আওয়ামী লীগের টিকিট পেতে মরিয়া দুই ডজন চিকিৎসক
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রতিদিনই রাজনীতির মাঠে ঘটছে নতুন ঘটনা। এরই মধ্যে নিজ নিজ এলাকায় প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। সমান তালে চলছে লবিং-গ্রুপিং, জনসংযোগ এবং নেতাকর্মীদের নিজের বলয়ে নিয়ে আসার চেষ্টাও। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান দুই ডজনের বেশি চিকিৎসক। ঈদ-পূজাসহ নানা উৎসব উপলক্ষ্যে নিজ এলাকায় গিয়ে সামাজিক কর্মকাণ্ড, শুভেচ্ছা বিনিময় ও গরিবদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহের কথা জানান দিচ্ছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের প্রায় প্রত্যেকেই দলীয় পেশাজীবী সংগঠনের নেতা। তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত। কেউ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান নেতা। আবার চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) বর্তমান ও সাবেক নেতারাও আছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের এ তালিকায়।
বিজ্ঞাপন
চিকিৎসকদের সংগঠন ও দলীয় একাধিক সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন অন্তত ২৫ জন চিকিৎসক। তাদের মধ্যে অনেকে আবার বর্তমান সংসদ সদস্য।
আরও পড়ুন
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনোনয়ন দৌড়ে আছেন ছাত্রজীবন থেকে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং পেশাগত জীবনে খ্যাতিমান চিকিৎসকরা। দলের শীর্ষপর্যায় থেকে ইতোমধ্যে অনেকেই ‘সবুজ সংকেত’ পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তারপরও দলের শীর্ষপর্যায়ে যোগাযোগ ও তদবির অব্যাহত রেখেছেন তারা।
কে কোন আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে চাঁদপুর- ৩ আসনে লড়বেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সাতক্ষীরা- ৩ আসনের মনোনয়ন দৌড়ে আছেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক। ঢাকা- ৭ আসনে মনোনয়ন চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনর (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন কুমিল্লা- ৭ আসন থেকে। একইসঙ্গে বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান খান টাঙ্গাইল- ৩ আসন, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন চট্টগ্রাম- ৩ সন্দ্বীপ আসন, সাবেক সভাপতি ডা. এম ইকবাল আর্সলান রাজবাড়ী- ২ আসন, স্বাচিপের সাবেক মহাসচিব ডা. এম এ আজিজ ময়মনসিংহ- ৪ আসন, বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী সিলেট- ৩ আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ ছাড়া, দলের সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. বদিউজ্জামান ভূঁইয়া ডাবলু মুন্সীগঞ্জ- ১ আসন, স্বাচিপের সাবেক সহসভাপতি ডা. রউফ সরদার নরসিংদী- ৪ আসন, খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. শহীদ উল্লাহ খুলনা- ৬ আসন, ডা. নজরুল ইসলাম পিরোজপুর- ৩ আসন, বিএমএ খুলনা বিভাগীয় সভাপতি ডা. বাহারুল আলম খুলনা- ২ আসন, ডা. মুরাদ হাসান জামালপুর- ৪ আসন এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ছোট বোন ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর কিশোরগঞ্জ- ১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এর বাইরেও বেশকিছু চিকিৎসক ঘোষণা ছাড়াই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা বলছেন, কেন্দ্র থেকে সিগন্যাল পেলেই প্রকাশ্যে আসবেন এবং নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় সক্রিয় হবেন।
নির্বাচন করব ভেবে আগেই অবসর নিয়ে নিয়েছি : ডা. কামরুল হাসান খান
টাঙ্গাইল- ৩ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ২০১২ সালে আমাদের এমপি (ঘাটাইল) মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী আমাকে তখনই বলেছিলেন নির্বাচনে অংশ নিতে। তবে নির্বাচন কমিশনের আইনে আছে, চাকরি ছাড়ার তিন বছরের মধ্যে নির্বাচন করা যাবে না। যে কারণে আমি আগে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন করতে পারিনি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আমি ২০২০ সালেই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। যাতে এবার আমার ওপর নির্বাচন কমিশনের কোনো আইনি বাধা না থাকে।
‘একজন প্রার্থী হিসেবে আমি দীর্ঘদিন ধরে ঘাটাইলে আছি। সবসময় এলাকার মানুষের খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। সুখে-দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করি। এলাকার মানুষও আমাকে বেশ পছন্দ করে। আমি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী যদি আমাকে মনোনয়ন দেন তাহলে নিশ্চয়ই আমি আমার আসনটা তাকে উপহার দিতে পারব। সেই প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই আমি নিয়েছি।’
আরও পড়ুন
কামরুল হাসান খান বলেন, মেডিকেলে পড়া অবস্থায় বিভিন্ন রোগ-বালাইসহ নানা সমস্যা নিয়ে মানুষ আমার কাছে আসত। টাঙ্গাইলের বিভিন্ন হেলথ কমপ্লেক্সে চাকরি করেছি। ১৯৮৪ সাল থেকে টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে, ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে এবং ১৯৯১ সাল থেকে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি) চাকরি করেছি। যখন যেখানে আমার পোস্টিং ছিল সেখান থেকেই প্রতি মাসে একটা সময় বের করে এলাকাবাসীর কাছে ছুটে এসেছি, তাদের সেবা করার চেষ্টা করেছি।
তফসিল ঘোষণা হলেই পুরোদমে নির্বাচনে নেমে যাব : ডা. এম এ আজিজ
নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, গত কয়েক মাস ধরে আমি এলাকার প্রত্যেকটি ইউনিয়নে যাওয়ার চেষ্টা করছি। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। প্রতি শুক্রবার এলাকার মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ছি। মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছি। গ্রামপর্যায়ে আমরা উঠান বৈঠক শুরু করেছি। আওয়ামী লীগের জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। সবমিলিয়ে আমি গত ১৫-১৬ বছর ধরে এলাকায় কাজ করছি। এখন নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করলেই পুরোদমে মাঠে নেমে যাব।
