ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত, কতটুকু চাপে জ্বালানি খাত?
ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে অস্থির হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজার। গত কয়েক দিনের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ। যা দেশের জ্বালানি খাতের জন্য অশনিসংকেত। বাংলাদেশে বর্তমানে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৭০ লাখ টন। আমদানি করা এসব জ্বালানির অধিকাংশই আসে সৌদি আরব, দুবাই ও কাতার থেকে। এ সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে বৈশ্বিক তেলের বাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। যা ভোগাবে বাংলাদেশকেও।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল জ্বালানি তেলের বাজার। ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৭০ থেকে বেড়ে ১৩০ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। যদিও পরে তা পর্যায়ক্রমে কমতে থাকে। চলতি বছরের মে মাসে তা কমে ব্যারেলপ্রতি ৭০ ডলারের কাছাকাছি নামে।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
কিন্তু গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী হামাস গোষ্ঠীর সংঘাত শুরু হওয়ার পর ৯ অক্টোবর সকালে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল প্রাইস ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ব্রেন্ট ক্রুড ও ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই), উভয় বেঞ্চমার্কের দাম গত সপ্তাহে বেড়েছে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বৈশ্বিক বাজারে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় জ্বালানি তেলের বাজার। ব্যারেলপ্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৭০ থেকে বেড়ে ১৩০ ডলারে গিয়ে ঠেকে। যদিও পরে তা পর্যায়ক্রমে কমতে থাকে। গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলের সঙ্গে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী হামাস গোষ্ঠীর সংঘাত শুরু হওয়ার পর ৯ অক্টোবর সকালে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ফের বেড়ে যায়। আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান অয়েল প্রাইস ডটকমের তথ্য অনুযায়ী, ব্রেন্ট ক্রুড ও ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই), উভয় বেঞ্চমার্কের দাম গত সপ্তাহে বেড়েছে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৫ দশমিক ৯ শতাংশ
বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে তেলসহ প্রতিটি জ্বালানি পণ্যের দাম ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।
এ ছাড়া, অর্থনৈতিক সূচক, বিনিময় হার, পুঁজিবাজার, সরকারি বন্ড ও পণ্যের দামের বিষয়ে বৈশ্বিক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহকারী ওয়েবসাইট ট্রেডিং ইকোনমিক্স জানিয়েছে, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ৯৮ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
জ্বালানি তেলের পাশাপাশি বাড়তে শুরু করেছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দামও। বর্তমানে স্পট মার্কেটে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিটের (এমএমবিটিইউ) দাম ১৫ ডলারের কাছাকাছি। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে পেট্রোবাংলা স্পট মার্কেট থেকে এক কার্গো এলএনজি কেনে ৫৯৫ কোটি ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৪০ টাকা ব্যয়ে। অর্থাৎ প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়ে ১৩ ডলার ৭৭ সেন্ট
জ্বালানি তেলের পাশাপাশি বাড়তে শুরু করেছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দামও। বর্তমানে স্পট মার্কেটে প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিটের (এমএমবিটিইউ) দাম ১৫ ডলারের কাছাকাছি। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে পেট্রোবাংলা স্পট মার্কেট থেকে এক কার্গো এলএনজি কেনে ৫৯৫ কোটি ৪৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৪০ টাকা ব্যয়ে। অর্থাৎ প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়ে ১৩ ডলার ৭৭ সেন্ট।
আরও পড়ুন
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্লাটসের এক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ছয় মাসে (মে-অক্টোবর) স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম বেড়েছে ৩-৪ ডলার। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ করা এলএনজির বড় একটি উৎস মধ্যপ্রাচ্য। অঞ্চলটিতে চলমান সংঘাতের কারণে সেখান থেকে ইউরোপে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। আবার এশিয়ার দেশগুলোতে এখন জ্বালানি পণ্যটির চাহিদা বাড়ছে। এসব পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে চলেছে এলএনজির দাম।
জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে চাপে পড়ছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। প্রতি বছর দেশে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি করা হয়। চাহিদা বিবেচনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যয় করেছে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। তবে, চলতি অর্থবছরে জ্বালানি পণ্যের বাজার বিবেচনায় তা ৯ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনের দায়িত্বে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। সংস্থাটি দুটি দেশ থেকে দীর্ঘমেয়াদে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করছে। এর একটি হলো সৌদি আরামকো (সৌদি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি), অন্যটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (অ্যাডনক)।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেলের বাজারে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তাতে বিপাকে পড়বে আমদানিনির্ভর দেশগুলো।
জ্বালানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে চাপে পড়ছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও। প্রতি বছর দেশে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানি করা হয়। চাহিদা বিবেচনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে জ্বালানি পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ ব্যয় করেছে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলার। তবে, চলতি অর্থবছরে জ্বালানি পণ্যের বাজার বিবেচনায় তা ৯ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধের ফলে আমরা চাপের চেয়ে ভয়ে আছি বেশি। কারণ, দাম বেড়ে গেলে চড়া দামে তা আমদানি করতে হবে। যার প্রভাব পড়বে দেশের বাজারে। ইতোমধ্যে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। রাজধানীতে গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। এ ছাড়া, ডলারের চাপ তো আছেই। এখন মধ্যপ্রাচ্যের সংকট যদি না কাটে তাহলে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, হয়তো আবার শিডিউল লোডশেডিং হতে পারে।
আরও পড়ুন
এ মুহূর্তে সরকারের করণীয় কী— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব কিন্তু আমরা দেখেছি। সরকার ভাবছে এ সমস্যাগুলো সাময়িক। কিন্তু সাময়িক হলেও সেসব তো হচ্ছে, সরকার কিন্তু সচেতন হয়নি। এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে নিজস্ব জ্বালানি সম্পদ, অর্থাৎ আমাদের যে গ্যাস আছে, তা আহরণে আরও মনোযোগী হওয়া। পাশাপাশি একটা লং টার্ম স্টোরেজ সিস্টেম চালু করা। তেল সংরক্ষণ করার জন্য স্টোরেজ আছে, কিন্তু এখন উচিত গ্যাস সংরক্ষণের জন্যও এমন স্টোরেজ গড়ে তোলা। শুধুমাত্র সংকটের সময়ে তা ব্যবহার করা। প্রক্রিয়াটি কিছু জটিল হলেও এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী। এ ছাড়া, জ্বালানির জন্য আলাদা রিজার্ভ রাখা, পলিসি ঠিক করার মতো বিষয়গুলো তো রয়েছেই।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীল রয়েছে কয়লার দাম। তবে, বিভিন্ন সংস্থার পূর্বাভাস বলছে, আগামী কয়েক মাসে কয়লার বাজারও ঊর্ধ্বমুখী হবে।
কয়লার বাজার মনিটরিং করা প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসল ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অক্টোবরে টনপ্রতি কয়লা বিক্রি হচ্ছে ১৪৩ ডলার ৮৫ সেন্টে। আগামী মাসে (নভেম্বর) তা টনপ্রতি বেড়ে দাঁড়াবে ১৫০ ডলার ৭০ সেন্টে, ডিসেম্বরে ১৫৩ ডলার ৮০ সেন্টে এবং আগামী বছরের জানুয়ারিতে তা ১৫৭ ডলারে উঠে যেতে পারে।
আরও পড়ুন
দেশে কয়লানির্ভর পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বর্তমানে গড়ে দুই হাজার ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি বছর কয়লার প্রয়োজন পড়ে প্রায় ১০ লাখ টন।
সংকটময় পরিস্থিতিতে কয়লার ব্যবহার প্রসঙ্গে ইজাজ আহমেদ বলেন, কয়লার দাম বাড়ে সবার পরে, কমেও সবার পরে। কাজেই সেখানে আমাদের আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ঝামেলা হলে এর প্রভাব সারাবিশ্বেই পড়ে। দামের একটা বড় পরিবর্তন দেখা যায়। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে যে সংঘাত তৈরি হয়েছে, এটা বলা যাচ্ছে না সামনে কোন দিকে যাবে। আর এটারও কোনো বিকল্পও নেই। স্বাভাবিকভাবে সবাই এফেক্টেড হবে। তবে, আমরা চেষ্টা করছি যাতে কোনো সমস্যা না হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থাটা আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের অধিকাংশ তেল আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। গ্যাসেরও একটা বড় জায়গা কাতার ও ওমান। পরিস্থিতি এখনও খারাপের দিকে যায়নি। এটা নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
ওএফএ/এসকেডি