ভ্যাট আদায় ব্যবস্থার ‍দুর্বলতা, বিশেষ করে আদায় প্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন পদ্ধতিতে আনতে না পারা, লেনদেনের বড় একটি অংশ শনাক্তের বাইরে থাকায় প্রায় লাখ কোটি টাকার ভ্যাট অনাদায়ী থেকে যাচ্ছে। খোদ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগের এক হিসাব বলছে, গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে ১১টি খাতের অবদান ১৬ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। খাতগুলোর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট জমা দেওয়ার কথা।

এ হিসাবে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়। কিন্তু আদায় হয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকার সামান্য বেশি। অর্থাৎ প্রায় এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায় থেকে বঞ্চিত দেশ। শতাংশ হিসাবে যা ৪০ শতাংশ। বাস্তবে ব্যবধান আরও বেশি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুসারে, সারাদেশে দোকান মালিক রয়েছেন ৭৫ লাখের বেশি। প্রত্যেকে যদি প্রতি মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকার ভ্যাট সংগ্রহ করেন, সেই হিসাবে বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসার কথা। এর সঙ্গে অন্যান্য খাত এবং বড় বড় ব্যবসায়ীদের ভ্যাট যোগ করলে সংখ্যাটি দ্বিগুণ হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে আদায় হয়েছিল এক লাখ আট হাজার ৪২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সম্ভাবনা ও আহরণের ফারাক বেশ। যদিও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান রাখা ৫০ শতাংশ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ হয়নি। সঙ্গে আছে লাখ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য। সবকিছু হিসাব করলে পরোক্ষ করের নেতৃত্বদানকারী রাজস্ব হিসাবে ভ্যাটের সম্প্রসারণ যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা

অথচ সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২৫ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে আদায় হয়েছিল এক লাখ আট হাজার ৪২০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সম্ভাবনা ও আহরণের ফারাক বেশ। যদিও মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অবদান রাখা ৫০ শতাংশ পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ হয়নি। সঙ্গে আছে লাখ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য। সবকিছু হিসাব করলে পরোক্ষ করের নেতৃত্বদানকারী রাজস্ব হিসাবে ভ্যাটের সম্প্রসারণ যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন >> বৈষম্যে লাগাম টানার হাতিয়ার আয়কর, কতটা পিছিয়ে আমরা?

কেন হচ্ছে না— কারণ হিসেবে আদায় প্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন পদ্ধতিতে আনতে না পারা, লেনদেনের বড় একটি অংশ শনাক্তের বাইরে থাকা, নতুন ভ্যাট আইনের কিছু সীমাবদ্ধতা, তুলনামূলক বেশি ভ্যাট হার, ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) জনপ্রিয় করতে না পারা এবং কর সংস্কৃতি তৈরি করতে না পারাসহ বেশকিছু কারণ উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।



যেমনটি মনে করেন এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা যদি সরকারের হাতেই থাকে, তাহলে যতই উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, নিজ স্বার্থ রক্ষায় এবং অযাচিত হস্তক্ষেপে মাঝপথেই সব উদ্যোগ থেমে যায়। সরকার নিজের সুবিধা মতো কোনো প্রজেক্টে বা কোনো গ্রুপকে কর অব্যাহতি দিচ্ছে। এখানে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের দরকার ছিল। উপজেলায় এত সব সরকারি অফিস, এমনকি নিজস্ব ভবন থাকলেও এনবিআরের অফিস করা যায় না, কিন্তু কেন? অর্থাৎ সরকার নিজেই অফিস খুলতে দিচ্ছে না। একটি অটোমেশনের আওয়াজ তোলা হলেও এনবিআরের কর-ব্যবস্থাপনা অনলাইনভিত্তিক করা সম্ভব হয়নি। বছরের পর বছর ধরে এ কাজ চলছে। সবক্ষেত্রেই বাস্তবায়নের ঘাটতি!’


