রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১০ বছরে হরিলুট হয়েছে ৩০২ কোটি টাকার বেশি। অর্থলুটের এ ঘটনায় শীর্ষে রয়েছেন সাবেক অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম। অধিকাংশ অর্থ লুটে জড়িয়ে পড়েছে তার নাম। টানা ১৮ বছর অধ্যক্ষ থাকাকালীন দুর্নীতির জাল ফেলে আত্মসাৎ করেছেন কোটি কোটি টাকা।

ভর্তি বাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো খাত নেই যেখান থেকে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেননি। দুর্নীতি থেকে অর্জিত অর্থে রাজধানীর আফতাবনগরে গড়ে তুলেছেন এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া, বসুন্ধরা ও উত্তরায় দুটি প্লট, আফতাবনগর ও সূত্রাপুরে দুটি ফ্ল্যাট এবং ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। রয়েছে একটি ডেভেলপার কোম্পানিও। অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগমের অর্জিত অবৈধ এসব সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে অর্থ লোপাটের ভয়াবহ নানা চিত্র উঠে এসেছে।

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন-ভাতা, উন্নয়ন ফি, পরীক্ষা ফিসহ নানা খাত থেকে নেওয়া টাকা ব্যাংকে না রেখে সমুদয় অর্থ নগদ খরচ করতেন অধ্যক্ষ। অধ্যক্ষ হয়েও আরও দুটি শাখার দেখভাল করতেন তিনি। এজন্য দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন এক কোটি ৭৩ লাখ টাকা। শুধু তা-ই নয়, ১০ বছরে তিনি নগদ খরচ করেছেন ৭৮ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানের বাসায় থেকেও ভাড়া বাসা দেখিয়ে নিয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। ৭০ কোটি টাকার এফডিআর সরিয়েছেন নিজের পছন্দের ব্যাংকে। লাভের টাকাও গেছে অধ্যক্ষের পকেটে। সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের দুর্নীতির এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে ঢাকা পোস্ট।

ভর্তি বাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো খাত নেই যেখান থেকে তিনি অর্থ আত্মসাৎ করেননি। দুর্নীতি থেকে অর্জিত অর্থে রাজধানীর আফতাবনগরে গড়ে তুলেছেন এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া, বসুন্ধরা ও উত্তরায় দুটি প্লট, আফতাবনগর ও সূত্রাপুরে দুটি ফ্ল্যাট এবং ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। রয়েছে একটি ডেভেলপার কোম্পানিও। অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগমের অর্জিত অবৈধ এসব সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন

নিজস্ব অনুসন্ধানে শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য খাত থেকে আদায় করা অর্থ ব্যাংকে জমা না দিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে সাড়ে ৭৮ কোটি টাকা খরচের নামে লুট করার তথ্যও মিলেছে। এ ছাড়া, গাড়ি কেনা ও জ্বালানি খরচের নামে ৭১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন সাবেক এ অধ্যক্ষ।

দায়িত্বভাতা নিয়েছেন ১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান এবং সরকারের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, শাহান আরা বেগম অধ্যক্ষ থাকাকালীন ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের তিনটি শাখা থেকে আলাদাভাবে দায়িত্বভাতা নিয়েছেন। যা বিধিসম্মত নয়। মতিঝিল বাংলা ভার্সন থেকে অধ্যক্ষ দায়িত্বভাতা নিয়েছেন ৩৬ লাখ ছয় হাজার টাকা এবং সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৫৮ হাজার টাকা। একই ক্যাম্পাসের ইংলিশ ভার্সন থেকে তিনি দায়িত্বভাতা নিয়েছেন ২৮ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬ টাকা এবং সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৫৫ হাজার টাকা। মতিঝিল কলেজ শাখা থেকে সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন ছয় লাখ ১০ হাজার টাকা।

