শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতিজট, ছাড়াবে কি?
১৬তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম চৌধুরী। পদোন্নতির সব ধরনের যোগ্যতা অর্জন করেও ১১ বছরে ‘অধ্যাপক’ হতে পারেননি। এ ক্ষোভে সম্প্রতি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রামের একটি কলেজে বদলি হয়েছেন তিনি।
তার ভাষ্য, একই বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে বন্ধু-সহকর্মীরা অতিরিক্ত সচিব, অতিরিক্ত আইজিপি হয়েছেন। এক বছর পর তারাই হবেন সচিব বা আইজিপি। আর আমি এখনও পঞ্চম গ্রেডে আছি। চাকরি আছে মাত্র দেড় বছর। অর্থাৎ সহযোগী অধ্যাপক থেকেই অবসরে যেতে হবে।
শুধু নুরুল ইসলাম চৌধুরী নন, যোগ্যতা থাকার পরও ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারেরও বেশি কর্মকর্তা প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন >> কাজ পরিদর্শন, দেন আড্ডা—স্কুল-কলেজের অনিয়ম দেখবে কে?
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির তথ্য বলছে, শিক্ষা ক্যাডারের এন্ট্রি পদ (প্রবেশ) প্রভাষক। এরপর সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক— এ তিন গ্রেডে বিসিএসের ১৬ থেকে ৩৫তম ব্যাচ পর্যন্ত ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা সব ধরনের যোগ্যতা অর্জন করলেও প্রাপ্য পদবি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ সরকার চাইলে এসব কর্মকর্তার পদোন্নতি দিতে পারে। পদোন্নতি দিলেও সরকারের অতিরিক্ত আর্থিক সংশ্লেষ হবে না। কারণ, পদোন্নতিযোগ্য সবাই আপগ্রেড স্কেল পেয়ে কাঙ্ক্ষিত পদের চেয়ে বেশি বেতন পাচ্ছেন।
সব ধরনের যোগ্যতা অর্জন করলেও প্রাপ্য পদবি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাত হাজার শিক্ষা কর্মকর্তা। অথচ সরকার চাইলে এসব কর্মকর্তার পদোন্নতি দিতে পারে। পদোন্নতি দিলেও সরকারের অতিরিক্ত আর্থিক সংশ্লেষ হবে না। কারণ, পদোন্নতিযোগ্য সবাই আপগ্রেড স্কেল পেয়ে কাঙ্ক্ষিত পদের চেয়ে বেশি বেতন পাচ্ছেন
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা বলছেন, গত মাসে পদোন্নতির বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খানের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেন। ৩১ আগস্টের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়ার দাবি জানান। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে পদোন্নতি না হওয়ায় আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হন। ইতোমধ্যে সংবাদ সম্মেলন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন তারা। এছাড়া চলতি মাসে সারাদেশের কলেজে কলেজে অবস্থান ও তালা দেওয়ার মতো কর্মসূচিও ঘোষণার কথা জানান শিক্ষা সমিতির নেতারা।
আরও পড়ুন >> বিশেষ বিবেচনায় এমপিও, বৈষম্যের শিকার এমপি-মন্ত্রীরাও!
কোন ব্যাচে কত পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা
বিসিএস ক্যাডারের সংখ্যার দিক দিয়ে শিক্ষা ক্যাডার অন্যতম বড়। বর্তমানে এ ক্যাডারে প্রায় ১৬ হাজার পদ আছে। এর মধ্যে কর্মরত রয়েছেন সাড়ে ১৩ হাজারের বেশি কর্মকর্তা। শিক্ষা ক্যাডারে মূলত সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক— এ তিন গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
সর্বশেষ ১৪তম বিসিএসের বেশির ভাগ কর্মকর্তা অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এখন ১৬ থেকে ৩৫তম ব্যাচের কর্মকর্তারা পদোন্নতিযোগ্য। এই ১৯টি ব্যাচের সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তা সব যোগ্যতা অর্জন করেও বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির অপেক্ষায় দিন পার করছেন।
তাদের মধ্যে ‘প্রভাষক’ থেকে ‘সহকারী অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা আছেন প্রায় দুই হাজার ৫০০ জন। এদিকে, ৩৬তম ব্যাচের কর্মকর্তা সেপ্টেম্বর থেকে পদোন্নতিযোগ্য হয়েছেন। এ ব্যাচসহ পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তার সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে। ‘প্রভাষক’ পর্যায়ে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তারা টানা নয় থেকে ১১ বছর পদোন্নতির জন্য অপেক্ষায় আছেন। ‘সহকারী অধ্যাপক’ থেকে ‘সহযোগী অধ্যাপক’ পদে ২৭তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতিযোগ্য তিন হাজার শিক্ষক রয়েছেন। এ ছাড়া, অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত রয়েছেন প্রায় এক হাজার শিক্ষক।
আর্থিক সংশ্লেষ নেই তারপরও পদোন্নতিবঞ্চিত
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী অধ্যাপক বলেন, ১১ বছর ধরে পদোন্নতি নেই। কিন্তু বর্তমান বেতন পরবর্তী পদ সহযোগী অধ্যাপকের চেয়েও বেশি। পদোন্নতি দিলে তো আমার পেছনে সরকারের তেমন অর্থ খরচ হবে না। হলে অতিরিক্ত ২৪৫ টাকা হবে। তারপরও পদোন্নতি মিলছে না!
