আইডিয়ালে লুটপাটের তুঘলকি কাণ্ড, আত্মসাৎ ৩০২ কোটি টাকা
আর্থিক অনিয়মের তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে রাজধানীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। গত এক দশকে প্রতিষ্ঠানের নানা খাতে ব্যয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ এবং লুটপাট হয়েছে ৩০২ কোটি টাকা। পুরো আর্থিক অনিয়মের পেছনে সাবেক একজন অধ্যক্ষ, গভর্নিং বডির সভাপতি এবং একজন সহকারী প্রকৌশলীর দায় মিলেছে। ঢাকা পোস্টের নিজস্ব অনুসন্ধান এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে অর্থ তছরুপের ভয়াবহ এ চিত্র উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গভর্নিং বডির মিটিং হলেই সম্মানী হিসেবে সভাপতি ২৫ হাজার, সদস্য ছয় হাজার এবং অফিস সহকারী নেন তিন হাজার টাকা। কোনো কারণ ছাড়াই মাসে চারটি মিটিং করে লাখ টাকা সম্মানী নেন খোদ সভাপতি। শুধু তা-ই নয়, নৈমিত্তিক ছুটি না কাটানোর বিপরীতে শিক্ষকরা নিয়েছেন ২০ কোটি টাকা। যোগ্য হওয়ার আগেই পদোন্নতি দিয়ে ৫২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি চক্র। টেন্ডার ছাড়াই নগদ খরচ করা হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা এবং এফডিআরের ৭০ কোটি টাকার লাভ নিজেদের পকেটে পুরেছেন চক্রের সদস্যরা। সবার অজান্তে একাধিক বেসরকারি ব্যাংকে হয়েছে অস্বাভাবিক লেনদেন!
বিজ্ঞাপন
গভর্নিং বডির মিটিং হলেই সম্মানী হিসেবে সভাপতি ২৫ হাজার, সদস্য ছয় হাজার এবং অফিস সহকারী নেন তিন হাজার টাকা। কোনো কারণ ছাড়াই মাসে চারটি মিটিং করে লাখ টাকা সম্মানী নেন খোদ সভাপতি। শুধু তা-ই নয়, নৈমিত্তিক ছুটি না কাটানোর বিপরীতে শিক্ষকরা নিয়েছেন ২০ কোটি টাকা। যোগ্য হওয়ার আগেই পদোন্নতি দিয়ে ৫২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে একটি চক্র। টেন্ডার ছাড়াই নগদ খরচ করা হয়েছে ৪৪ কোটি টাকা এবং এফডিআরের ৭০ কোটি টাকার লাভ নিজেদের পকেটে পুরেছেন চক্রের সদস্যরা। সবার অজান্তে একাধিক বেসরকারি ব্যাংকে হয়েছে অস্বাভাবিক লেনদেন!
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি একজন সচিব। তিনি সরকারি কর্মকর্তা হয়ে কীভাবে মাসে এক লাখ টাকার বেশি সম্মানী নেন? তার স্বাক্ষরে এত বড় আর্থিক জালিয়াতি হলো— এর দায় তিনি এড়াতে পারেন কি না? এই গভর্নিং বডি ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
আরও পড়ুন
রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত আইডিয়ালের মূল শাখা ছাড়াও বনশ্রী ও মুগদায় আরও দুটি শাখা রয়েছে। তিন শাখায় বাংলা, ইংরেজি, প্রভাতী ও দিবা ভার্সন মিলে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২৪ হাজার ৫০৫ জন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন, পরীক্ষা ফি, উন্নয়ন ফিসহ নানা খাতে আদায় করা হয় অর্থ।
হাতে রেখে ৭৮ কোটি টাকা খরচ
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, আইডিয়ালের মতিঝিল মূল শাখার কলেজ, মাধ্যমিকের বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম মিলিয়ে মোট ৭৮ কোটি ৪১ লাখ ২৭ হাজার ৩১৭ টাকা হাতে রেখে খরচ দেখানো হয়েছে। যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট শাখার একজন কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা হাতে রাখার বিধান থাকলেও শুধু একটি শাখা ৭৮ কোটি টাকা খরচ করেছে— এটা তো সরাসরি আত্মসাৎ! এমন অনিয়মে প্রতিষ্ঠান-প্রধান ও জিবির (গভর্নিং বডি) সভাপতির বিরুদ্ধে এসআরও ১৫৭ ধারায় মামলা করা যায়।
আরও পড়ুন
এ ছাড়া, সহকারী শিক্ষকরা নির্দিষ্ট বেতন-ভাতার বাইরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা নিয়েছেন। যা আত্মসাতের শামিল। এ টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, মতিঝিল কলেজ শাখায় ২০১২ সালের ৩০ জুন থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত নানা খাতে ১১ লাখ ৬৭ হাজার ২৯০ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। একই সময়ে মতিঝিলে বাংলা শাখা থেকে পাঁচ কোটি ৪৩ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৫ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ইংরেজি শাখা হতে ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
