নানা কারণে প্রায়ই নিজ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে হামলার শিকার হন চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা কাজে নিয়োজিত কর্মীরা। এ সময় চেম্বারসহ হাসপাতালের বিভিন্ন অবকাঠামো ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। অধিকাংশ সময় ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তুলে এমন কাণ্ড ঘটান রোগী ও তাদের স্বজনরা। এ অবস্থায় চিকিৎসকদের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনসহ চিকিৎসকনেতারা যুগোপযোগী সুরক্ষা আইনের দাবি জানিয়েছেন।

সম্প্রতি চিকিৎসকদের সুরক্ষার বিষয়টি আমলে নিয়ে ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন’ নামক একটি সুরক্ষা আইনের উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে এ আইনের খসড়াও তৈরি করেছে সরকার।

চিকিৎসকনেতারা বলছেন, প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের খসড়ায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বার্থ ও সেবাগ্রহীতা কিংবা প্রদানকারী কারোরই সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি। তারা প্রস্তাবিত খসড়াটি বাতিল করে আরেকটি ‘যুগোপযোগী আইন’ প্রণয়নেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।

আরও পড়ুন- রোগীদের ‘জিম্মি’ করে কেন আন্দোলনে চিকিৎসকরা?

সুরক্ষা আইনের খসড়ায় চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্র ‘ভীতিকর’ করা হয়েছে

বর্তমান সময়ে চিকিৎসকদের অধিকার ও দাবি নিয়ে নানা দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে চিকিৎসকদেরই পৃথক দুটি সংগঠন- বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশন (বিডিএফ) ও ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিস (এফডিএসআর)। তাদের দাবি, স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা আইনের খসড়ায় চিকিৎসকদের স্বাধীন ও সৎ চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রকে ভীতিকর করা হয়েছে। এতে কোনো চিকিৎসক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না। ফলে জনগণ চিকিৎসাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদানের মূল লক্ষ্য ব্যাহত হবে।

প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের খসড়ায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের স্বার্থ ও সেবাগ্রহীতা কিংবা প্রদানকারী কারোরই সুরক্ষা নিশ্চিত হয়নি। প্রস্তাবিত খসড়াটি বাতিল করে আরেকটি ‘যুগোপযোগী আইন’ প্রণয়নেরও দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা

এফডিএসআর বিবৃতিতে বলেছে, জনগণের মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, নার্স ও সহায়ককর্মীর কর্মপরিবেশ নিরাপদ ও মানসম্পন্নকরণের দীর্ঘ প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য। তবে, একটি আইন তখনই আদর্শ হিসেবে গণ্য হয় যখন সেটি সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য প্রকৃত অর্থে কল্যাণকর হয়। কিন্তু আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন ২০২৩ এর খসড়ায় তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমান বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অতি সামান্য অংশই রেজিস্টার্ড অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার আওতায় সেবাপ্রাপ্ত হন। অধিকাংশ মানুষ এখনও নিয়ন্ত্রণহীন, নিবন্ধনহীন হাতুড়ে চিকিৎসা, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ— এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে  ঝাড়ফুঁক নির্ভর। অথচ জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা একটি সামগ্রিক সুরক্ষা বলয়ের আওতায় হওয়া ছিল একান্ত প্রত্যাশিত, যা আলোচিত খসড়ায় মোটেও বিবেচিত হয়নি।

এ আইন মূলত চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করার একটি চেষ্টা : ডা. আব্দুন নুর তুষার

বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও চিকিৎসকনেতা ডা. আব্দুন নূর তুষার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন থাকা দরকার। কিন্তু চিকিৎসা সুরক্ষার নামে যে আইনটি করা হচ্ছে, সেটি মূলত চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করার একটি চেষ্টা। আপনি যদি উল্টো চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সেখানে তো সুরক্ষার কিছু থাকে না।

আরও পড়ুন- ‘কাগুজে বাঘ’ বিএমডিসি, ২০% চিকিৎসকের নিবন্ধন মেয়াদোত্তীর্ণ!