‘যেমন- ভ্যাট আদায়ের মেশিন এনবিআরকে কিনে দিতে হবে কেন? সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে, ব্যবসায়ীরা নিজ উদ্যোগে এনবিআরের সার্ভেয়ারের সঙ্গে যুক্ত হবেন। এটি না বলে আমি নিজে নিজেই এখন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছি। অর্থাৎ এনফোর্সমেন্টই আসল সমস্যা। অর্থনীতিতে বিরাট বৈষম্য বিরাজ করছে। এ বৈষম্য নিরসন করা না গেলে কর-জিডিপির অনুপাত বাড়বে না।’

অন্যদিকে, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন মনে করেন, ‘রাজস্ব আদায়ে সঠিক পথে হাঁটছে না এনবিআর। সঠিক পথে যদি হাঁটত তাহলে ভ্যাট বা রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে থাকত না। যেমন- বাংলাদেশে ৬৮ হাজার গ্রাম হিসাবে গড়ে দুটি করে বাজার থাকে, তাহলে দেড় লাখের মতো বাজার হয়। ওই বাজারে ১০ টাকা কর দেন এমন মানুষ পাবেন না। এমনকি গ্রামের ধনাঢ্য যারা, তারাও আয়কর বা ভ্যাট কি সেটি জানেন না। অথচ, দেশে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু কর আদায়ে পিছিয়ে আমরা। আমাদের আইন আছে, পরিকল্পনাও আছে, নেই তার বাস্তবায়ন।’

আরও পড়ুন >> জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রিতে করের ‘জটিল অঙ্ক’, পকেট ফুরোবে বিক্রেতার

কর-জিডিপি অনুপাত ভ্যাট

সম্ভাব্য ভ্যাট ও প্রকৃত ভ্যাট বা রাজস্ব আহরণের পার্থক্য হলো ট্যাক্স গ্যাপ। উন্নত মানবসম্পদ, পর্যাপ্ত অবকাঠামো, অটোমেশন, সুশাসন ইত্যাদি যত বেশি সে দেশে ট্যাক্স গ্যাপ তত কম। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডের মতো স্ক্যান্ডেনেভিয়ান কিছু দেশের ট্যাক্স গ্যাপ সবচেয়ে কম, গড় হার ৫ শতাংশের নিচে। ফলে তাদের গড় কর-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশের ওপর। অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর গড় ট্যাক্স গ্যাপ প্রায় ১৩-১৫ শতাংশ। গড় কর-জিডিপি অনুপাত ২০ শতাংশের ওপর। অনুমান করা হয়, বাংলাদেশের ট্যাক্স গ্যাপ ৩০ শতাংশের বেশি। যদিও এ বিষয়ে গভীর গবেষণা নেই। ফলে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে।

বাংলাদেশে ভ্যাট-জিডিপি হার কম হওয়ার আরও একটি কারণ হলো কর-সংস্কৃতির অভাব। বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন হারে ভ্যাট অব্যাহতি, ভ্যাট আইন ভালোভাবে না বোঝা, হিসাব সংরক্ষণে অনীহা, ইত্যাদি কারণে ভ্যাট-চেইনের সব লেনদেনের হিসাব সঠিকভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে না বলে মনে করছেন ভ্যাট কর্মকর্তারা।

মহানগরসহ সারাদেশে দোকান মালিক আছেন ৭০ থেকে ৭৫ লাখ। তারা যদি মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা ভ্যাট দেন তাহলে বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসে। এর সঙ্গে অন্যান্য খাতের বড় বড় দোকানির ভ্যাট যোগ হলে পরিমাণটা দ্বিগুণ হতে পারে। এজন্য শহরের সব দোকান-মালিকের ভ্যাট নিবন্ধন নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইএফডি মেশিন সরবরাহ করতে হবে। যদি ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়ে মেশিন ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে বছরে দ্বিগুণ ভ্যাট আদায় সম্ভব



