গত এক দশকে দেশে হু-হু করে বেড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে ওঠা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিকে যেমন মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, অন্যদিকে মাত্র চার মাসে সেমিস্টার শেষ করায় শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপে পড়তে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ইউজিসির পক্ষ থেকে কারিকুলাম নবায়ন করে ছয় মাসে সেমিস্টার পরিচালনার কথা বলা হলেও সেই নির্দেশনা পাত্তা দিচ্ছে না বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, শান্ত-মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটিসহ বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসির নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজেদের ইচ্ছামতো চার মাসের বাণিজ্যিক সেমিস্টার পরিচালনা করছে। চার মাসের সেমিস্টার নিয়ে একদিকে যেমন শিক্ষাবিদদের দ্বিমত রয়েছে, তেমনি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগও রয়েছে বিস্তর।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, বেসরকারি ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে ইউজিসিকে তোয়াক্কা না করার একটা প্রবণতা দীর্ঘদিনের। যত বেশি সেমিস্টার তারা পরিচালনা করবে তত বেশি লাভ তাদের।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, শান্ত-মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, নর্দান ইউনিভার্সিটিসহ বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই ইউজিসির নির্দেশনা উপেক্ষা করে নিজেদের ইচ্ছা মতো চার মাসের বাণিজ্যিক সেমিস্টার পরিচালনা করছে। চার মাসের সেমিস্টার নিয়ে একদিকে যেমন শিক্ষাবিদদের দ্বিমত রয়েছে, তেমনি শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগও বিস্তর

নতুন সেমিস্টার মানে নতুন করে ভর্তি

নতুন সেমিস্টার মানে নতুন করে ভর্তি, আর বিভিন্ন ধরনের ফি তো আছেই। বিষয়টি কখনোই শিক্ষাবান্ধব নয়— বলছেন শিক্ষাবিদরা। তাদের মতে, পৃথিবীর অনেক দেশে ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতি আছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এমনকি সার্কভুক্ত দেশ ভারত ও শ্রীলঙ্কাসহ বিশ্বের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ৬ মাসের সেমিস্টার পদ্ধতি অনুসরণ করে।

একটি সেমিস্টারে যেহেতু একাধিক কোর্স থাকে সেহেতু অল্প সময়ে এতগুলো কোর্স শেষ করলে ইন ডেপথ কিছুই শেখানো সম্ভব নয়। ছয় মাসে যেখানে এসব কোর্স শেষ করতে বেগ পেতে হয় সেখানে চার মাসে সেমিস্টার শেষ করা কতটা প্রাসঙ্গিক, প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার শুধু একাডেমিক ক্লাস নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার জন্য কতটুকু সময় পাচ্ছেন সেটাও ভেবে দেখার সময় এসেছে।

মানা হচ্ছে না ইউজিসির নির্দেশনা

যেনতেনভাবে সেমিস্টার শেষ করার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে উচ্চশিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে ২০১৭ সালে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বছরে দুই সেমিস্টার চালু করার নির্দেশনা দেন। পরবর্তীতে ২০২২ সালেও চার মাসের সেমিস্টার পদ্ধতির পরিবর্তে ছয় মাসে সেমিস্টার শেষ করার নির্দেশ দেয় ইউজিসি। কিন্তু মত-দ্বিমতের নানা যোগ-বিয়োগ শেষে এখনও আলোর মুখ দেখেনি ইউজিসির সেই নির্দেশনা। এতে একদিকে ইউজিসি যেমন ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দারে’ পরিণত হয়েছে, তেমনি কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

বিস্তর অভিযোগ অভিভাবকদেরও

চার মাসের সেমিস্টার পদ্ধতি নিয়ে অভিযোগ রয়েছে অভিভাবকদেরও। মাস না যেতেই অর্থের জোগাড় আর সন্তানদের যান্ত্রিক পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েও সংশয়ে তারা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী কাউসার আহমেদের পিতা মো. আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ছেলেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াচ্ছি। প্রতিদিন ক্লাস নেয় ওদের। কী পড়ায়, কীভাবে পড়ায়, বুঝি না। সপ্তাহের বেশির ভাগ সময় হোস্টেলে বসে কী পড়ে, আল্লাহ ভালো জানেন। পড়াশোনা যেমনই হোক পরীক্ষা খরচ, এই ফি-সেই ফি যথাসময়ে দিতে হয়। দিতে দেরি হলে জরিমানাও করা হয়।’