নথিপত্র ঘেঁটে আরও জানা যায়, বনশ্রী শাখার ইংলিশ ভার্সন থেকে সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম দায়িত্বভাতা নিয়েছেন ২৬ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬ টাকা এবং সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা। বাংলা ভার্সন থেকে অধ্যক্ষ দায়িত্ব ভাতা নিয়েছেন ৩১ লাখ ৮৮ হাজার ৯২৯ টাকা এবং সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৬৭ হাজার টাকা। মুগদা শাখা থেকে তিনি দায়িত্বভাতা নিয়েছেন ২৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬ টাকা এবং সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৫৫ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে তিনি এক কোটি ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৭ টাকা অবৈধভাবে নিয়েছেন।

মতিঝিল মূল ক্যাম্পাস ছাড়া অন্য দুই ক্যাম্পাস থেকে নেওয়া ৯৫ লাখ ৬৩ হাজার এক টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ। এ ছাড়া, মূল ক্যাম্পাস থেকে নেওয়া ৭৮ লাখ দুই হাজার ৩৬ টাকার আয়কর জমা দেননি তিনি। এ টাকার ১০ শতাংশ হারে অর্থাৎ সাত লাখ ৮০ হাজার ২০৩ টাকার আয়কর জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

বনশ্রী শাখার ইংলিশ ভার্সন থেকে সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম দায়িত্বভাতা নিয়েছেন ২৬ লাখ ৬৮ হাজার ৩৬ টাকা এবং সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ১৫ হাজার টাকা। বাংলা ভার্সন থেকে অধ্যক্ষ দায়িত্বভাতা নিয়েছেন ৩১ লাখ ৮৮ হাজার ৯২৯ টাকা এবং সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৬৭ হাজার টাকা। মুগদা শাখা থেকে তিনি দায়িত্বভাতা নিয়েছেন ২৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৬ টাকা এবং সাংবাৎসরিক ভাতা নিয়েছেন তিন লাখ ৫৫ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে তিনি এক কোটি ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ৩৭ টাকা অবৈধভাবে নিয়েছেন

এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকের শাখা ক্যাম্পাসের দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্বভাতা নেওয়ার কোনো বিধান নেই। যদি নিয়ে থাকেন তাহলে বিধি লঙ্ঘন করেছেন।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। বর্তমানে তিনি এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ পদে আছেন / ফাইল ছবি

প্রতিষ্ঠানের বাসায় থেকেও ৪০ লাখ টাকা বাসাভাড়া নেন অধ্যক্ষ

তদন্ত প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধ্যক্ষ হওয়ার পর শাহান আরা বেগমকে ২০০৪ সালে চার্জ অ্যালাউন্স বাবদ ১৭ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া, বাড়িভাড়া বাবদ মূল বেতনের ৪০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ক্যাম্পাসে আবাসিক বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়ে। তিনি প্রায় ১৮ বছর ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাসায় থেকেছেন। এ সময়ে বাসার গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাড়িতে থেকেও সরকারি ও প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে প্রায় ৪০ লাখ বাড়িভাড়া বাবদ গ্রহণ করেছেন।

নথি ঘেঁটে আরও দেখা যায়, ২০০৪ সালের ২৬ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িভাড়া হিসেবে প্রতিষ্ঠান থেকে ৩৯ লাখ ৬৮ হাজার ৪০০ টাকা নিয়েছেন শাহান আরা বেগম। সরকারি তহবিল থেকে বাড়িভাড়া হিসেবে নিয়েছেন এক লাখ পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। তিনি অবসরে যাওয়ার পরে আরও দুই মাস জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠানের বাসায় অবস্থান করেন। সরকারি ও প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়িভাড়া হিসেবে নেওয়া টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয় ডিআইএ প্রতিবেদন।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাসায় থেকে সরকারি ও প্রতিষ্ঠানের বাসাভাড়া, ইউটিলিটি বিল নেওয়া আর্থিক ক্রাইম। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাসভবনে থাকার পর সরকারি ও প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়িভাড়ার টাকা তুলে থাকলে সেটিও আইনের লঙ্ঘন। এসব অর্থ ফেরত দিতে হবে।