নৈমিত্তিক ছুটির নামে ২০ কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈমিত্তিক ছুটি (সিএল) না নিলে শিক্ষকরা সম্মানী পান না। কিন্তু এ খাতে গত ১০ বছরে ২০ কোটি ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪৮ টাকা নিয়েছেন আইডিয়ালের শিক্ষকরা। এর প্রমাণ রয়েছে ঢাকা পোস্টের হাতে। এতে দেখা যায়, অধ্যক্ষ নিজের প্যানেলের শিক্ষকদের মনমতো নৈমিত্তিক ছুটি বাবদ টাকা ভাগ করে দিয়েছেন।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আইডিয়াল স্কুলে ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ না করায় তিন শাখার শিক্ষক-কর্মচারীরা মোট ২০ কোটি ৫৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮৪৮ টাকা সম্মানী পেয়েছেন। এর মধ্যে মতিঝিল শাখার বাংলা ভার্সনে সাত কোটি ১২ লাখ ৭০ হাজার, মতিঝিল কলেজ শাখায় দুই কোটি ৩২ লাখ ১৬ হাজার টাকা, বনশ্রী বাংলা ভার্সনে পাঁচ কোটি ৭৯ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, মুগদা বাংলা ভার্সনে তিন কোটি নয় লাখ ৫১ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যা বলছেন তা আমার যোগদানের আগের সময়কার। তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।
আরও পড়ুন
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক বেলাল হোসাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সারা বছরই নানা ধরনের ছুটি ভোগ করেন শিক্ষকরা। তারপরও তাদের সামান্য নৈমিত্তিক ছুটি আছে। এটা না নিলে সম্মানী দেওয়ার বিধান নেই। যদি নিয়ে থাকে তা আত্মসাতের শামিল।
সময়ের আগেই পদোন্নতি, নিলেন অতিরিক্ত অর্ধ কোটি টাকা
ঢাকা পোস্টের কাছে আসা নথিপত্রে দেখা যায়, এ প্রতিষ্ঠানের ২২ জন শিক্ষককে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করার আগেই বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষক রয়েছেন ১৭ জন, নন-এমপিওভুক্ত পাঁচজন। তারা বেতন-ভাতার বাইরে অতিরিক্ত ভাতা হিসাবে ৫২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। তাদের অধিকাংশই নির্ধারিত সময়ের আগে পদোন্নতি এবং টাইম-স্কেল গ্রহণ করেছেন। এ তালিকায় সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফওজিয়া রাশীদও রয়েছেন।
প্রথমে ইউনিয়ন ব্যাংক মতিঝিল শাখায় ৫০ কোটি টাকার এফডিআর করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে তা ধানমন্ডিতে স্থানান্তর করেন সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। গভর্নিং বডির অনুমতি ছাড়াই তিনি রামপুরার ইসলামী ব্যাংকে অন্য একটি অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন শুরু করেন। যাতে ব্যাপক গরমিলের তথ্য রয়েছে
বিধিবহির্ভূত ৭০ কোটি টাকার এফডিআর
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইডিয়াল স্কুলে পাঁচটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকার বিধান থাকলেও তিনটি বেসরকারি ব্যাংক- ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫০ কোটি এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২০ কোটিসহ ৭০ কোটির টাকার এফডিআর (ফিক্স ডিপোজিট) আছে আইডিয়ালের নামে।
সূত্র মতে, প্রথমে ইউনিয়ন ব্যাংক মতিঝিল শাখায় ৫০ কোটি টাকার এফডিআর করা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে তা ধানমন্ডিতে স্থানান্তর করেন সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম। গভর্নিং বডির অনুমতি ছাড়াই তিনি রামপুরার ইসলামী ব্যাংকে অন্য একটি অ্যাকাউন্ট খুলে লেনদেন শুরু করেন। যাতে ব্যাপক গরমিলের তথ্য রয়েছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সাবেক অধ্যক্ষ শাহান আরা ও সহকারী প্রকৌশলী আতিকুল ইসলাম রাজধানী বনশ্রীতে এভারকেয়ার নামে একটি বেসরকারি স্কুল এবং ভিশন- ৭১ নামে একটি হাউজিং কোম্পানি গঠন করেন। বিধিবহির্ভূত ক্যাশ টাকা এ অ্যাকাউন্টে রেখে পরে সুবিধা মতো সময়ে তা উত্তোলন করতে তিনি রামপুরায় অবস্থিত ইসলামী ব্যাংকের শাখায় লেনদেন শুরু করেন।