‘আমরা মনে করি, সুরক্ষা শুধু চিকিৎসকেরই নয়; রোগী, হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ সবারই প্রয়োজন। পাশাপাশি এক পক্ষকে আরেক পক্ষ থেকে নিরাপদ রাখারও প্রয়োজন আছে। আমি বলব, যে আইনটি বানানো হয়েছে সেটি মূলত চিকিৎসক নির্যাতন আইন। যারা আইনটি বানিয়েছেন, তাদের মধ্যে সরাসরি চিকিৎসা পেশার সঙ্গে যুক্ত কোনো লোক নেই। সেখানে আছেন অ্যাডমিন ক্যাডার আর আমলাতন্ত্রের লোকজন। তারা নিজেরা টেবিলে বসে নিজেদের মনের মতো করে আইনটি তৈরি করেছেন।’

চিকিৎসকদের দাবি, হঠাৎ করে রোগীর লোকজন ধুমধাম ডাক্তারের ওপর মারমুখি হলেন বা হাসপাতাল-ক্লিনিক ভাঙচুর করলেন, তাদের বিচার কী হবে বা করণীয় কী হবে—  কোনোকিছুই স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা আইনে উল্লেখ করা হয়নি

সুনির্দিষ্ট কোনো ধারা নিয়ে আপনাদের আপত্তি আছে কি না— জানতে চাইলে এ চিকিৎসকনেতা বলেন, এ আইনের প্রতিটি ধারাতে সমস্যা রয়েছে। চিকিৎসক, রোগী ও ক্লিনিক-হাসপাতাল, সবকিছু এ আইনে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা মনে করি, রোগী ও চিকিৎসক নিয়ে যেমন একটি আইন থাকা উচিত, ক্লিনিক-হাসপাতালের জন্যও আলাদা একটি আইন প্রয়োজন। কারণ, ক্লিনিক-হাসপাতালের সঙ্গে ডাক্তার বা রোগীর কোনো সম্পর্ক নেই। ক্লিনিক-হাসপাতালে যারা ইনভেস্ট করেন, তারা মালিক। তারা ব্যবসা করছেন। এ ব্যবসার স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেনেন্সের জন্য যদি জবাবদিহিতা করতে হয়, তাহলে তো মালিকেরই করার কথা। কিন্তু আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে দেখছি, চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে রোগীদের বসার জায়গা না থাকলে চিকিৎসককে জরিমানা করা হবে। এটি কেমন ধরনের আইন, আমরা বুঝতে পারছি না। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি সেখানে চাকরি করি, চেয়ার কেনার দায়িত্ব কি আমার? না কি আমি হাসপাতাল বানিয়েছি?

ডাক্তারদের চাওয়ার কোনো প্রতিফলন নেই : বিডিএফ চেয়ারম্যান

বিডিএফ চেয়ারম্যান ডা. মো. শাহেদ রফি পাভেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরো আইনে সমস্যা আছে। এসবের মধ্যে কিছু বিষয়ে এমন রয়েছে, যেগুলো চিকিৎসক সমাজ কখনওই মেনে নেবে না। বিশেষ করে অযৌক্তিক কারণে কথায় কথায় চিকিৎসককে জরিমানা ও শাস্তি দেওয়া, চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা, চিকিৎসকদের চেম্বারে হুটহাট অভিযান— বিষয়গুলো নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে ব্যাপক আপত্তি রয়েছে।

আরও পড়ুন- অনিশ্চয়তা বাড়ছে চিকিৎসা পেশায়

‘ইমার্জেন্সি চিকিৎসা চলাকালীন যেকোনো রোগীর মৃত্যু হতেই পারে। এক্ষেত্রে যদি রোগীর পরিবার অভিযোগ করেন, সেটির সমাধান করবেন কে? এটি তো সরাসরি পুলিশ সমাধান করবেন না, সমাধান হওয়ার কথা বিএমডিসির মাধ্যমে। তারা হয়তো এর জন্য একটা এক্সপার্ট কমিটি করবে, তারা যাচাই-বাছাই করে চিকিৎসকের কোনো ভুল পাওয়া গেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে সুনির্দিষ্টভাবে স্পষ্ট করা হয়নি।’