‘প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে পদের চেয়েও দুই-তিনগুণ বেশি পদোন্নতি দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা যোগ্য হওয়ার পরও পদোন্নতি মিলছে না। এ কষ্টে অনেকেই চাকরি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।’
বিসিএস সমিতির তথ্য অনুযায়ী, পদোন্নতিযোগ্য সাত হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিলে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হবে ৮৮ লাখ টাকার মতো। দীর্ঘদিন পদোন্নতি আটকে থাকায় বেশির ভাগ কর্মকর্তার মূল বেতন এখন পরের গ্রেডের সমান বা বেশি হয়ে গেছে। তাই, পদোন্নতি দিলেও সরকারের ব্যয় তেমন বাড়বে না। ফলে সরকারের তেমন আর্থিক সংশ্লেষও হবে না।
‘প্রভাষক’ থেকে ‘সহকারী অধ্যাপক’ পদে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা আছেন প্রায় আড়াই হাজার। ৩৬তম ব্যাচের কর্মকর্তা সেপ্টেম্বর থেকে পদোন্নতিযোগ্য হয়েছেন। এ ব্যাচসহ পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তার সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে। ‘প্রভাষক’ পর্যায়ে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তারা টানা নয় থেকে ১১ বছর পদোন্নতির জন্য অপেক্ষায় আছেন। ‘সহকারী অধ্যাপক’ থেকে ‘সহযোগী অধ্যাপক’ পদে ২৭তম ব্যাচ পর্যন্ত পদোন্নতিযোগ্য তিন হাজার শিক্ষক রয়েছেন। এ ছাড়া, অধ্যাপক পদে পদোন্নতিযোগ্য ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত রয়েছেন প্রায় এক হাজার শিক্ষক
২৪তম ব্যাচের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপকের বেতনের ব্যবধান মাত্র সাত হাজার টাকা। গত ১৩ বছর পদোন্নতি না হলেও বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট হয়েছে। ফলে এখন তিনি সহযোগী অধ্যাপকের চেয়েও বেশি বেতন পাচ্ছেন। সরকার পদোন্নতি দিলে তার বেতন বাড়বে মাত্র ২৬৫ টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা সাধারণ সমিতির সভাপতি এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও পদসৃজন থেকে বঞ্চিত। কলেজভিত্তিক পদ সৃষ্টি হলে সাড়ে ১২ হাজার পদসৃজন হতো। কিন্তু নয় বছর ধরে তা বন্ধ। একদিকে পদসৃজন নেই, অন্যদিকে যোগ্য হওয়ার পরও পদোন্নতি হচ্ছে না। ফলে পদোন্নতিজট দিনদিন বাড়ছে, ক্যাডারদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় সংবাদ সম্মেলন ও অবস্থান কর্মসূচি করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চলছে। দাবি না মানলে সামনে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
ডিপিসি করেও পদোন্নতির তালিকা করতে ব্যর্থ
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য এক হাজার ৪৫১ জন (২৪তম-২৬তম ব্যাচ) কর্মকর্তার একটি শর্টলিস্ট তৈরি করা হয়। সেখানে পদোন্নতিযোগ্য (জ্যেষ্ঠতার ক্রমিকে পিছিয়ে) এক হাজার ৩৮৬ কর্মকর্তাকে এ ধাপে পদোন্নতির জন্য বিবেচনায় আনা হয়নি। গত ১০ জুলাই দ্বিতীয় দফা ডিপিসি সভায় সংক্ষিপ্ত তালিকার প্রস্তাবও শেষমেশ নাকচ হয়ে যায়।
সূত্র বলছে, ডিপিসি কমিটির সভাপতি ও শিক্ষা সচিব চাইছেন শূন্য পদের বিপরীতে সহযোগী অধ্যাপক পদে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে পদোন্নতি দিতে। পদোন্নতিযোগ্য বাকি ৬৮৮ জনকে পদোন্নতি দিতে চান না তিনি। এ কারণে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আটকে গেছে। এ নিয়ে ডিপিসির একটি বৈঠক ডাকারও কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। মন্ত্রণালয় এটি চূড়ান্ত করবে। তবে, আমাদের দাবি শূন্যপদ নয়, শতভাগ পদোন্নতিযোগ্য সবাইকে পদোন্নতি দেওয়া।
পদোন্নতির বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদোন্নতির বিষয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই দফা বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির (ডিপিসি) সভা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে পদোন্নতি দেওয়া হবে।
আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ক্যাডার সার্ভিস রুল অনুযায়ী তাদের আন্দোলন করার সুযোগ নেই। এটি উচিতও নয়।
আরও পড়ুন : তদবিরের চাপ ঠেকাতে ফোন বন্ধ রাখছেন প্রতিমন্ত্রী-সচিব-ডিজি
এদিকে, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সর্বশেষ ২০২১ সালের জুনে সহকারী থেকে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে এক হাজার ৪৭৯ প্রভাষককে সহকারী অধ্যাপক পদে উন্নীত করা হয়। অথচ প্রশাসন-পুলিশ ক্যাডারে বছরে দুটি পদোন্নতি দেওয়ার নজির রয়েছে। কখনও পদের চেয়ে তিনগুণ বেশি পদোন্নতি দেওয়া হয়। প্রতি বছর শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি হওয়ার কথা থাকলেও তিন বছরেও তা হয় না।
২০১৮ সালের পর থেকে শিক্ষা ক্যাডারের পদোন্নতিতে শ্লথগতি দেখা দিয়েছে। আগের সরকারের আমলে প্রতি বছর তিন ধাপে পদোন্নতি দেওয়া হতো। তখন বিষয়ভিত্তিক শূন্যপদ ছাড়াও শতাংশ হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় গড়ে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পদোন্নতি দেওয়া হতো। তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সরকার পদোন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি— অভিযোগ তাদের।
এনএম/এমজে/এমএআর