নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে হেফাজতের তাণ্ডব
যানজটকে দুষছে প্রশাসন, অভিযোগের তির এমপির দিকে
নারায়ণগঞ্জের রয়েল রিসোর্টে হেফাজতের নেতা মামুনুল হকের নারীসহ আটকের ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ওই ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে বিলম্বের জন্য যানজটকে দুষছে স্থানীয় প্রশাসন। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, হেফাজতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় এক এমপির অনুসারীরাও হামলায় অংশ নেয়।
এদিকে, হামলার ওই ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বাস্তবায়ন চেয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
বিজ্ঞাপন
গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়েল রিসোর্টে অজ্ঞাত নারীসহ (পরবর্তীতে দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি) হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হককে অবরুদ্ধ করেন স্থানীয়রা। বিষয়টি জানাজানি হলে হেফাজতের স্থানীয় নেতাকর্মীরা অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যান।
মামুনুল হককে ছিনিয়ে নেওয়ার পর রাতেই রয়েল রিসোর্টসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করছিল— এমন প্রশ্নে ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট থাকায় তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি করে’ বলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের কাছে দাবি করে স্থানীয় প্রশাসন। এ সুযোগে ন্যক্কারজনক হামলা চালায় হেফাজতের নেতাকর্মীরা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ওই হামলার ঘটনায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকার লোকজনও জড়িত ছিলেন
তবে, হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগের তির স্থানীয় সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকার দিকে। মামুনুল হকের আটকের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সোনারগাঁ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু ও নারায়ণগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শাহ মো. সোহাগ রনির বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ওই হামলায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সাংসদ লিয়াকত হোসেন খোকার লোকজন অংশ নেয়।
যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন লিয়াকত হোসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আমার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হচ্ছে। ওই ঘটনায় আমি অথবা আমার দলের নেতাকর্মীরা কেউ জড়িত ছিল না। ঘটনার পর আমি রয়েল রিসোর্ট ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেছি।’
সোনারগাঁ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সোনারগাঁয়ে হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে এমপির একটা সখ্যতা আছে। আমার বাড়িতে হামলার সময় এমপির কর্মী রাফি, অপুসহ আরও অনেকে ছিল।’ তিনি আরও বলেন, আমরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এ অভিযোগ করছি না। ওই ঘটনায় তারা যে জড়িত ছিল স্থানীয় মানুষ দেখেছে এবং আমাদের কাছে ভিডিও ফুটেজ আছে। সেখানে তাদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় প্রশাসনের দায় আছে। কারণ, বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ পর্যন্ত মামুনুলের ঘটনা ঘটে। তারপরও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। হেফাজতের কর্মীরা অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। পাল্টা প্রতিরোধ নেওয়ার মতো প্রস্তুতি আমাদের ছিল না।
বুধবার (৭ এপ্রিল) আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলায় হেফাজতের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান দলটির কেন্দ্রীয় একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কার্যনির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন, সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও নজরুল ইসলাম বাবু প্রমুখ।
প্রতিনিধি দল সকাল ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায় পৌঁছায়। এর কাছেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী হাইওয়ের পাশে প্রতিবাদ সমাবেশ করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। প্রতিবাদ সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন।
বেলা ১২টার দিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল সোনারগাঁ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নুর ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি পরিদর্শন করেন। নেতারা ক্ষতিগ্রস্তদের কথা শোনেন এবং সুনির্দিষ্টভাবে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দেন।
পরিদর্শন শেষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল মোগরাপাড়ার একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে। এ সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্বস্ত করতে চাই, দলীয়ভাবে তাদের সহযোগিতা দেবো পুনর্বাসনের জন্য। নেতাদের বলছি, হামলার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য। খুঁজে বের করে সুনির্দিষ্টভাবে মামলা দেওয়ার জন্য। সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে ওই ঘটনায় হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।’
হামলার সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় ১৪/১৫ কিলোমিটার যানজট ছিল। এ কারণে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি করে এবং অ্যাকশন নিতে দেরি হয়ে যায়। এ সুযোগে স্থানীয় নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে হামলা চালায় হেফাজতের নেতাকর্মীরা
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছি, এরপর থেকে এসব ধর্মব্যবসায়ী, যে নামেই তারা বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চাইবে, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে চাইবে, আর বরদাশত করা হবে না। প্রত্যেক জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পাশাপাশি নেতাকর্মীদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। তাদের দমনের জন্য প্রশাসনকে সহযোগিতা করবে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। জনগণকে নিয়েই এদের দমন করা হবে।’
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একই অভিযোগ এখন হেফাজতের বিরুদ্ধে। তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধের সুপারিশ করবেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে হানিফ বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবি করে। কিন্তু তারা অরাজনৈতিক ছদ্মাবরণে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে। আমি আশা করি, রাজনৈতিক নিবন্ধিত দল ছাড়া এ দেশে কেউ যেন রাজনীতি করতে না পারে, কোনো অনৈতিক কাজ করতে না পারে, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে প্রশাসন।’
সোনারগাঁয়ে হামলার ঘটনায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ কে কোন দল করল, সেটা বিবেচ্য নয়। মূল বিবেচ্য হচ্ছে যারা হামলা করেছে তারা সন্ত্রাসী, তারা নাশকতা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সংবাদ সম্মেলন শেষে নারায়ণগঞ্জ সার্কিট হাউজে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনকে বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
বৈঠকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই ঘটনার সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় ১৪/১৫ কিলোমিটার যানজট ছিল। এ কারণে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি করে এবং অ্যাকশন নিতে দেরি হয়ে যায়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংসদে হেফাজতের সহিংসতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন সেটা বাস্তবায়নে যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে হেফাজতে ইসলাম দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালায়। গত ৪ এপ্রিল তাদের চালানো তাণ্ডবের চিত্র জাতীয় সংসদে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘পুলিশ কেন ধৈর্য দেখিয়েছে, এ প্রশ্ন সংসদে এসেছে। আমরা ধৈর্য দেখিয়েছি কারণ, এগুলো থেকে বিরত থাকার জন্য। সংঘাতে সংঘাত বাড়ে, আমরা তা চাইনি। সুবর্ণজয়ন্তী আমরা ভালোবাসার সঙ্গে উদযাপন করতে চেয়েছি। যারা করেছে (তাণ্ডব চালিয়েছে) দেশবাসী তাদের বিচার করবে। আইন তার আপন গতিতে চলবে। এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে- এটুকু আমি শুধু বলতে পারি।’
গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফরের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়।
এইউএ/এমএআর/জেএস