সম্প্রতি শেষ হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে আয়োজিত আঞ্চলিক জলবায়ু সম্মেলন। এ সম্মেলনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো, নদীভাঙন, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম প্রস্তুতি এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে (কপ- ২৮) জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট নিয়ে নিজ নিজ দেশের অবস্থান তুলে ধরার পরিকল্পনা করা হয়েছে। 

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট, সমাধান, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ এবং প্রতিবন্ধকতাসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের অন্যতম সদস্য, জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন ঢাকা পোস্টের নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিক। 

ঢাকা পোস্ট : দেশে প্রথমবারের মতো আঞ্চলিক জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। সেই তুলনায় এটা দুঃখজনক যে, বাংলাদেশে প্রথমবার আঞ্চলিক জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ যে পরিমাণ ঝুঁকিতে পড়েছে, দেশের যে পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে ও লবণাক্ততা বাড়ছে— সেই বিচারে আমি মনে করি বাংলাদেশে এ ধরনের সামিট প্রতি বছর কয়েকটি হওয়া উচিত। প্রতিটি আন্তর্জাতিক সামিটে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালোভাবে অংশগ্রহণ করা উচিত; প্রতিনিধিত্ব করা উচিত। সেসব সামিটের প্রতিটি সেশন, প্যানেল ও প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশের জলবায়ুজনিত ঝুঁকির সঠিক তথ্য তুলে ধরা উচিত। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের জলবায়ুজনিত ঝুঁকির বিষয়টা সঠিকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। 

ঢাকা পোস্ট : জলবায়ু পরিবর্তনে আইনকানুনের প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। অনেক কলকারখানা ও ইটভাটা অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলছে। এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে বাধা কোথায়?

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : সরকার এ বিষয়ে খুব সচেষ্ট। তবে আমি মনে করি, সরকারের আরও বেশি কঠোর হওয়া উচিত। করোনাকালে দেশে দারিদ্র্যের হার কিছুটা বেড়েছিল, সে কারণে হয়তো সরকার কিছুটা গতি কমিয়েছে। একই সময়ে দূষণের জন্য আমরা যে ক্ষতির শিকার হচ্ছি, সেখানে আমাদের দায় খুব কম। কিন্তু আমরা ভুক্তভোগী হচ্ছি বেশি। আমি মনে করি, আমাদের এখন নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে গাড়ি চালানো উচিত। সেকেলে পদ্ধতির ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দিয়ে সেখানে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা গড়ে তোলা উচিত। পাশাপাশি কী কী গ্রিন প্রকল্প নিলে বাংলাদেশ বৈশ্বিকভাবে ‘গ্রিন কান্ট্রি’ হিসেবে পরিচিত হবে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। কারণ, আমরা যখন সমঝোতায় যাব তখন তারাই এ প্রশ্ন তুলবে যে, তোমরা তোমাদের দেশেও তো দূষণ করছ। আমরা যদি দেশকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সবুজায়ন করতে পারি, তাহলে আমাদের এ বোঝাপড়ার জায়গাটা অনেক শক্তিশালী হবে।

এ বোঝাপড়া করা ছাড়া আমাদের আর বিকল্প নেই। কারণ, নদীভাঙন থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করা, সাগর থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করা... বিভিন্ন মহাপরিকল্পনা নিতে আমাদের প্রচুর অর্থায়ন দরকার হবে। অতি সম্প্রতি যে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড স্বীকৃত হয়েছে, সেখানে সুইজারল্যান্ড একটা বড় অ্যামাউন্ট কন্ট্রিবিউট করেছে। আমার বিশ্বাস অন্যান্য দেশও কন্ট্রিবিউট করবে। তখন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির কারণে দুর্বলতা মূল্যায়ন করে বাংলাদেশকে সেখান থেকে পর্যাপ্ত অর্থ আনতে হবে। সেক্ষেত্রে স্বচ্ছতা খুবই জরুরি। যারা বৈশ্বিক এ অর্থায়ন করবে তারা আসলে স্বচ্ছতা চাচ্ছে। সুতরাং সবার আগে সরকারকে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ নিয়ে একটা বিতর্ক চলছে। উন্নত দেশগুলো এ ফান্ডে অর্থ দিতে আগ্রহী নয়। এ সমস্যার সমাধান কোথায়?

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী এ ফান্ড দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কেউ আসলে কন্ট্রিবিউট করেনি। অনেকে ওয়াদা করলেও ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি যে ফান্ডটি হবে সেটি হয়নি। কিছু কিছু দেশ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা দ্রুত অর্থায়ন করবে। আমার ধারণা দ্রুত একটা ফান্ড তৈরি হবে। তবে, এ অর্থ ব্যবহার করার জন্য আমরা প্রস্তুত কি না, বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে এবং প্রস্তুতি নিতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : সরকার কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার চেষ্টা করছে? সেটি কতটা কার্যকর হচ্ছে?

