দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সক্রিয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতারা। এরই মধ্যে মাঠে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়া শুরু করেছেন তারা। তবে এবার নৌকা প্রতীকের আসনগুলোর চেয়ে মহাজোটের শরিকদের আসনে তাদের চোখ। গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব আসন আওয়ামী লীগ শরিকদের ছেড়ে দিয়েছিল আগামী নির্বাচনে সেসব আসনে দল থেকে প্রার্থী চান তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখন থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। আবার দলের হাই কমান্ড থেকেও প্রার্থীদের বিষয়ে সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। কোন প্রার্থীর কী সমস্যা, কারা জনপ্রিয়, কারা মানুষের কাছে যাচ্ছেন, কারা মানুষ থেকে দূরে রয়েছেন, এলাকায় কার কত গ্রহণযোগ্যতা— এসব বিষয়ে ছয় মাস পরপর খোঁজ-খবর নিচ্ছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। 

আরও পড়ুন >> তৃণমূলেও নির্বাচনী হাওয়া, দৃষ্টি ‘ঢাকা’

একইভাবে জোটের প্রার্থীদের বিষয়েও খোঁজখবর নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। জোটের প্রার্থীর চেয়ে আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থীর জনপ্রিয়তা বেশি হলে সেটিও বিবেচনা করা হবে। তবে শরিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার বিষয়টি এখনও পরিষ্কার না হওয়ায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা মাঠের অবস্থান ধরে রেখেছেন। যেসব আসনে জোটের শরিকদের ছাড় দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বেশি সক্রিয়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে যেসব আসন মহাজোটের প্রার্থীদের দেওয়া হয়েছিল সেসব আসনও এবার নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।

নির্বাচন ঘিরে নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আওয়ামী লীগ। এসব মোকাবিলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দিনদিন তৃণমূলের রাজনীতি চাঙা হচ্ছে। মহাজোট, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতারা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। এজন্য তারা নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন নানা কর্মসূচিতে। এসব নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র রাজনীতি ঢাকায় করলেও বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে অবস্থান করছেন। কোনো অনুষ্ঠানের খবর পেলে তারা প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথির দাওয়াত নিতে ভুল করছেন না। প্রয়োজনে আয়োজকদের ফোন করে নিজেই অতিথি হচ্ছেন।

ঢাকা- ৮ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। এটি আওয়ামী লীগ-বিএনপির রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হলেও মহাজোটের প্রার্থী এ আসনের এমপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা দলীয় মনোনয়ন চান। কেন্দ্রের মনোযোগ আকর্ষণ করতে তারা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। 

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী।
এ প্রসঙ্গে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‌‘ঢাকা- ৮ আসনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দলের অফিস। সারাদেশের নেতাকর্মীরা এখানেই আসেন। সেক্ষেত্রে এখানকার এমপি মহাজোটের হওয়ার কারণে ঢাকাসহ সারা দেশের নেতাকর্মীরা সার্ভিস (সেবা) পাচ্ছেন না। এ আসনে মহাজোটের এমপি হওয়ার কারণে বিএনপি-জামায়াতের সংখ্যা বাড়ছে। রাশেদ খান মেননকে জোটের প্রার্থী করার পরও তিনি ওয়ার্কার্স পার্টিকে সক্রিয় করতে পারেননি।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাশেদ খান মেনন এমপি হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। স্কুলে ভর্তি বাণিজ্য আর ক্লাব কেলেঙ্কারি করে আসনটির পরিস্থিতি খারাপ করে দিয়েছেন। মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে রাশেদ খান মেননকে আবারও মনোনয়ন দিলে তার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেক্ষেত্রে প্রার্থী পরিবর্তন করতে হবে। এ আসনে বিএনপি-জামায়াত শক্তিশালী হলেও আওয়ামী লীগ দুর্বল হচ্ছে। এ অবস্থা কাটানোর জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী দরকার।’

আরও পড়ুন >> গুজব নিয়ে আতঙ্কে বিএনপি

তৃণমূল আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আওয়ামী লীগ। এসব মোকাবিলা করেই সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দিনদিন তৃণমূলের রাজনীতি চাঙা হচ্ছে। মহাজোট, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের শীর্ষ নেতারা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। এজন্য তারা নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন নানা কর্মসূচিতে। এসব নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র রাজনীতি ঢাকায় করলেও বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে অবস্থান করছেন। কোনো অনুষ্ঠানের খবর পেলে তারা প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথির দাওয়াত নিতে ভুল করছেন না। প্রয়োজনে আয়োজকদের ফোন করে নিজেই অতিথি হচ্ছেন। মহাজোটের এমপিদেরও বড় বড় অনুষ্ঠান করে জানান দিচ্ছেন আমিও প্রার্থী। তবে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড শরিকদের আসন নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি। 

দলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে (১৪ দলীয়) অংশ নেবে। ১৪ দলীয় জোটের নেতারা প্রসঙ্গটি দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুললে তিনি জোটগতভাবে ভোট করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। 

১৪ দলের মুখপাত্র ও সমন্বয়ক এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু সম্প্রতি বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন জোটবদ্ধভাবে করা হবে। ১৪ দলের সঙ্গে ঐক্য বজায় থাকবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে ১৪ দলের যে ভূমিকা, সেটিও অব্যাহত থাকবে। তবে মহাজোটের প্রার্থীরা কে, কোন আসন পেতে যাচ্ছেন তা নিয়ে এখনও আলাপ-আলোচনা হয়নি।’

আরও পড়ুন >> মন্ত্রী-সচিবদের সাবেক পিএসদের কাঁধেই সংসদ নির্বাচন!

