দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এই মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রে আছে রাজনৈতিক সংলাপ। একাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো এবারও কি সংলাপ হবে নাকি হবে না— এ নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক মহলে। নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে সংলাপ নিয়ে আলোচনা তত গতি পাচ্ছে। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কথার বাহাসেই রয়েছে সংলাপ ইস্যুটি। বিরোধী দলগুলো সংলাপে বসতে শর্ত দিচ্ছে আর ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে শর্তহীন সংলাপ। তবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংলাপ দরকার এবং এজন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ‘ইগো থেকে সরে আসতে হবে’—মনে করছেন রাজনৈতিক দলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ নেতারা।

সংলাপ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এতদিন চুপ থাকলেও বর্তমানে অনেকেই এ নিয়ে মুখ খুলছেন। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও সংলাপ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তবে, দুই পক্ষই শর্তে আটকে আছে। বিএনপি চাচ্ছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ আর আওয়ামী লীগ ‘কোনো শর্তে’ সংলাপে বসতে রাজি নয়। আগে থেকে শর্ত না থাকলে দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে সংলাপ হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদরা।

সংলাপ নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এতদিন চুপ থাকলেও বর্তমানে অনেকেই এ নিয়ে মুখ খুলছেন। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও সংলাপ নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তবে, দুই পক্ষই শর্তে আটকে আছে। বিএনপি চাচ্ছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ আর আওয়ামী লীগ ‘কোনো শর্তে’ সংলাপে বসতে রাজি নয়। আগে থেকে শর্ত না থাকলে দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে সংলাপ হতে পারে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদরা

গতকাল রোববার সচিবালয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংলাপের ব্যাপারে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ যে চারটি শর্ত দিয়েছে বিএনপি সেগুলো প্রত্যাহার করা হলে সংলাপের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। শর্তযুক্ত কোনো আলোচনায় বসবে না আওয়ামী লীগ। এর বাইরে যে পরামর্শ তাতে সরকারের আপত্তি নেই।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘শর্ত দিয়ে কোনো সংলাপ হবে না। শর্ত ছাড়া হলে আমরা সংলাপে বসব। যদি সংলাপ হয় তাহলে এটা সার্থক হতে হবে। আগে থেকে শর্ত দিলে তো সংলাপ সার্থক হবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সংলাপে ওপেন মাইন্ড নিয়ে বসতে চাই। আর ওরা (বিএনপি) বলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানলেই সংলাপে বসবে। তা হলে তো সংলাপ হবে না। কোনো শর্ত দিয়ে আওয়ামী লীগ আসবে না। শর্ত ছাড়া হলে সংলাপ হবে।’

আরও পড়ুন

দলীয় সূত্র মতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য প্রয়োজনে সংলাপে বসতেও রাজি দলটি। আগামী নির্বাচন কীভাবে হবে, বিরোধী দলগুলো কী চায়— সবকিছু সংলাপের মাধ্যমে জানতে চাইবে ক্ষমতাসীনরা। তবে, শর্তের নামে সংলাপকে অন্যদিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা মেনে নেবে না আওয়ামী লীগ— বলছেন একাধিক সিনিয়র নেতা।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেছেন, ‘শর্ত দিয়ে কোনো সংলাপ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর সংলাপ হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি এখনও দেশে সৃষ্টি হয়নি। সংলাপ করার মতো মুখ বিএনপি-জামায়াতের নেই। তারা এখনও ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার ও অগ্নিসন্ত্রাসের রাজনীতিতে মত্ত। শর্ত দিয়ে সংলাপ হয় না।’

সংলাপে বিরোধী দলগুলোকে আনতে তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন আছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সংলাপের জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের প্রয়োজন নেই। এখানে কীসের মিডলম্যান? দেশ চলে সংবিধানে। নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। এখানে আবার মিডলম্যান কী?’

এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়, সে লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনের প্রধান প্রধান বিষয় নিয়ে অর্থবহ আলোচনার সুপারিশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। ঢাকায় বিভিন্ন দলের সঙ্গে সংলাপের পর যুক্তরাষ্ট্রের এ সংক্রান্ত মিশন একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো— বক্তৃতা-বিবৃতির ক্ষেত্রে সহনশীল হয়ে প্রধান নির্বাচনী বিষয়গুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা ও অর্থবহ সংলাপ; মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করে ভিন্ন মতকে সম্মান জানানোর মতো নাগরিক পরিবেশ নিশ্চিত করা; সংঘাতহীন নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িতদের জবাবদিহির আওতায় আনা; স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা, অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব দল যেন অংশ নিতে পারে সেই পরিবেশ তৈরি করা এবং নাগরিকদের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সক্রিয় রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সংস্কৃতির প্রসার ঘটানো।

এর আগে গত ১১ অক্টোবর গুলশানে দলের চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা এলে সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসব। সেই সরকার কীভাবে গঠন হবে, আলোচনা হতে পারে তা নিয়ে। অবশ্যই সরকারকে আগে ঘোষণা দিতে হবে যে, আমরা বিষয়টি মেনে নেব।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সংলাপ করতে সবসময় আগ্রহী। কিন্তু তার আগে সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি সমাধান করতে হবে। বিনা শর্তে আমরা সংলাপ করব না।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোন পথে সংলাপ হবে তার সমাধান সরকারকে বের করতে হবে। জনগণের কল্যাণের কথা ভাবলে সংলাপের পথ খুলবে। বল এখন সরকারের কোর্টে। বিএনপি জনগণের কল্যাণে যা করার তা-ই করছে। সংলাপের বিষয়বস্তু ঠিক করতে হবে সরকারকেই।’

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে রাজনৈতিক সংলাপের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে ছোট ছোট দলগুলোও। তাদের বক্তব্য, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য দেশের বৃহৎ দুই দলকেই সংলাপের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

সংলাপ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সংলাপ করতে হলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলকেই ইগো থেকে সরে আসতে হবে। এক্ষেত্রে একেবারে শর্ত ছাড়া যেমন সংলাপ হয় না, আবার সব শর্ত মেনেও সংলাপ হয় না। আমরা মনে করি, দেশের জনগণকে দল দুটি ভালো বাসলে তারা ইগো না দেখিয়ে সংলাপে বসবে। বর্তমানে দেশে চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে সংকট, তা থেকে মুক্ত হতে একটা সংলাপ খুবই জরুরি।’

সংলাপ নিয়ে জাতীয় পার্টির অবস্থান কী— জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব বলেন, ‘আমরা তো সরকারকে সবসময় সংলাপের আহ্বান করতে বলছি। এখন লোক দেখানো আহ্বান করলে তো হবে না। আমরা সংলাপের পক্ষে আছি।’

আরও পড়ুন

গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সংলাপ কার্যকর হবে কি না, তা সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আমরা মনে করি, সরকার কখন ও কীভাবে পদত্যাগ করবে এবং পদত্যাগের পর অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন প্রক্রিয়ায় হবে— এ দুটি ইস্যুতে সংলাপ হতে পারে। আমি মনে করি, অ্যাজেন্ডা ছাড়া বিরোধী দলগুলো সংলাপে অংশ নেবে না।’

কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় একটা অ্যাজেন্ডা থাকে। পাড়ার ক্লাবের আলোচনায়ও একটা অ্যাজেন্ডা থাকে। ওবায়দুল কাদের সাহেব শর্তহীন সংলাপের কথা বলছেন। কিন্তু অ্যাজেন্ডা ছাড়া সংলাপের কোনো গুরুত্ব নেই। এ ছাড়া, ২০১৮ সালে আমরা আওয়ামী লীগের কথা মতো সংলাপে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কথা রাখেননি। এখন আওয়ামী লীগ পদত্যাগের ঘোষণা দিলে গণতান্ত্রিক একটা পরিবেশ সৃষ্টি হবে, সংলাপ হবে এবং তা সফলও হবে।’

এএইচআর/এমএসআই/