১০ বছরে নগদ খরচ করেছেন ৭৮ কোটি টাকা

শাহান আরা বেগম অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের সময় অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত মতিঝিল কলেজ শাখা, মাধ্যমিক বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে মোট ৭৮ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ১৭ টাকা ব্যাংকে জমা না রেখে ইচ্ছেমতো ভাউচার দিয়ে খরচ করেছেন। প্রতিষ্ঠানের দৈনিক খরচ করার জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা নগদ রাখা যায়। কিন্তু শাহান আরা বেগম সরকারি নিয়ম না মেনে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের নামে হরিলুট করেছেন।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের এত সম্পদ / ঢাকা পোস্ট

জানতে চাইলে ডিআইএ’র যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত ধরনের অনিয়ম করা যায় তার সবই এখানে হয়েছে। যা মোটেও কাম্য নয়। সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা  হাতে রেখে খরচ করার বিধান থাকলেও কোটি কোটি টাকা নগদ খরচ করা হয়েছে।

‘এ অনিয়মের কারণে সরকারি বিধি অনুযায়ী অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির (জিবি) বিরুদ্ধে আর্থিক তছরুপের মামলা করা যায়। আমাদের তদন্তে এসব অনিয়মের বিষয়ে মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এসআরও (সংবিধিবদ্ধ নিয়ামক আদেশ) ১৫৭ (১), (২), (৩), (৪) ও (৫) ধারা মোতাবেক প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’

৭০ কোটি টাকার এফডিআর-লাভ যেত অধ্যক্ষের পকেটে

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, পাঁচটি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লেনদের করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থাকার বিধান থাকলেও বেসরকারি তিনটি ব্যাংক- , ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫০ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২০ কোটিসহ মোট ৭০ কোটির টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত) রয়েছে। প্রথমে ইউনিয়ন ব্যাংক মতিঝিল শাখায় ৫০ কোটি টাকার এফডিআর করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে তা ধানমন্ডিতে স্থানান্তর করেন সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। গভর্নিং বডির অনুমতি ছাড়াই তিনি রামপুরা ইসলামী ব্যাংকে অন্য একটি অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন শুরু করেন। ব্যাংক হিসাবে ব্যাপক গরমিলের তথ্য পাওয়া গেছে।

সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা ও প্রতিষ্ঠানটির সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান রাজধানীর বনশ্রীতে এভারকেয়ার নামের একটি বেসরকারি স্কুল এবং ভিশন- ৭১ নামের একটি হাউজিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। নিয়ম না মেনে নগদ টাকা প্রতিষ্ঠান দুটির অ্যাকাউন্টে রাখেন। পরে সুবিধা মতো সময় তা উত্তোলন করে আইডিয়াল স্কুলের নামে ইসলামী ব্যাংকের রামপুরা শাখায় হস্তান্তর করেন।

২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর অধ্যক্ষ শাহান আরাকে তলব করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি / ঢাকা পোস্ট

গাড়ির জ্বালানি তেল বাবদ ৭১ লাখ টাকা আত্মসাৎ

ঢাকা পোস্টের হাতে আসা তথ্যে দেখা যায়, শাহান আরা বেগম অধ্যক্ষ থাকাকালীন বিধিবহির্ভূতভাবে দরপত্র ছাড়াই ১২ লাখ টাকায় একটি গাড়ি কেনেন। প্রতিষ্ঠানের আরও দুটি গাড়ি আছে। এসব গাড়ি মেরামত ও জ্বালানির ব্যয় অধ্যক্ষ নিজের অধীনে রাখেন। জ্বালানি বাবদ ৫৩ লাখ ৭১ হাজার ১৮৪ টাকা এবং মেরামত বাবদ ১৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮২ টাকা তিনি দেখান। অধিকাংশ টাকাই তিনি নিজের পকেটে ভরেন।