বগুড়া- ৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন। তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল থেকে নির্বাচন করেন। এ আসনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী রয়েছে। এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. তৌহিদুল করিম (কল্লোল)। 

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। যে কোনো পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তৃণমূল আওয়ামী লীগ এর ব্যতিক্রম নয়। গত নির্বাচনে আমাদের (বগুড়া- ৪) আসনটি মহাজোটের প্রার্থীকে দেওয়া হয়েছিল। ফলে নৌকার লোকেরা নৌকায় ভোট দিতে পারেননি। এবার আমাদের আকাঙ্ক্ষা জোটের প্রার্থীকে নয়, নৌকায় ভোট দেব। প্রার্থী নৌকার-ই হবে। তবে হাই কমান্ড যাকে মনোনয়ন দেবে তাকে নিয়েই আমরা কাজ করব। আমরা কেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছি।’

দলীয় সূত্র মতে, আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ নেয় তখন একটি হিসাব থাকবে (জোটবদ্ধভাবে)। আর যদি না নেয় তখন হিসাব হবে ভিন্ন। বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক করতে মহাজোটের শরিক দলগুলোর প্রার্থীরা নিজ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। আর বিএনপি নির্বাচনে আসলে মহাজোট করে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ।  

এদিকে, আগামী নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বশেষ দলের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে তিনি বলেছেন, আপনারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে তৃণমূলের মানুষের সঙ্গে দূরত্ব কমান এবং অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন করুন। আপনারা যদি মনে করেন যে ঢাকায় থেকেই দলীয় টিকিট পাবেন এবং বিজয়ী হবেন, তাহলে ভুল করবেন। কারণ, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও কঠিন হবে।

বর্তমানে মহাজোট থেকে জাতীয় সংসদে ৩২ জন সদস্য রয়েছেন। তারা হলেন- ঠাকুরগাঁও- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, নীলফামারী- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির রানা মোহাম্মদ সোহেল, নীলফামারী- ৪ আসনে জাতীয় পার্টির আহসান আদেলুর রহমান, লালমনিরহাট- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির গোলাম মোহাম্মদ কাদের, রংপুর- ১ আসনে জাতীয় পার্টির মো. মসিউর রহমান রাঙ্গা, রংপুর- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির রাহ্গির আলমাহি এরশাদ, কুড়িগ্রাম- ২ আসনে জাতীয় পার্টির পনির উদ্দিন আহমেদ, গাইবান্ধা- ১ আসনে জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী, বগুড়া- ২ আসনে জাতীয় পার্টির শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ্, বগুড়া- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির মো. নূরুল ইসলাম তালুকদার, বগুড়া- ৪ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের এ কে এম রেজাউল করিম তানসেন।

সাতক্ষীরা- ১ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির মুস্তফা লুৎফুল্লাহ, বরিশাল- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির গোলাম কিবরিয়া টিপু, বরিশাল- ৬ আসনে জাতীয় পার্টির নাসরিন জাহান রতনা, পিরোজপুর- ২ আসনে জাতীয় পার্টির (জেপি) আনোয়ার হোসেন, পিরোজপুর- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির মো. রুস্তম আলী ফরাজী, ময়মনসিংহ- ৪ আসনে জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ, ময়মনসিংহ- ৮ আসনে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম, কিশোরগঞ্জ- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির মো. মুজিবুল হক।

মুন্সীগঞ্জ- ১ আসনে বিকল্পধারা বাংলাদেশের মাহী বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ঢাকা- ৪ আসনে জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেন, ঢাকা- ৬ আসনে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ, ঢাকা- ৮ আসনে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, নারায়ণগঞ্জ- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির লিয়াকত হোসেন খোকা, নারায়ণগঞ্জ- ৫ আসনে জাতীয় পার্টির এ কে এম সেলিম ওসমান, নারায়ণগঞ্জ- ৪ আসনে জাতীয় পার্টির পীর ফজলুর রহমান।

সিলেট- ২ আসনে গণফোরাম মোকাব্বির খান, মৌলভীবাজার- ২ আসনে গণফোরামের সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, ফেনী- ১ আসনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের শিরীন আখতার, ফেনী- ৩ আসনে জাতীয় পার্টির মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, লক্ষ্মীপুর- ৪ আসনে বিকল্পধারা বাংলাদেশের আবদুল মান্নান ও চট্টগ্রাম- ৫ আসনে জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। 

এমএসআই/এসকেডি