আরও পড়ুন
২০১৯ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির পরিপত্রের অনুচ্ছেদ ৪৫ (১) অনুযায়ী, নিকটবর্তী কোনো তফসিলি ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের সমস্ত তহবিল, সকল আয় জমা করতে হবে। এ নিয়ম লঙ্ঘন করে শাহান আরা মতিঝিল থেকে ধানমন্ডিতে বেসরকারি ইউনিয়ন ব্যাংকে ৫০ কোটি টাকা ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ২০ কোটি টাকা এফডিআর করে রাখেন। এ বিষয়ে জিবি ও প্রতিষ্ঠান-প্রধানের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর।
আর্থিক নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ আদায় ও ব্যয় শুরু হয় ২০২০ সালের ১ মে থেকে। এর আগে ম্যানুয়ালি অফিসের মাধ্যমে নগদ অর্থ আদায় ও ব্যয় হতো। এ সুযোগে অধ্যক্ষ সমস্ত ক্যাশ টাকা ইসলামী ব্যাংকের রামপুরা শাখায় লেনদেন করতেন।
বনশ্রী-মুগদা শাখায় তছরুপ ১০ কোটি টাকা
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষাবোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি ছাড়াই ১৩ বছর ধরে চলছে আইডিয়ালের বনশ্রী ও মুগদা শাখার কার্যক্রম।
বনশ্রী শাখার বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, গভর্নিং বডির অনুমতিক্রমে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা নগদ হাতে রাখা যায়। কিন্তু ১০ বছরে এ শাখা ১৪ কোটি ৯০ লাখ ১৯ হাজার টাকা হাতে রেখে খরচ করেছে। এ ছাড়া, বাংলা শাখার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা জরিমানা, প্রশংসাপত্র, প্রত্যয়নপত্র, ডুপ্লিকেট ডায়েরি, সিলেবাস, টিসি, শাখা ট্রান্সফার, বয়স কারেকশন, পে-অর্ডার, শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার পে-অর্ডার, পাবলিক পরীক্ষার আয়, ব্যাংক মুনাফা থেকে গত ১০ বছরে পাঁচ কোটি ১৯ লাখ পাঁচ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। একই খাতে ইংরেজি ভার্সনে ৯৪ লাখ ৪৪ হাজার ১৯৭ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। একই খাতে মুগদা শাখা থেকে দুই কোটি ১২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ শাখায় চার কোটি ৫৯ লাখ ৩২ হাজার টাকা হাতে রেখে খরচ করা হয়েছে। কোন খাতে টাকা খরচ করা হয়েছে, তা দেখাতে পারেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। জেনারেটর জ্বালানি বাদে শুধু মেরামত বাবদ নয় লাখ ৭৬ হাজার ১৭৬ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। যার কোনো বিল-ভাউচার নেই এবং কতটি জেনারেটর রয়েছে তার সঠিক তথ্যও দিতে পারেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসআরও (সংবিধিবদ্ধ নিয়ামক আদেশ) ১৫৭ (১) (২), (৩), (৪) ও (৫) ধারা মোতাবেক প্রতিষ্ঠান-প্রধান ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
তহবিলের ১৪ কোটি টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা
প্রতিষ্ঠানের সাধারণ তহবিলের প্রায় ১৪ কোটি টাকার কোনো হদিস পায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিরীক্ষা অধিদপ্তর। সংস্থাটির কাছে এ তহবিলের টাকার কোনো হদিস দিতে পারেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সাধারণ তহবিলের ১৩ কোটি ৮১ লাখ ১১ হাজার ৫০ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে এবং ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ টাকার হিসাবে গরমিল রয়েছে। এ অর্থ গভর্নিং বডির সদস্যদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আদায় করে সরকারি কোষাগারে দিতে বলেছে নিরীক্ষা অধিদপ্তর।
জিবির সভাপতির অস্বাভাবিক ব্যয়
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি ও সদস্যরা বৈঠকের নামে অস্বাভাবিক সম্মানী নিয়েছেন। সভাপতি প্রত্যেক বৈঠকে সম্মানী নিয়েছেন ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া, প্রত্যেক সদস্য ছয় হাজার, অফিস সহকারী তিন হাজার টাকা করে সম্মানী নিয়েছেন। সভাপতি প্রত্যেক মাসে মোবাইল বিল বাবদ নেন পাঁচ হাজার টাকা।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর এসব অর্থ ‘আত্মসাৎ’ হিসেবে উল্লেখ করে তা অবিলম্বে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে সুপারিশ করেছে। এ দায়ে বর্তমান গভর্নিং বডি ভেঙে নতুন করে গভর্নিং বডি গঠনের সুপারিশ করে অধিদপ্তর।