চিকিৎসকদের অ্যাক্টিভ সংগঠনগুলোকে আলোচনায় রাখা হয় না

ডা. মো. শাহেদ রফি পাভেল বলেন, কোনো একটা কারণ দেখিয়ে সরাসরি আপনি পুলিশ নিয়ে এসে একজন ডাক্তারকে ধরে নিয়ে যাবেন, এটা তো যৌক্তিক হতে পারে না। বিশ্বের কোনো দেশেই এমনটা হয় না। চিকিৎসকদের নির্দিষ্ট কাউন্সিলের মাধ্যমে এ বিষয়গুলো সুরাহা হয়। যদি ক্রিমিনাল নেগলিজেন্স হয়, তাহলে অবশ্যই শাস্তির বিধান থাকবে। সে আইনে তার যে সাজা হওয়া দরকার, সেটি হবে। প্রাথমিকভাবে তার ভুলটা নিরূপণ করার জন্য তো আপনাকে একটা এক্সপার্ট বডি দিতে হবে। তা না হলে তো বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হবে না।

তিনি আরও বলেন, রোগীদের যেহেতু সবসময় চিকিৎসকদের নিয়ে নানা কমপ্লেইন থাকে, কমপ্লেইনগুলো পার্টিকুলারলি তিনি কোথায় দেবেন, সেগুলো কে যাচাই-বাছাই করবে— বিষয়গুলোর তো সুনির্দিষ্ট সুরাহা লাগবে। এমনকি হঠাৎ করে রোগীর লোকজন ধুমধাম ডাক্তারের ওপর মারমুখি হলেন বা হাসপাতাল-ক্লিনিক ভাঙচুর করলেন, তাদের বিচার কী হবে বা করণীয় কী হবে—  কোনোকিছুই স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষা আইনে উল্লেখ করা হয়নি।

‘উভয় সংকটে’ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন

প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছেন চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। আইনের কিছু ধারার সমালোচনা করলেও আইন পাসে কোনো আপত্তি নেই বলেও জানিয়েছেন সংগঠনটির মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী।

আরও পড়ুন- হঠাৎ নজর কেন চেম্বারে?

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আইনের যে সকল ধারা নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিল, সময় সময় কথা বলে আমরা সেগুলো উপস্থাপন করেছি। বিষয়গুলো নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে, ক্যাবিনেট ডিভিশনেও মিটিং হয়েছে। এরপর সেখান থেকে কিছু কিছু অবজারভেশন দিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়েছিল। সেগুলো আমরা সংশোধন করে দিয়েছি। তারপরও কেন আইনটি পাস হচ্ছে না, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।

বেশকিছু চিকিৎসক সংগঠন আইনের খসড়া সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ওই সংগঠনগুলো চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্ব করে না। চিকিৎসকদের প্রতিনিধিত্বশীল একমাত্র সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন। আমরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়কে যে আইনের খসড়াটি দিয়েছি, সেটিতে অবশ্যই চিকিৎসকদের সুরক্ষা রক্ষিত হয়েছে। আমরা চাই আইনটি যেন দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়।

কী আছে স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইনে

বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা : খসড়া আইনের ৫ নম্বর ধারায় বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স পাওয়ার বিভিন্ন শর্ত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকার বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপনের লাইসেন্স প্রদান করবে। তবে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে আবেদনকারী প্রত্যেক হাসপাতালে অবস্থান উপযোগী রোগীর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রোগী প্রতি ন্যূনতম ১০০ (একশ) বর্গফুট জায়গা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রোপচার কক্ষ, বিধিতে উল্লিখিত অত্যাবশ্যকীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতি, পর্যাপ্ত জীবন রক্ষাকারী ঔষধপত্র, আধুনিক চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নির্দিষ্ট সংখ্যক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি এবং রোগীর চিকিৎসা তদারকি ও শল্য চিকিৎসার (অস্ত্রোপচার) জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ শল্য চিকিৎসকসহ অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকতে হবে এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা থাকতে হবে।