‘কয়েক দিন যেতে না যেতেই সেমিস্টার ফি জোগাড় করতে হয়। মাথায় একটা চাপ যেন লেগেই থাকে। এক বছরে দুবার সেমিস্টার ফি দেবার নিয়ম বা সেমিস্টার চললে ভালো হতো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফি নিয়েই চিন্তায় থাকে। তারা কী শেখাতে পারল, সেদিকে তাদের খেয়াল নেই।’

বাড়ছে শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা

রাজধানীর ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ। তিনি বলেন, একটি পরীক্ষা শেষ না হতেই প্রস্তুতি নিতে হয় অন্য পরীক্ষার। একটি সেমিস্টারের ফি পরিশোধ না করতেই শুরু হয় আরেকটি সেমিস্টার নিয়ে ভাবনা। একের পর এক পরীক্ষা আর অ্যাসাইনমেন্ট করতে করতে মস্তিষ্ক অনেক সময় কাজ করে না। এদিকে, মাস না ঘুরতেই সেমিস্টার ফি পরিশোধের চাপ তো আছে।

‘আমি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। বাবা টাকা-পয়সা দিতে পারেন না। নিজের আয় দিয়ে পড়াশোনা করি। অল্প সময়ে এমন চাপ খুবই কঠিন।’

একই অভিযোগ অপর শিক্ষার্থী ইসমাম হোসেনের। তিনি বলেন, পরীক্ষা তো লেগেই থাকে। ক্লাস শেষ না হতেই, কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরীক্ষা। আগে তো আমাকে শেখাতে হবে, আমাকে সময় দিতে হবে। আর পরীক্ষা এলেই তো আর্থিক চাপ আছে। পরীক্ষা আমাদের কাছে একটা ভীতির মতো হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন মানসিক চাপে ভুগে শেষমেশ মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছি।

চার মাসে সেমিস্টার : তৈরি হচ্ছে শিখন ঘাটতি

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় চার মাসে সেমিস্টার পরিচালনা করছে তাদের বেশির ভাগই নামমাত্র ক্লাস নিচ্ছে। সপ্তাহে মাত্র দুই থেকে তিন দিন ক্লাস নিয়ে শেষ করা হচ্ছে একাধিক কোর্স। নামমাত্র সিলেবাস শেষে শিক্ষার্থীদের বসতে হচ্ছে পরীক্ষার হলে। একটি পরীক্ষা শেষ না হতেই আরেকটি সেমিস্টারের জন্য নিতে হচ্ছে প্রস্তুতি। ফলে একটি সেমিস্টারের একাধিক কোর্স সঠিকভাবে সম্পন্ন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এতে অল্প-সংখ্যক ক্লাস, অদক্ষ শিক্ষক আর গতানুগতিক কোর্স ডিজাইনে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে উচ্চশিক্ষার সনদ।

ভোগান্তির আরেক নাম রি-অ্যাডমিশন

একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন টাকা সংগ্রহের মেশিনে পরিণত হয়েছে। চার মাসের সেমিস্টার পদ্ধতিতে আমরা পর্যাপ্ত ক্লাস পাচ্ছি না। একটা পরীক্ষা শেষ না হতেই আরেকটি পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট...। এভাবেই সব শেষ হচ্ছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেমিস্টার শেষ!

এদিকে, বেসরকারি ইউনিভার্সিটি যত বেশি সেমিস্টার চালাবে তাদের লাভ তত। একজন শিক্ষার্থী একটু খারাপ ফল করলেই রি-অ্যাডমিশন নিতে হয়। প্রথমবার রি-অ্যাডমিশনে ১০ হাজার টাকা গুনতে হয়। পরবর্তীবার ২০ হাজার, এভাবেই চলছে। চক্রাকারে যেন বাড়তেই থাকে। শিক্ষার্থীদের অনেকে ভালো ফল করে, আবার অনেকে একটু খারাপ ফল করতেই পারে। বর্তমান সেমিস্টার পদ্ধতিতে অতিরিক্ত টাকা যারা গুনতে পারছে না তাদের কেউ কেউ ঝরে পড়ছে। অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে অল্প মার্কসেও রি-অ্যাডমিশন নিতে হয়। এখানেই মালিকপক্ষের লাভ।

বছরে তিন সেমিস্টার : বিপক্ষে মত শিক্ষাবিদদের

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক এম তারিক আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার্থীদের থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং পরীক্ষার মাধ্যমে বারবার মূল্যায়ন করাই যদি স্বল্প মেয়াদি সেমিস্টার পদ্ধতির উদ্দেশ্য হয় তাহলে এ সেমিস্টার পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের পরিবর্তে ক্ষতিই বেশি করবে।

‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে চার মাসের পরিবর্তে ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতি বেশি ফলপ্রসূ। কারণ, বছরের বিভিন্ন ছুটি, দুর্যোগসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি থেকে যায়। ফলে স্বল্প সময়ে সেমিস্টার শেষ হলে সেটা তাড়াহুড়ো করেই শেষ করতে দেখা যায়। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য একদিকে যেমন বাড়তি চাপ তৈরি করে, অন্যদিকে তাদের কারিকুলাম পুরোপুরি শেষ হয় না। ফলে নানাভাবে জোড়াতালি দিয়েই সেমিস্টার শেষ হয়। এ কারণে বছরে তিনটি সেমিস্টারের পরিবর্তে দুটি সেমিস্টার হলে শিক্ষার্থীদের জন্য ইতিবাচক হবে।’

‘একই সঙ্গে আমাদের ইউনিভার্সিটিগুলোতে ঘনঘন পরীক্ষা নির্ভরতা কমিয়ে প্রজেক্ট বেজড লার্নিং, প্রবলেম সলভিং বেজড লার্নিংয়ের ওপর জোর দেওয়া উচিত। শিক্ষার্থীরা যত বেশি জ্ঞান প্রয়োগ করে সমস্যার সমাধান করতে শিখবে, কর্মজীবনে তারা ততই দক্ষ হয়ে উঠবে। শুধু সেমিস্টার পদ্ধতিই নয় বরং শিক্ষা পদ্ধতির একটি সার্বিক পরিবর্তন জরুরি।’

ড. আহসান বলেন, একটি বিশ্ববিদ্য়ালয়ের প্রধান কাজ হলো নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা। কিন্তু খুবই উদ্বেগজনক যে, বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই নির্দিষ্ট কিছু কারিকুলাম অনুসরণ করে, শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করিয়ে এবং পরীক্ষা নিয়ে মূল্যায়ন ও সনদ দেয়। প্রক্রিয়াটি আসলে উচ্চশিক্ষার জন্য কোনোভাবেই প্রযোজ্য নয়। মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা খুব একটা কাজেও আসে না। যত বেশি গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা যাবে ততই উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য সফল হবে। পাশাপাশি গণহারে উচ্চশিক্ষার চর্চাটাও কমে যাবে। পাশের দেশগুলোতে দেখা যায়, তাদের শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে চলে যায়। আর যারা সত্যিই গবেষণা করতে চায় শুধু তারাই উচ্চশিক্ষায় আসে। আমাদের দেশে পদ্ধতিটা নিয়ে আসা খুবই জরুরি। এটি করতে না পারলে উচ্চশিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে সনদ বিক্রির এ সংস্কৃতি বন্ধ হবে না।

এ বিষয়ে দেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের সহসভাপতি ড. মনজুর আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যথা সময়ে ক্লাস, পরীক্ষা ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ করার লক্ষ্যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত। এখানে ইউজিসি ও ইউনিভার্সিটিগুলোর গাফিলতি রয়েছে। ইউজিসি যে নিয়ম বাতলে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে নিয়ম নামমাত্র পালন করে। অপরদিকে, ইউজিসি শুধু নিয়ম-কানুন দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্মত শিক্ষা দিচ্ছে কি না, সেদিকে তাদের কোনো খেয়াল থাকে না।’

বছরে তিন সেমিস্টারের পরিবর্তে দুই সেমিস্টার চালু করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দফায় দফায় নির্দেশনা দিলেও বর্তমানে মুখে কুলুপ এঁটেছে ইউজিসি। তাদের এ নির্দেশনা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর পর তারা যেন নীরব আত্মসমর্পণ করেছে। ইউজিসির দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের চাপে অসহায় হয়ে পড়ছে ইউজিসি। এপিইউবি’র একাধিক সদস্য চার মাসে সেমিস্টার পরিচালনার জন্য ইউজিসিকে বারবার চাপ দিচ্ছে। ফলে কয়েক দিন আগেও ইউজিসি ছয় মাসের সেমিস্টারের কথা বললেও বর্তমানে নিশ্চুপ রয়েছে

