেবারে পেছনে থাকা তার আবেদনটি টপে এনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির নির্দেশ দেন। গতকাল (২১ নভেম্বর) মামলাটি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে। উভয়পক্ষের আইনজীবীরা শুনানিতে অংশ নেন। শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ২০ মাসের শিশু সন্তানকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মা রাবেয়া আক্তারের কাছে বুঝিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। শিশুর বাবা মো. আনোয়ার হোসেনকে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশের পর মা রাবেয়া আক্তারের মুখে হাসি ফোটে। শিশু তার মায়ের দুধপানের অধিকার ফিরে পায়। ওই নারী প্রধান বিচারপতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

রাবেয়া আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি আপিল বিভাগের কাছে ন্যায় বিচারটুকু চেয়েছিলাম। আমার সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য মাননীয় বিচারপতিদের কাছে আকুল আবেদন করেছিলাম। কান্না করেছিলাম। আমার মামলাটা আপিল বিভাগে ১২৭৭ নম্বর ক্রমিকে ছিল। স্বাভাবিকভাবে আমার মামলাটা শুনানি হতে ৬ বছর পার হয়ে যেত। সন্তানের মুখ আমি কখনোই দেখতে পেতাম না। ৩ মাসের দুধের শিশুকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে। এই ১৮ মাস সবার দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। আমার সন্তানকে কোথাও পাইনি। শেষে আমি এখানে এসে বিচারপতিদের কাছে সাহায্য চাই, তারা আমাকে সাহায্য করেছেন। আমার মামলাটি কার্যতালিকায় টপে এনে শুনানি করেছেন। আর রাজা স্যার আমাকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে আমাকে হেল্প করেছেন। স্যার আমার থেকে কোনো টাকা পয়সা নেননি। বিনা টাকাতে স্যার আমাকে সাহায্য করেছেন। উপরে আল্লাহর ইচ্ছে, নিচে স্যারের প্রচেষ্টায় আমার সন্তানকে ফিরে পেয়েছি। আমি আপিল বিভাগে কান্না করে বলেছিলাম আমার মামলাটা এতো পেছনে আছে, মামলাটা টপে আনার জন্য বলেছিলাম। মাননীয় বিচারপতিরা আমার আকুতি শুনেছেন। সারাজীবন বিচারপতি স্যারদের জন্য দোয়া করব।’

প্রথম দিনের ঘটনার বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১০/১২ দিন আগের ঘটনা। ওইদিন ছিল রোববার। আমি দেখলাম যে আপিল বিভাগের করিডোরে এক নারী কান্না করছেন। সাধারণত আমাদের উচ্চ আদালতে এই সিনটা দেখা যায় না। যে কোনো একটা মামলার আসামি বা কোনো একটা মামলার তদবিরকারক বা বাদী-বিবাদী এসে কোর্টে কান্না করেন। উনাকে বাইরে প্রথমে কান্না করতে দেখলাম। কারণও কিছুটা জানলাম। তারপর আমরা আইনজীবীরা মেনশন করার জন্য যখন কোর্টের কাছে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াই, তখন ওই নারী সবার পেছনে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে উনি কোর্টের সামনে কথা বলতে পারলেন না। কথা বলার আগেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, আমার ৩ মাসের সন্তান হারিয়ে আজকে ১৮ মাস রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেছি। এসময় আমি স্ব-প্রণোদিত হয়ে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসি।  তখনই আমি মানবিক দৃষ্টি থেকে তার মামলার দায়িত্ব নিলাম। আপিল বিভাগ আমাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করলেন। সর্বোচ্চ আদালত ওই দিনই রাবেয়া আক্তারের মামলাটি কার্যতালিকার ১২৭৭ নম্বর ক্রমিক থেকে টপে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন।

মামলা প্রসঙ্গে আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, এই রাবেয়া আক্তার আনোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন। আনেয়ার হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী হলেন রাবেয়া আক্তার। বিয়ের পর তাদের একটা সন্তান হয়। বয়স ৩ মাস থাকা অবস্থায় বাবা আনোয়ার হোসেন বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায়। দীর্ঘদিন তাদের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে বাবার বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করা হয়। হাইকোর্ট এই মামলা স্থগিত করেন। বর্তমানে আপিল বিভাগে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। গতকাল আপিল বিভাগ আদেশ দেওয়ার সময় বলেছেন, বাবা তার শিশু সন্তানকে অপহরণ করেছে কি করে নাই, এটা আপিল বিভাগ ডিটারমাইন্ড করবে। কিন্তু শিশু বাচ্চাকে আগে মায়ের কাছে দিতে হবে। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাবা আনেয়ার হোসেনকে শিশুটিকে রাবেয়া আক্তার পলিকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৪৮ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই মা তার শিশুকে কোলে ফিরে পেয়েছেন। তবে বাবা সপ্তাহে তিন তার সুবিধামতো সন্তানকে দেখার সুযোগ পাবেন। এছাড়া এই শিশুর ভরণপোষণসহ যাবতীয় খরচ বাবাকে বহন করতে হবে। আমরা সফল হয়েছি। আপিল বিভাগে একজন মায়ের কান্না বৃথা যায়নি। 