নগদ আয়ে ‘নগদ কমিশন‘— বিশ্বাসী শাহান আরা

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক নীতিমালা অনুযায়ী, তফসিলি ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাকাউন্ট থাকবে। সেই অ্যাকাউন্টে সব আয়-ব্যয়ের হিসাব থাকবে। কিন্তু আইডিয়ালের ক্ষেত্রে ঘটে উল্টোটা। ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ আদায় ও ব্যয় শুরু হয় ২০২০ সালের ১ মে থেকে। এর আগে ম্যানুয়ালি অফিসের মাধ্যমে নগদ অর্থ আদায় ও ব্যয় হতো। এ সুযোগে তৎকালীন অধ্যক্ষ সমস্ত ক্যাশ টাকা ইসলামী ব্যাংকের রামপুরা শাখায় হস্তান্তর করতেন।

প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নথিপত্র ঘেঁটে আরও দেখা যায়, অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম গভর্নিং বডির (জিবি) সদস্যদের যোগসাজশে শিক্ষার্থী ভর্তি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। টেস্ট পরীক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী অনুত্তীর্ণ হন তাদের কাছ থেকে বিষয়প্রতি ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে ফরম পূরণের সুযোগ দিতেন তিনি। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্র ঘষামাজা করে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে অবৈধভাবে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করেন। স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, তাকে বারবার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করার কথা বলা হলেও তিনি ‘নগদ আয়ে নগদ কমিশনে’ বিশ্বাসী ছিলেন।

আইডিয়ালের টাকায় নতুন স্কুল-ডেভেলপার কোম্পানি

ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন শাহান আরা বেগম হরিলুট করে যে অর্থ উপার্জন করেছেন তা দিয়ে রাজধানীর আফতাবনগরে ‘এভারকেয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১০তলা বিশিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নির্মাণে ব্যয় হয় ২০ কোটি টাকা। এটি নির্মাণে তার সহযোগী হিসেবে আছেন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আলোচিত উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান।

আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল শাখা / ফাইল ছবি

এ ছাড়া, প্রকৌশলী আতিকুর রহমান খান এবং অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগমের ছেলে মো. শরীফ মোস্তাক ছয় বছর আগে ‘ভিশন-৭১ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন। এটির পেছনেও শাহান আরা বেগমের আর্থিক সহযোগিতা রয়েছে। রাজধানীর বনশ্রী ও আফতাব নগরে এ কোম্পানির বেশ কয়েকটি প্রজেক্টের কাজ চলমান বলে জানা গেছে।

এর বাইরেও যত সম্পত্তির মালিক শাহান আরা

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রাজধানীর বসুন্ধরা ও উত্তরায় দুটি প্লট, আফতাবনগর ও সূত্রাপুরে দুটি ফ্ল্যাট এবং ব্যাংক হিসাব ও সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক আলোচিত এই শাহান আরা বেগম। দালিলিক তথ্য অনুযায়ী, স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে তার নামে প্রায় চার কোটি টাকার সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। যদিও বাস্তবে এসব সম্পদের মূল্য কয়েক গুণ বেশি। তার অর্জিত সম্পদের উৎস জানতে এরই মধ্যে নোটিশ পাঠিয়েছে  দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

২০১৯ সালে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্র ঘষামাজা করে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে অবৈধভাবে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করেন। স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, তাকে বারবার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করার কথা বলা হলেও তিনি ‘নগদ আয়ে নগদ কমিশনে’ বিশ্বাসী ছিলেন

আয়কর নথি ও অনুসন্ধানে জানা যায়, অধ্যক্ষ শাহান আরার নামে বসুন্ধরায় আড়াই কাঠার একটি প্লট, রাজধানীর সূত্রাপুরে এক হাজার ৭৪০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, উত্তরার হরিরামপুরে আড়াই কাঠার একটি প্লট এবং আফতাবনগরে এক হাজার ৪৯০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে প্রায় দুই কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ৫০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, ২৬ লাখ টাকার এফডিআর, প্রায় ২০ লাখ টাকার ডিপিএস উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া, টয়োটা মডেলের একটি গাড়ির মালিকানা রয়েছে তার নামে।

এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বক্তব্য জানতে শাহান আরা বেগমের ব্যক্তিগত নম্বর ও হোয়াটসঅ্যাপে একাধিকবার ফোন ও মেসেজ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো উত্তর মেলেনি। পরে বাসায় গেলেও তিনি কথা বলেননি।

এনএম/এমএআর/