সুপারিশে অধিদপ্তর বলছে, এ টাকা পাবলিক মানি। তাই এ টাকার যথেচ্ছ ব্যবহার সরকারি অর্থের অপচয় ও অনিয়ম। এর দায়ে প্রতিষ্ঠান-প্রধানের বেতন-ভাতা স্থগিত বা বাতিল করা যেতে পারে এবং পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ শূন্য ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে কোটি কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। অথচ, নির্মাণকাজের বিষয়ে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে না জানিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরকে দিয়ে করানো হয়েছে। এ বিষয়ে জিবি ও অধ্যক্ষ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সংস্কার উন্নয়নের নামে লুটপাট ৪৪ কোটি টাকা
ঢাকা পোস্টের হাতে আসা বিভিন্ন নথিপত্রে দেখা যায়, আইডিয়াল স্কুলে তিনটি শাখায় বিভিন্ন সময়ে ভবন সংস্কার, কমন রুম সংস্কার, সৌন্দর্য বর্ধনের মতো ছোট ছোট কাজ হয়েছে। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত পূর্ত কাজ সংক্রান্ত ৩১ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা ব্যয়ের ৭০টি ভাউচার নিরীক্ষা করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ২৫ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে হলে পূর্ত কার্যপ্রক্রিয়ায় আরএফও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ তা না করে নগদ প্রক্রিয়ায় কাজ করেছে। যা পিপিআর ও পিওএফপির ব্যত্যয়। একই ধরনের আরও ৪৯টি ভাউচার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, একই পদ্ধতিতে ১৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যয় করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিধি বহির্ভূতভাবে এসব পূর্ত কাজের ৩১ কোটি টাকা পরিশোধের জন্য চিঠি দেওয়া হবে।
পুরো অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম বলেন, ‘প্রতি বছর আয়-ব্যয়ের হিসাব গভর্নিং বডির কাছে দেওয়া হয়েছে।’ এর বাইরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
এমন অনিয়মের বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানের তদন্তে ভয়াবহ নিয়োগ দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। শুধু আইডিয়াল নয়, দেশের বড় ও মাঝারি সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভয়াবহ আর্থিক জালিয়াতি হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর দায় এড়াতে পারে না।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আইডিয়াল স্কুলের তদন্ত প্রতিবেদনটি মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। অনেক বড় প্রতিবেদন। এর খুঁটিনাটি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি জানান, এর আগে এমন প্রতিবেদনের আলোকে মনিপুর স্কুলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।
আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান জিয়াউর কবির দুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘স্কুলের অন্যতম দুর্নীতির খাত ভর্তি বাণিজ্য। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে তা এড়িয়ে যাওয়া রহস্যজনক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি, শিক্ষাবোর্ড, ডিআইএ— সবাই এ ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় এখানে কেউ হাত দিতে চায় না।’
‘গভর্নিং বডির সভাপতি একজন সচিব। তিনি ২০১৭ সাল থেকে আছেন। তার আমলে যেসব অনিয়ম ও ভর্তি বাণিজ্য হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ছুটি বিক্রি হয়, এটা পৃথিবীর কোথাও নেই! কিন্তু আইডিয়াল স্কুলে ছুটি বিক্রি হয়েছে ২০ কোটি টাকায়! একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি ৩০০ কোটি টাকার বেশি অনিয়ম হয় তাহলে বুঝতে হবে এর সঙ্গে কোন মহলের লোক জড়িত।’
এনএম/এসকেডি