‘আপনারা জানেন আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ দল। যে কারণে প্রতিটি নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী থাকে। এবারও প্রতিটি এলাকায় বেশ কয়েকজন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমার জেলা-উপজেলায়ও অনেক প্রার্থী আছেন। এক্ষেত্রে দল যাকে মনোনয়ন দেবে সবাই তার পক্ষে কাজ করবে।
বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে ডা. এম এ আজিজ বলেন, আমি কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে পজিটিভ সিগন্যাল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এখন দল যাকে নমিনেশন দেবে, তাকে নির্বাচিত করতে আমরা সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাব। কোনো কারণে যদি নমিনেশন না পাই, বিদ্রোহী প্রার্থী হব না। দলের বাইরে এমনটি করার কোনো সুযোগ নেই। আশা করি, দল যদি আমাকে মানোনয়ন দেয়, তাহলে আমার বিরুদ্ধে কেউ দাঁড়াবেন না।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন বলে আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি : ডা. জামাল উদ্দিন
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি ও বিশিষ্ট চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জামাল উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের জন্য পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০০৮ সালে আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলাম। তখন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল, যে কারণে জয়লাভ করতে পারিনি।
‘আমি এলাকায় আবারও কাজ শুরু করেছি। এলাকার লোকজনও আমাকে চাচ্ছে। ২০০৮ সালে যেভাবে বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে আমাকে হারতে হয়েছিল, এবার আর সেই সুযোগ নেই। কারণ, বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগের লোকজন এত বেশি অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, অনেকে তাদের বাড়িঘরেও যেতে পারে না। কিন্তু বর্তমান এমপি সেই জায়গায় কিছুই করতে পারছেন না। এ কারণে স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমাকে চাচ্ছেন।’
স্বাচিপ সভাপতি আরও বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে একটি সুবিধা হলো, আমার সঙ্গে নেতাকর্মীদের সরাসরি কোনো বিবাদ নেই। বিশেষ করে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আমাকে খুবই পছন্দ করেন। এখন যদি নেত্রী আমাকে মনোনয়ন দেন, তাহলে আমি আমার মতো করে সন্দ্বীপকে ঢেলে সাজাতে পারব। সেই লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু হবে।’
যথাসময়েই নির্বাচন হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না : চিকিৎসক নেতারা
বিএনপি-জামায়াত দেশে অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে— উল্লেখ করে আওয়ামীপন্থি চিকিৎসক নেতারা বলছেন, যথাসময়েই নির্বাচন হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এ বিষয়ে সাবেক স্বাচিপ নেতা ডা. এম এ আজিজ বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারের প্রস্তুতি আছে, নির্বাচন কমিশনেরও প্রস্তুতি আছে। সংবিধানের আলোকে যথা সময়ে নির্বাচন হবে। কিন্তু বিএনপিসহ কিছু দল আছে যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সরকারের পদত্যাগ ইস্যুতে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম করছে। তবে, জনগণের কাছে তাদের কোনো অবস্থান নেই।
‘আমরা আশা করছি, যথাসময়েই নির্বাচন হবে। অসাংবিধানিক কোনো কিছু সাধারণ জনগণ চায় না। আমরাও সেটি বাস্তবায়ন হতে দেব না। আমার সন্দেহ হয় যে, এ মুহূর্তে বিএনপি নিজেরাই নির্বাচন চায় না। কারণ, তাদের আসলে নেতৃত্ব নেই। তারা ক্ষমতায় আসলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, ক্ষমতায় না আসলে বিরোধীদলের নেতা কে হবেন, এমনকি এ সময় দলকে কে নেতৃত্ব দিচ্ছে— এসব বিষয়েও কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। যে কারণে তারা চাচ্ছে তৃতীয় কোনো শক্তির হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে।’
অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, ‘দেশে নির্বাচন হবেই। আওয়ামী লীগ মানুষের ভোটে আবারও ক্ষমতায় আসবে। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আওয়ামী লীগ রাজপথের দল, রাজপথেই আছে। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা আবারও ক্ষমতায় আসব।’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে জনগণের উন্নয়ন হয়। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় আসলে চুরি-লুটপাট হয়। বিএনপি মানেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। বিএনপি-জামায়াতের কাজই হচ্ছে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা। এ ছাড়া, তাদের আর কোনো ভালো গুণ নেই। বিএনপি জনগণের চোখে ধুলা দিতে নানা চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বাইরের দেশের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য দেখে অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না।’
‘শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় আনতে হবে। দেশের উন্নয়নে ও চিকিৎসকদের স্বার্থে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনার সময়ই স্বাস্থ্যসেবা খাত অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে। এজন্য চিকিৎসকদের আমি বলব, নির্বাচনকে সামনে রেখে চিকিৎসকদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’
টিআই/এসকেডি