এ ধারায় সরকার সময় সময় গেজেট/প্রজ্ঞাপন দ্বারা বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপনের লক্ষ্যে লাইসেন্স প্রদান এবং নবায়ন ফি নির্ধারণ করতে পারবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

৬ নম্বর ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, সরকার নিযুক্ত কোনো কর্মকর্তা বা কমিটি কোনো হাসপাতালে যেকোনো সময়ে প্রবেশ, পরিদর্শন, রেজিস্টার ও চিকিৎসা সেবাসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি, নমুনা বা কাগজপত্র পরীক্ষা এবং উহার উদ্ধৃতাংশ জব্দ করতে পারবে। তবে, রেজিস্টার বা কাগজপত্রের উদ্ধৃতাংশ কোনো রোগীর রোগসংক্রান্ত হলে সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রোগী বা তার আইনসঙ্গত অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত জনসমক্ষে প্রকাশ করা যাবে না।

আরও পড়ুন- চিকিৎসক সংকট কাটাতে আসছে ‘বড় নিয়োগ’

৬ নম্বর ধারার ২ (খ), (গ) উপধারায় আরও বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতাল প্রদত্ত সেবা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বা মানসম্মত না হলে এবং এ আইন, বিধি বা তদধীন প্রদত্ত নির্দেশ বা লাইসেন্সের শর্তাবলি ভঙ্গের প্রকৃতি যদি এরূপ হয় যে, উক্ত বেসরকারি হাসপাতালকে কারণ দর্শানোর সুযোগ প্রদান করা সমীচীন নয়, তৎক্ষেত্রে জনস্বার্থে উক্ত প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিতপূর্বক তাৎক্ষণিকভাবে তা বন্ধ করে দিতে পারবে এবং নিবন্ধিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ বরাবর তার নিবন্ধন বাতিল করার সুপারিশ লিখিতভাবে প্রেরণ করবে।

ব্যক্তিগত চেম্বার ও চিকিৎসাসেবার চার্জ

আইনে বলা হয়েছে, সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে বা পালাক্রমিক দায়িত্ব পালনকালে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে সেবা দিতে পারবেন না। এমনকি নির্ধারিত অফিস সময় ব্যতীত ও ছুটির দিনে স্ব স্ব কর্মস্থলের জেলার বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে ফি গ্রহণপূর্বক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন হবে। তবে শর্ত থাকবে যে, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ জনস্বার্থে যেকোনো সময় উক্ত অনুমতি স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান উক্তরূপ কোনো ব্যক্তিকে অফিস সময়ে বেসরকারি হাসপাতালে সেবা প্রদানের জন্য নিয়োজিত করতে পারবে না।

আইনের ১১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, সরকার সময় সময় গেজেট/প্রজ্ঞাপন দ্বারা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল প্রদত্ত সেবা, চিকিৎসকের ফি এবং রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ বা মূল্য বা ফি পৃথকভাবে নির্ধারণ করবে। চিকিৎসকের ফি বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আদায়যোগ্য চার্জ বা মূল্য বা ফি’র তালিকা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা চেম্বারের দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে এবং চিকিৎসাসেবা বাবদ আদায়কৃত চার্জ বা মূল্য বা ফি’র রশিদ সংশ্লিষ্ট সেবাগ্রহীতা বা তার অভিভাবক বা তার প্রতিনিধিকে প্রদানপূর্বক উক্ত রশিদের অনুলিপি সংরক্ষণ করতে হবে।