শিশুর বাবার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপিল বিভাগ ২০ মাসের শিশুকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আপিল বিভাগের নির্দেশে আমরা শিশুকে তার মায়ের কাছে তুলে দিয়েছি। তবে শিশুর বাবা সপ্তাহে তিন দিন সন্তানকে দেখার সুযোগ পাবেন।

১৬ জানুয়ারি শিশুকে আদালতে নিয়ে এসে মায়ের কাছে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু ১৬ জানুয়ারি শিশুকে আদালতে হাজির না করে সময় প্রার্থনা করেন আসামিরা

শিশুর বাবা বিরুদ্ধে মায়ের মামলার প্রেক্ষাপট
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজার জুনিয়র আইনজীবী রাফসান আলভী জানান, ২০২১ সালের প্রথমদিকে রাজধানীর শনিরআখড়ার বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন (রাবেয়া আক্তার পলি) ও মিরপুরের বাসিন্দা রাবেয়া আক্তার পলির বিয়ে হয়। আনোয়ার হোসেনের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার।

২০২২ সালের মার্চ মাসে রাবেয়া আক্তার একটি পুত্রসন্তান জন্ম দেন। কিন্তু আনোয়ার হোসেনের প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তারের কোনো সন্তান নেই। ২০২২ সালের ৬ জুলাই মা রাবেয়া আক্তার পলির কাছে মিথ্যা বলে ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তার স্বামী আনোয়ার হোসেন তিন  মাসের শিশুকে নিয়ে লাপাত্তা হন। এ ঘটনায় গত বছরের ২৩ জুলাই  রাবেয়া আক্তার পলি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে স্বামী আনোয়ার হোসেন ও তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলায় শিশুকে অপহরণের অভিযোগ আনা হয়। 

মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০২২ সালের ১৯ জুলাই রাবেয়া আক্তার পলি আসামিদের বাড়িতে যান। রাবেয়া আক্তারের যাওয়ার বিষয় টের পেয়ে আনোয়ার হোসেন তিন মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে অন্যত্র চলে যায়। মা রাবেয়া আক্তার পলিকে হুমকি-ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য করে। এই মামলা চলমান থাকা অবস্থায় শিশু সন্তানের জিম্মা চেয়ে আদালতে আরেকটি আবেদন করেন মা রাবেয়া আক্তার পলি। গত ৯ জানুয়ারি ৭ দিনের মধ্যে মায়ের জিম্মায় শিশুকে দেওয়ার শর্তে আসামি লাকী আক্তারকে জামিন দেন আদালত। ১৬ জানুয়ারি শিশুকে আদালতে নিয়ে এসে মায়ের কাছে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়। কিন্তু ১৬ জানুয়ারি শিশুকে আদালতে হাজির না করে সময় প্রার্থনা করেন আসামিরা।

এদিকে নারী শিশু নির্যাতন আইনে দায়ের করা মামলায় গত ২১ জানুয়ারি নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এর মধ্যে রাবেয়া আক্তারকে ডিভোর্স দেন আনোয়ার হোসেন। এই অভিযোগ গঠন বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন আসামিরা। হাইকোর্ট শুনানি শেষে ২৭ মার্চ বিচারিক আদালতের অভিযোগ গঠনের আদেশ স্থগিত করেন। কারণ হিসেবে তারা বললেন, বাবা কর্তৃক কোনো শিশুর অপহরণের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে শিশুর মা আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করেন। পরে চেম্বার আদালত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেন। আপিল বিভাগে মামলাটি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় সর্বোচ্চ আদালত শিশুর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে ও মায়ের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে ২০ মাসের শিশু সন্তানকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মা রাবেয়া আক্তারের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। আপিল বিভাগের আদেশে মা তার শিশু সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন। ২০ মাসের শিশু তার মায়ের কাছে নিরাপদে বাস করার অধিকার ফিরে পেয়েছে।

এমএইচডি/এসএম