ভ্যাটে দায়মুক্তি, রাজস্ব যায় কার পকেটে

এনবিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জিডিপিতে অবদান রাখা এমন ৫০ শতাংশ পণ্যে ভ্যাট নেই। যার মধ্যে রয়েছে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা ও সেবা খাত। এ খাতগুলো জিডিপিতে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে।

আরও পড়ুন >> ২৮ বছরেও হয় না পদোন্নতি, ফাইলে নেই গতি

জিডিপিতে প্রায় ২৩ শতাংশ অবদান রাখা শিল্পপণ্যের ওপর ভ্যাট নেই। এর মধ্যে রয়েছে- পোশাক শিল্প, বিদেশি পণ্যে নির্ভরতা কমাতে দেশীয় শিল্প হিসেবে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ার কন্ডিশনার, লিফট, মোটর ভেহিকেল, মোবাইল ফোন সেট এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদক প্রতিষ্ঠানসমূহের আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে, ক্ষেত্রবিশেষ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানসমূহকে শর্তসাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনে এপিআই এবং সাবান ও শ্যাম্পুর প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা রয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিভিন্ন পণ্য, যেমন- কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড ইত্যাদি উৎপাদন এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।

পলিব্যাগের পরিবর্তে জিও ব্যাগ ব্যবহার উৎসাহিত করার জন্য কাঁচামাল হিসেবে পিপি ও পিপি স্ট্যাপল ফাইবার, কটন/পুরাতন ব্যাটারি/কালেট/স্ক্যাপ, সৌর-বিদ্যুতের প্যানেল ও ফটো-ভোল্টাইক সেলের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন >> ভ্যাট ফাঁকি উদঘাটন নিয়ে বিতর্ক, মুখোমুখি এনবিআরের দুই প্রতিষ্ঠান

পণ্য ও সাধারণ যাত্রী পরিবহনসহ ৪৮৯টি এইচএস কোডভুক্ত প্রাথমিক ও জীবনধারণের জন্য মৌলিক পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

সবমিলিয়ে প্রায় ৫০ ধরনের সেবা ও ৫০০ পণ্যকে বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য- সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় থাকায় ভ্যাট-জিডিপি তথা কর-জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না। সে কারণে অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণের দাবি করছেন অর্থনীতিবিদরা।

ভ্যাট ফাঁকি মামলার জট

২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ৩০১টি প্রতিষ্ঠানে অভিযান ও নিরীক্ষা করে এক হাজার ৭৯ কোটি ৬১ লাখ ১৯ হাজার ৯০১ টাকার রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ১৪১টি প্রতিষ্ঠানে অডিট করে এবং ৯২টি প্রতিষ্ঠানে সরাসরি অভিযান চালিয়ে ওই ফাঁকির তথ্য পাওয়া যায়।



এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৩৩টি প্রতিষ্ঠানের এক হাজার ৬৭৬ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর আইএমএফ ইস্যুতে আন্তঃসভার এক বৈঠকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কবাবদ সরকারের বকেয়া সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে আলোচনা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে মীমাংসা করার জন্যও অনুরোধ করে এনবিআর।

সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বকেয়ার মারপ্যাঁচে আটকা আছে ২৪ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে শুধু ভ্যাট বা মূসক থেকে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। অথচ বকেয়া আদায়ই ঠিক মতো হচ্ছে না। হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি; রয়েছে মামলার জট।

এনবিআর থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটির মাঠ পর্যায়ের ১২টি অফিসের অধীনে ৪ হাজার ১৮৬ প্রতিষ্ঠানের কাছে আগস্ট পর্যন্ত ২৪ হাজার ৩৭৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। যা আদায় করতে দিনের পর দিন চিঠি চালাচালি চলছে। এমনকি পাঁচ বছরের বকেয়া টাকাও আটকা আছে। তবুও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে কঠোর হচ্ছে না এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ।

জানা যায়, চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) পাওনা সবচেয়ে বেশি। এ বিভাগের পাওনা ২২ হাজার ৬০৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। পরের অবস্থানে আছে চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট। এ অফিসের আওতায় মোট পাওনা ৮১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