‘পৃথিবীর কিছু দেশে চার থেকে সাড়ে চার মাসে সেমিস্টার পরিচালনা করার উদাহরণ আছে। কিন্তু তাদের কোর্স ডিজাইন, শিখন পদ্ধতি, ক্লাস ও গবেষণা কার্যক্রমে একটি সুন্দর সমন্বয় আছে, দায়িত্ববোধ আছে। কিন্তু আমাদের দেশের ইউনিভার্সিটি এবং তাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসর সে সদিচ্ছা ও সক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছয় মাসে সেমিস্টার। সেমিস্টারে একটু বেশি সময় পেলে শিক্ষার্থীদেরও একটু ইন ডেপথ পড়ানো যায়। শিক্ষকরাও গবেষণার জন্য কিছুটা সময় পান। কিন্তু বর্তমান সেমিস্টার পদ্ধতিতে ১২ থেকে ১৩টি ক্লাস থাকে। এর মাঝেই একটি সেমিস্টারের সবকিছু শেষ করতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষ এ সংখ্যা কিছু কম-বেশি হয়।

‘আমি দায়িত্বপালনকালে চেষ্টা করেছিলাম চার মাসের পরিবর্তে ছয় মাসের সেমিস্টার করতে। কিন্তু সফল হয়নি। বেসরকারি ইউনিভার্সিটির মালিক সমিতি সেটা মানতে চায় না।’

তবে, শিক্ষার মান আরও বাড়াতে হলে চার মাসের সেমিস্টার পদ্ধতির পরিবর্তে ছয় মাসের করা উচিত। ইউজিসির সাবেক এ চেয়ারম্যান আরও বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতি মনে করে ছয় মাসে সেমিস্টার হলে তাদের আর্থিক ক্ষতি হবে। তবে, আমি সেটা মনে করি না। কারণ, শিক্ষার্থীদের থেকে তো নির্ধারিত পরিমাণ টাকাই নেওয়া হবে।

‘মালিক সমিতিতে যারা আছেন তারা অনেক পাওয়ারফুল। আমি অনেক উদ্যোগ নিয়েও সেগুলো শেষ করতে পারিনি। এদিকে, মন্ত্রণালয় সারাক্ষণ দায়মুক্ত থাকে। তারা দায় চাপাতে পারলেই বাঁচে। ইউজিসির ওপর দায় দিয়ে বসে থাকাই একটা নিয়ম হয়ে উঠেছে। অথচ, ইউজিসির নির্বাহী কোনো ক্ষমতা নেই। আমলারাই সবকিছুর মূল কারণ।  ভালো কাজ আমলারাই করে, সর্বনাশটাও তাদের হাত ধরেই হয়।’

ইউজিসির সুপারিশে ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতিতে যারা আসেনি মন্ত্রণালয় চাইলে তাদের বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নিতে পারত— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তাদের একটা এক্সিকিউটিভ বডি আছে। ইউজিসি শুধু পরামর্শ দিতে পারে কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। কারণ, মন্ত্রণালয়ের যে সচিব তিনি চ্যান্সেলর এরও সচিব। মন্ত্রণালয় তাদের দায় এড়ানোর জন্যই নানা কথা বলে।’

ইউজিসির নির্দেশনা মানবে না এপিইউবি

ইউজিসি দফায় দফায় ছয় মাসে সেমিস্টার পরিচালনার নির্দেশনা দিলেও এর তোয়াক্কা করছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যেক্তাদের সংগঠন এপিইউবি। ইউজিসির নির্দেশনা উপেক্ষা করে চলতি বছর জুলাইতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাফ জানিয়ে দেয় তারা। বলে, বছরে তিন সেমিস্টার করেই চালাতে চায় তারা। তাদের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন আছে কি না, তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।

দীর্ঘদিন একই নির্দেশনা দিচ্ছে ইউজিসি। কিন্তু ইউজিসির এ সিদ্ধান্ত মানবে না বলে জানিয়েছে এপিইউবি। বিষয়টি সম্পর্কে কী বলবেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাই না

মুখে কুলুপ : নীরব আত্মসমর্পণ ইউজিসির

বছরে তিন সেমিস্টারের পরিবর্তে দুই সেমিস্টার চালু করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দফায় দফায় নির্দেশনা দিলেও বর্তমানে মুখে কুলুপ এঁটেছে ইউজিসি। তাদের এ নির্দেশনা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর পর তারা যেন নীরব আত্মসমর্পণ করেছে। ইউজিসির দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের চাপে অসহায় হয়ে পড়ছে ইউজিসি। এপিইউবি’র একাধিক সদস্য চার মাসে সেমিস্টার পরিচালনার জন্য ইউজিসিকে বারবার চাপ দিচ্ছে। ফলে কয়েক দিন আগেও ইউজিসি ছয় মাসের সেমিস্টারের কথা বললেও বর্তমানে নিশ্চুপ রয়েছে। এরপর থেকে এ বিষয়ে ইউজিসির প্রায় সব কর্মকর্তা গণমাধ্যম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