১২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত চেম্বারে বেসরকারি চিকিৎসা অনুশীলনের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের জন্য মানসম্মত বসার স্থান থাকতে হবে। এমনকি রোগী পরীক্ষার জন্য ন্যূনতম চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকতে হবে, যা বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল স্বীকৃত বা অনুমোদিত ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি ব্যতীত অন্য কোনো যোগ্যতার বিবরণ সাইনবোর্ড, নামফলক, ভিজিটিং কার্ডে বা ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখ করা যাবে না।

খসড়া আইনে আরও বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তির ব্যবস্থাপত্র ও ভিজিটিং কার্ডে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত নিবন্ধন নম্বর লিপিবদ্ধ থাকতে হবে এবং সেবাগ্রহীতার রোগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে জেন্ডার বিবেচনায় একজন সহায়তাকারীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। তবে, জরুরি চিকিৎসার ক্ষেত্রে যৌক্তিক পরিস্থিতিতে এ আবশ্যকতা শিথিলযোগ্য হবে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অন্য কাউকে ‘কমিশন’ দেওয়া যাবে না

খসড়া আইনে আরও বলা হয়েছে, বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ বা মূল্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গ্রহণ বা প্রদান করা যাবে না। ব্যক্তিগত চেম্বারে বেসরকারি চিকিৎসা অনুশীলন সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়াদি এ আইনের অধীনে প্রণীত বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।

আইনের ১৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, চিকিৎসায় রোগী বা রোগীর অনুমতিক্রমে প্রয়োজনীয় ও বিকল্প চিকিৎসা, চিকিৎসাকালীন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ঔষধের গুরুত্বপূর্ণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, চিকিৎসা পদ্ধতি, অস্ত্রোপচারে জটিলতার সম্ভাব্য সময় ও চিকিৎসা সম্পর্কিত খাতওয়ারি ব্যয় সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি অবহিত করবেন।

আরও পড়ুন- ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা প্রথম সারির বেসরকারি হাসপাতালগুলো

১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রত্যেক হাসপাতালে ন্যূনতম জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রয়োজনীয় সুবিধা সংবলিত জরুরি বিভাগ থাকতে হবে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধা রোগীর সম্মানার্থে শতকরা ২ ভাগ শয্যা বিনামূল্যে সংরক্ষণপূর্বক হ্রাসকৃত মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অন্যান্য চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদান করবে।

এতে আরও বলা হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলো দরিদ্র রোগীদের জন্য শতকরা ৩ ভাগ শয্যা এবং প্রতিবন্ধী রোগীদের জন্য শতকরা ১ ভাগ শয্যা বিনামূল্যে সংরক্ষণপূর্বক হ্রাসকৃত মূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অন্যান্য চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদান করবে। প্রত্যেক হাসপাতাল বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক রোগীর সেবা প্রদানসংক্রান্ত তথ্য সংবলিত ডিজিটাল রেজিস্টার সংরক্ষণ করবে।

চিকিৎসায় অবহেলা প্রদর্শন ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হবে

আইনের ২২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানির মালিকানাধীন বা অনুরূপ সংস্থার অধীন বা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত হাসপাতাল কর্তৃক এ আইনের বিধানাবলি লঙ্ঘিত হলে তার প্রধান নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রত্যেক পরিচালক বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, তিনি যে নামেই অভিহিত হোন না কেন, বিধানটি লঙ্ঘন করেছেন বলে গণ্য হবে।

উপরোক্ত ধারার আওতায় পরিচালিত কোনো হাসপাতাল কর্তৃক এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে তার লাইসেন্স বাতিল করা যাবে এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধ দণ্ডবিধি ১৮৬০ (অ্যাক্ট নং- এক্সএলভি অব ১৮৬০) এর বিধান অনুযায়ী দণ্ডযোগ্য হবে। এ আইনের বিধান লঙ্ঘনজনিত অপরাধগুলোর তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম প্রচলিত আইনের আওতায় পরিচালিত হবে।