এছাড়া ঢাকা উত্তর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারের পাওনা ৬৩০ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, ঢাকা পূর্ব কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারের আওতায় বকেয়া পাওনা ২৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।

অন্যদিকে, ঢাকা পশ্চিম ও ঢাকা দক্ষিণ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে অনাদায়ী রাজস্বের পরিমাণ যথাক্রমে ৭৯ কোটি ৮৫ লাখ ও পাঁচ কোটি ২৭ লাখ টাকা। একইভাবে রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, যশোর, রংপুর, কুমিল্লা কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাটি কমিশনারেটের পাওনা ১৮ কোটি ৪৭ লাখ,  ৬৯ কোটি ৩৬ লাখ, ১৩ কোটি ৫১ লাখ, ৩৪ কোটি ১৪ লাখ, ৬২ কোটি ৪০ লাখ এবং ১৭ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

ভ্যাট আহরণে অটোমেশন, সেখানেও ধীরগতি

ভ্যাট আদায় নিশ্চিত ও ফাঁকি রোধে ২০১৯ সালের আগস্টে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে পাঁচটি ভ্যাট কমিশনারেটে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালু করা হয়। চার বছর পার হলেও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। বর্তমানে বেসরকারিভাবে জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের মাধ্যমে এ কার্যক্রম চলমান। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত নয় হাজার ৪৪৯টি ইএফডি মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। লক্ষ্য অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে তিন লাখ ইএফডি বসানোর কথা থাকলেও আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে ইসিআর মেশিন চালু করা হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এরপর আসে ইএফডি।

প্রায় ৫০ ধরনের সেবা ও ৫০০ পণ্যকে বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য- সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় থাকায় ভ্যাট-জিডিপি তথা কর-জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না। সে কারণে অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণের দাবি করছেন অর্থনীতিবিদরা

এ বিষয়ে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভ্যাট আদায়ে এনবিআর যেভাবে ইএফডি দিচ্ছে তাতে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা কয়েকটি প্রক্রিয়া দেখিয়েছিলাম। কিন্তু তা আমলে নেওয়া হয়নি। খাতভিত্তিক হিসেবে ইএফডি দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। যেমন- সোনার দোকান হলে সারাদেশে যত স্বর্ণের দোকান আছে তাদের দেওয়া কিংবা কাপড়ের দোকানগুলোকে দেওয়া। এখন যেটি হয়েছে, মার্কেটের ৫০টি দোকানে আছে, বাকিগুলোতে নেই। ফলে একটি পক্ষ ভ্যাট আদায় করছে, অপর পক্ষ আদায় করছে না। ক্রেতাদের মধ্যে ভ্যাট নিয়ে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, তৈরি হয়েছে অনাস্থা।

আরও পড়ুন >> পেট্রোবাংলার পেটে সরকারের ২২ হাজার কোটি টাকা

‘বর্তমানে একটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা কমিশনের ভিত্তিতে ভ্যাট আদায় করছে। কমিশন যখন দেবেন, যে দোকানদার ভ্যাট আদায় করবে তাকে দেন। তাহলে তো ভ্যাট আদায় বেড়ে যেত। এখন জেনেক্স নামের এক প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা তো স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনায় বসেনি। কীভাবে বাস্তবায়ন করবে?’

ভ্যাট ফাঁকিতে ব্যস্ত দোকান-ব্যবসায়ীরাও

দোকান মালিক সমিতির তথ্য অনুসারে, মহানগরসহ সারাদেশে দোকান মালিক আছেন ৭০ থেকে ৭৫ লাখ। তারা যদি মাসে গড়ে ২০ হাজার টাকা ভ্যাট দেন তাহলে বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসে। এর সঙ্গে অন্যান্য খাতের বড় বড় দোকানির ভ্যাট যোগ হলে পরিমাণটা দ্বিগুণ হতে পারে। এজন্য শহরের সব দোকান-মালিকের ভ্যাট নিবন্ধন নিশ্চিত করার পাশাপাশি ইএফডি মেশিন সরবরাহ করতে হবে। যদি ইউনিয়ন বা গ্রাম পর্যায়ে মেশিন ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে বছরে দ্বিগুণ ভ্যাট আদায় সম্ভব।

সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কবাবদ সরকারের বকেয়া সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে আলোচনা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে মীমাংসা করার জন্যও অনুরোধ করে এনবিআর

মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বিভাগীয় শহরগুলোর মধ্যে ঢাকাতে বড় বড় দোকান-ব্যবসায়ী আছেন ছয় থেকে সাত লাখ। যাদের অধিকাংশেরই দিনে লেনদেন লাখ টাকার বেশি। খুলনায় আছেন দুই লাখের বেশি, রাজশাহীতে এক লাখ, চট্টগ্রামে চার লাখ। এ ছাড়া, জেলা শহরগুলোতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার দোকান-ব্যবসায়ী আছেন। কোনো কোনো উপজেলায় দোকান-ব্যবসায়ী আছেন এক হাজার থেকে ১০ হাজার।

আরও পড়ুন >> ১২.৪৬ কোটি টাকার দানকর পরিশোধ করেছেন ড. ইউনূস



বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ভ্যাট আদায় নিয়ে ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক ও অনাস্থা তৈরি হয়েছে। আমি বলব, রাজস্ব আদায়ে এনবিআর সঠিক পথে হাঁটছে না। সঠিক পথে হাঁটলে ভ্যাট বা রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে থাকত না তারা।

আরও পড়ুন >> নিটল মটরসের ৩৬৬ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি

ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্ট কি ব্যর্থ

আইএমএফের পরামর্শে প্রথমবারের মতো ভ্যাট আইন চালু করা হয়। এটি চালু করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বিরোধী দলের পাশাপাশি নিজ দলের এমপিদের বিরোধিতার মুখে পড়েন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভ্যাট আইন চালু করেন। রাজস্ব আদায় বাড়াতে ওই ভ্যাট আইন বেশ কার্যকর হয়।

১৯৯১ সালে দেশে প্রথম ভ্যাট আইন প্রবর্তন হয়। কিন্তু প্রত্যাশিত শৃঙ্খলা না আসায় সরকার ২০১২ সালে উন্নত ভ্যাট ব্যবস্থাপনা অনুসরণে একটি আইন প্রবর্তন করে, যা ২০১৫ সাল থেকে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই আইনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখে কিছুটা পিছিয়ে এসে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইন ও ২০১২ সালের ভ্যাট আইনের সংমিশ্রণে নতুন একটি আইন দাঁড় করানো হয়। ২০১৯ সাল থেকে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়।

আরও পড়ুন >> বছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ৪৪ হাজার কোটি

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ২০১২ সালে উন্নত ভ্যাট আইন হয়েছিল। সংসদে পাস হওয়ার পর ২০১৭ সালে সেটি পরিবর্তন করে বাস্তবায়ন হয়। যেটি করা উচিত হয়নি। ফলে রাজস্ব বাড়েনি। সময়ের সঙ্গে রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করতে হবে, সেটি আমরা করিনি।

ফাঁকি দিচ্ছেন ৫৯-৬০ লাখ দোকান-মালিক

দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ। কিন্তু নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হওয়ার পর তাদের মধ্যে মাত্র চার লাখ ৩৩ হাজার বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) নিয়েছে। অথচ তাদের এক-তৃতীয়াংশই মাসিক রিটার্ন জমা দেয় না। অনলাইনে নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৯৬ হাজার প্রতিষ্ঠান। ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল করে ২০ থেকে ২২ হাজার প্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে প্রায় ৫৯ থেকে ৬০ লাখ দোকান-মালিক বছরের পর বছর ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছেন।

আরএম/

তৃতীয় ও শেষ পর্বে থাকছে >> মিথ্যা ঘোষণা ও বন্ড সুবিধার গ্যাঁড়াকলে শুল্কযাত্রা