কী বলছে ইউজিসি

এ বিষয়ে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ছয় মাসে সেমিস্টার চালাচ্ছে। আমরা কারিকুলাম আপডেট করে সবগুলো ইউনিভার্সিটিকে ছয় মাসে সেমিস্টার পরিচালনার কথা বলে আসছি। নতুন নিয়মে আসতে অনেকের হয়তো সময় লাগছে।

দীর্ঘদিন একই নির্দেশনা দিচ্ছে ইউজিসি। কিন্তু ইউজিসির এ সিদ্ধান্ত মানবে না বলে জানিয়েছে এপিইউবি। বিষয়টি সম্পর্কে কী বলবেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাই না।’

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভংকরের ফাঁকি

ইউজিসির নির্দেশনায় ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতিতে যেন শুভঙ্করের ফাঁকি! বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র একটি কিংবা দুটি বিভাগের সেমিস্টার পদ্ধতি ছয় মাস (বাই সেমিস্টার) করে ফলাও করে জানান দিচ্ছে যে, তারা ইউজিসির নির্দেশনা মানছে। তবে, পর্দার আড়ালে অধিকাংশ বিভাগই চার মাসে (ট্রাই সেমিস্টার) আটকে আছে। এ যেন শুভংকরের ফাঁকি!

দায় এড়াচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়

ইউজিসির অবস্থান শক্তিশালীকরণ এবং তাদের পরামর্শ বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা থাকলেও দায় এড়াচ্ছে মন্ত্রণালয়। এ সমস্যার সমাধান এবং মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবু ইউসুফ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সেমিস্টার পদ্ধতি নিয়ে আমাদের আসলে কিছুই করার নেই। বিষয়গুলো ইউজিসি দেখে। তারাই সব সিদ্ধান্ত নেবে। এর বাইরে আর কিছু বলতে চাই না।

ট্রাই-সেমিস্টারে খরচ তুলনামূলক কম

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিষ্ঠাতা-উদ্যোক্তাদের সংগঠন এপিইউবি সভাপতি শেখ কবির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইউজিসির নতুন নিয়মে বাই-সেমিস্টার নয়, আগের নিয়মে অর্থাৎ ট্রাই-সেমিস্টার পদ্ধতি চালু থাকবে। নতুন নির্দেশনাটি প্রত্যাহার হয়েছে। ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতি যখন নেওয়া হয় তখন আমি দেশের বাইরে ছিলাম। আমি দেশে আসলে তাদের সঙ্গে (ইউজিসি) কথা হয়েছে। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, এখন নয় বরং আলাপ-আলোচনা করে পরে আমরা বাই-সেমিস্টার নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেব। এর আগ পর্যন্ত আগের নিয়মেই চলবে। এ বিষয়ে আমি তাদের চিঠিও দিয়েছি।

কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যদি ইউজিসি নির্দেশিত ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতি পরিচালনা করতে চায় সেক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আছে কি না— এমন প্রশ্নের উত্তরে এপিইউবি সভাপতি বলেন, ‘না, বাধ্যবাধকতা নেই। তবে, আমি মনে করি ছয় মাসের সেমিস্টার পদ্ধতিতে না যাওয়া উচিত। অ্যাসোসিয়েশনের অনুমতি ছাড়া যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এমন কার্যক্রম পরিচালনা করে তাহলে তারা গোত্র-ছাড়া হয়ে যাবে। অ্যাসোসিয়েশনের একটা নিয়ম আছে। সেটার সঙ্গে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের থাকা উচিত। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যারা আগেই ছয় মাসের সেমিস্টার পরিচালনা করছে। তাদের ক্ষেত্রে কিছুই করার নেই। তারা তো আর সেই জায়গা থেকে ফিরে আসতে পারবে না।’

অভিভাবকদের অভিযোগ রয়েছে, ট্রাই-সেমিস্টার পরিচালনা করলে অতিরিক্ত ফি, মানসিক চাপসহ নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। এ প্রসঙ্গে কী বলবেন— উত্তরে শেখ কবির বলেন, ‘আমি মনে করি ট্রাই-সেমিস্টারে খরচ তুলনামূলক কম।’

এমএম/এমএআর/