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : সরকার জলবায়ু সংক্রান্ত আইন করেছে, পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত আইন করেছে। ফান্ডও দিচ্ছে। তবে আমি মনে করি, এ মন্ত্রণালয়কে আরও বেশি ফান্ড দেওয়া উচিত। সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন তা হলো, আন্তর্জাতিক ফোরাম ও অন্যান্য ডিজিটাল ফোরামে বাংলাদেশ যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির সম্মুখীন, তার সঠিক চিত্র তুলে ধরতে হবে। এ ছাড়া, কম্পেন্সেশন ক্লেইম করা যেতে পারে। আমাদের দেশকে যদি নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা করতে হয়, তাহলে কোটি কোটি টাকার নদী ভাঙন প্রকল্প হাতে নিতে হবে। পরিকল্পনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। একসময় বাংলাদেশের সাগরে বাঁধ দেওয়া লাগতে পারে।

আইল্যান্ডগুলোতেও বাঁধ দিতে হতে পারে। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য যে ফান্ড দরকার তা বাংলাদেশ কখনোই অর্জন করতে পারবে না। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে যে বরাদ্দ দিচ্ছে তা দিয়ে কিছু কিছু নদীর ভাঙন এলাকায় বাঁধ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আমি মনে করি, এ বরাদ্দ আরও বাড়ানো উচিত। ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ থেকে বাংলাদেশ যদি সাহায্য ও বৈশ্বিক অর্থায়ন না পায়, তাহলে অভ্যন্তরীণভাবে সরকার এ টাকা দিতে পারবে না। এজন্য গ্লোবাল ফাইন্যান্স-টা আমাদের দেশের জন্য খুবই দরকার।

ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ বা অভিযোজনের জন্য সামনে কী কী পদক্ষেপ দরকার বলে মনে করেন?

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : সামনে কিছুদিন পরই দুবাইয়ে জলবায়ু সম্মেলন (কপ- ২৮) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এ মুহূর্তে যেটি দরকার তা হলো— বাংলাদেশ থেকে যারা প্রতিনিধি হিসেবে যাচ্ছেন তাদের উচিত হবে যতগুলো সংশ্লিষ্ট সেশন আছে, প্রি-কনফারেন্স ইভেন্ট আছে, পোস্ট কনফারেন্স ইভেন্ট আছে, সাইড ইভেন্ট আছে, সব জায়গায় বাংলাদেশ থেকে একজন করে ইয়ুথ ও একজন করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ থাকা দরকার। যেন একশ থেকে এক হাজার বাঙালি সেখানে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে ‘ভয়েস রেইজ’ করতে পারে এবং চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এ জায়গাতে আমি সরকারের সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করেছি। নাগরিক সমাজ, শিক্ষিত সমাজ, যুব সমাজ, আমলা ও রাজনীতিবিদসহ সবার সমন্বিত হয়ে কাজটি করা উচিত। এ সমন্বয় যথাযথভাবে সবসময় হয় না। এখন সরকারের উচিত যথাযথ সমন্বয় করে এবং সবাইকে তৈরি করে একটা সমন্বিত চাপ প্রয়োগ করা।

ঢাকা পোস্ট : জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি এড়াতে সাধারণ মানুষ কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : দেশের সাধারণ মানুষ অবশ্যই কেমিক্যাল অ্যাভয়েড করতে পারে। তারা প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে পারে। অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটের কথাগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করতে পারে, যাতে এ বিষয়গুলো আমরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে পারি। অনেকের নদী ভাঙনে বাড়ি চলে গেছে, কারো বাচ্চা মারা গেছে, অনেকের বাচ্চা হচ্ছে না, কারো বাচ্চা লবণাক্ততার কারণে বিকলাঙ্গ হচ্ছে, বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যে ক্ষতি হচ্ছে তার একটা তালিকা করা উচিত।

বাংলাদেশে জলবায়ুর কারণে প্রতি বছর ১২ থেকে ১৪ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মাধ্যমে এ ক্ষতির তালিকা করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরা উচিত। পাশাপাশি সামনে যেহেতু নির্বাচন, সেহেতু সাধারণ মানুষ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সরকার গত বছর প্লাস্টিকের ওপর কর কমিয়ে দিয়েছিল, তবে এবার বাড়িয়েছে। এ ধরনের আত্মঘাতী পদক্ষেপ যেন সরকার না নেয়, জনগণকে সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : বেসরকারি সংগঠন বা সংস্থা নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের ভূমিকা কীভাবে দেখছেন? কোনো পরামর্শ আছে কি না?

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : তারা অসাধারণ কাজ করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চমৎকার অবদান রাখছেন। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে এখানে একটা নেতৃত্ব ও সমন্বয়ের ডাক দিতে হবে। কপ সম্মেলনের আগে ও পরে সরকারি আমলা, মন্ত্রণালয়, এমপি-মন্ত্রী, নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞসহ সবাইকে একত্রে বসে পরিকল্পনা, পদক্ষেপ ও বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। তাহলে সরকারও লাভবান হবে। নাগরিক সমাজের পক্ষে তো এ সমস্যা একা সমাধান করা সম্ভব নয়। নাগরিক সমাজ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারলে এ সমস্যার সমাধান সহজ হবে। সরকারের উচিত সিভিল সোসাইটির জন্য দরজাটি খুলে দেওয়া। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যাগুলো কোনো সরকারই একা সমাধান করতে পারবে না। তাদের পার্টনারশিপে যেতে হবে। আমার মনে হয় সেই পার্টনারশিপের দরজাটি সরকারের খোলা উচিত।

ঢাকা পোস্ট : গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনে অনেক বড় বড় দেশের দায় থাকলেও তারা ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে’ অর্থায়ন করছে না। এ সমস্যার সমাধান কোথায়? 

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনে কোনো দেশকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা যায় না। যে দেশগুলো এ অর্থায়ন করতে স্বাক্ষর করেনি তাদের ক্যাম্পেইন করে বোঝাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কিংবা বিপর্যয় যখন শুরু হয় তখন কোনো সীমানা দিয়ে সেটিকে প্রতিরোধ করা যায় না। যে দেশ আজ কন্ট্রিবিউট করছে না, সে দেশও কিন্তু একটা সময় ভুক্তভোগী হবে। সুতরাং তাদের বোঝাতে হবে। আমার মনে হয় আস্তে আস্তে সব দেশই বিশ্বকে বাঁচাতে এগিয়ে আসবে।

ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। 

ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভকামনা। 

এমএম/কেএ