তবে শর্ত হলো, চিকিৎসা প্রদানসংক্রান্ত অভিযোগ আদালতে আনীত হলে আদালত সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ ন্যূনতম তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে কোনো অভিযোগ আমলে নেবে। এ আইনে বর্ণিত অপরাধগুলো যে স্থানে সংঘটিত হবে সে স্থানের ফৌজদারি এখতিয়ার সম্পন্ন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কর্তৃক বিচার্য হবে।

আইনে বলা হয়েছে, নির্ধারিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী হাসপাতাল বা চিকিৎসাসেবা সহায়তা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অবহেলা প্রদর্শন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এ অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তির প্রতি হুমকি প্রদান, ভীতি প্রদর্শন, দায়িত্ব পালনে বাধাদান, আঘাত করাসহ যেকোনো ধরনের অনিষ্ট সাধন বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি সাধন, বিনষ্ট, ধ্বংস বা উক্তরূপ সম্পত্তি স্বীয় দখলে গ্রহণ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এ অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে।

কোন আইন ভঙ্গে কত জরিমানা এবং কী দণ্ড

আইনে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তির প্রতি হুমকি প্রদান, ভীতি প্রদর্শন, দায়িত্ব পালনে বাধাদান, আঘাত করাসহ যেকোনো ধরনের অনিষ্ট সাধন বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পত্তির ক্ষতি সাধন, বিনষ্ট, ধ্বংস বা এরূপ সম্পত্তি স্বীয় দখলে গ্রহণ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা দুই বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এছাড়া সরকার বা তৎকর্তৃক নিযুক্ত কোনো কর্মকর্তা বা এ আইন বলে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা বা কমিটিকে কোনো হাসপাতালে পরিদর্শন, প্রবেশ, তল্লাশি ও জব্দ করার কার্যক্রমে বাধা প্রদান করলে উক্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা এক বছর কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

সরকারি বা কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় চাকরিরত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি নির্ধারিত অফিস সময়ে বা পালাক্রমিক দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের সময়ে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসাসেবা প্রদান করলে অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া সরকারি বা কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় চাকরিরত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অফিস সময়ে বেসরকারি হাসপাতালে সেবা প্রদানের জন্য নিয়োজিত করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে; ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড আরোপযোগ্য হবে।

এছাড়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রত্যেক হাসপাতালে ন্যূনতম জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে প্রয়োজনীয় সুবিধা সংবলিত জরুরি বিভাগ না থাকলে উক্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড আরোপযোগ্য হবে। কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি ব্যক্তিগত চেম্বারে বেসরকারি চিকিৎসা অনুশীলনের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের জন্য ন্যূনতম বসার স্থান না রাখলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

সেখানে আরও বলা হয়েছে, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কোনো চিকিৎসকের ফি, রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ বা মূল্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গ্রহণ বা প্রদান করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে অনাদায়ে এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড আরোপযোগ্য হবে। এমনকি আদায়যোগ্য চার্জ বা মূল্য বা ফি’র তালিকা সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল বা চেম্বারের দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শিত না হলে এবং রোগী থেকে আদায়কৃত চার্জ বা ফি’র রশিদ সংশ্লিষ্ট সেবাগ্রহীতা বা তার অভিভাবক বা তার প্রতিনিধির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রদান করা না হলে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করা না হলে দায়ী ব্যক্তি অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে ৩০ দিন বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

একই সঙ্গে আইনের অন্য যেকোনো ধারার লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনে সহযোগিতা বা প্ররোচনা বা প্ররোচনায় সহযোগিতা বা আইনে প্রতিপালনযোগ্য বিষয়াদি প্রতিপালন না করা বা প্রতিপালন না করায় সহযোগিতা বা প্রতিপালনে বাধা দান করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটলে অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা আরোপযোগ্য হবে, অনাদায়ে তিন মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

টিআই/এমজে