• স্কটল্যান্ড ও পর্তুগালের আদলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন
• প্রশাসনের দখলে যাবে, তাই শিক্ষা ক্যাডারদের বিরোধিতা  

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের ১৫০ কোটি টাকায় আরও দুটি অধিদপ্তর করার তোড়জোড় শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) ভেঙে ‘প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক কার্যালয়’ ও ‘অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর’ নামে নতুন দুটি অধিদপ্তর করা হবে। এতে ব্যয় হবে ১৫০ কোটি টাকা।

নতুন দুটি অধিদপ্তর হলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, আর্থিক ও প্রশাসনিক তদারকি কার্যক্রম আরও আধুনিক ও গতিশীল হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, নতুন অধিদপ্তর প্রশাসন ক্যাডারের দখলে যাবে— এমন শঙ্কায় এর বিরোধিতা করছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

নতুন দুটি অধিদপ্তর হলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, আর্থিক ও প্রশাসনিক তদারকি কার্যক্রম আরও আধুনিক ও গতিশীল হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে, নতুন অধিদপ্তর প্রশাসন ক্যাডারের দখলে যাবে— এমন শঙ্কায় এর বিরোধিতা করছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা

জানা গেছে, নতুন দুটি অধিদপ্তরের রূপরেখা চূড়ান্ত করতে গত বুধবার (৩০ আগস্ট) শিক্ষামন্ত্রীর নেত্বত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ বিভাগ, জনপ্রশাসনসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ৬৫ জনকে নিয়ে একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুটি অধিদপ্তরের পরিধি, আইন, ভবন ও প্রেষণে কারা কাজ করবেন— এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আগামী মাসে (সেপ্টেম্বর) আরেকটি কর্মশালা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। পরে এর চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য সরকারের সর্বোচ্চ মহলের অনুমতি চাওয়া হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এটি চূড়ান্ত করতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আরও পড়ুন >> কাজ পরিদর্শন, দেন আড্ডা—স্কুল-কলেজের অনিয়ম দেখবে কে? 

সংশ্লিষ্টরা জানান, এডিবি ও সরকারের যৌথ অর্থায়নে পরিচালিত মাধ্যমিক শিক্ষা খাত বিনিয়োগ কর্মসূচি (সেসিপ) প্রকল্পের পরামর্শে ডিআইএ পুনর্গঠনের জন্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে এডিবি ৫৫ শতাংশ আর বাংলাদেশ সরকার ৪৫ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগ করবে। আগামী ডিসেম্বরে সেসিপ-এর মেয়াদ শেষ হবে। এ সময়ের মধ্যে ডিআইএ পুনর্গঠন না করলে প্রকল্পের সুফল শতভাগ অর্জন সম্ভব হবে না। এজন্য সেসিপ অধিদপ্তর দুটি দ্রুত করতে তোড়জোড় শুরু করেছে।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর্মশালায় দুটি অধিদপ্তরের করলে কী কী সুবিধা হবে, কাজের পরিধি কী হবে— এসব বিষয়ে স্টেকহোল্ডার বা অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আরেকটি বৈঠকে এর কার্যক্রম চূড়ান্ত হতে পারে।

দুটি অধিদপ্তরের কাজ যা হবে

দেশের সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক ও প্রশাসনিক বিষয়গুলো দেখভাল করে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। এ ছাড়া সরকারি বেতন-ভাতা ও মঞ্জুরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার যথার্থতা যাচাই করে এ অধিদপ্তর। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিও শনাক্ত করছে ডিআইএ।

এখন প্রতিষ্ঠানটি পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০ এর আলোকে প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে ‘প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক কার্যালয়’ ও ‘অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হবে। প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক কার্যালয়ের কাজ হবে প্রতি বছর সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান যাচাই করা। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তরের কাজ হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে নিরীক্ষা করা।

আরও পড়ুন >> বিশেষ বিবেচনায় এমপিও, বৈষম্যের শিকার এমপি-মন্ত্রীরাও!

বিরোধিতায় বিসিএস শিক্ষা সমিতি

শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন চারটি অধিদপ্তরের মধ্যে তিনটির শীর্ষপদ প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের দখলে। যদিও এসব অধিদপ্তরে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থাকার কথা।

ডিআইএ ভেঙে দুটি দপ্তর করার উদ্যোগের বিরোধিতা করছেন শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, দুটি দপ্তর করা হলে সরকারি ব্যয় বেড়ে যাবে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পেছনে সরকারের বছরে গড়ে সাত কোটি টাকা ব্যয় হয়। আরেকটি দপ্তর করা হলে তা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ডলার সংকটের এ সময়ে এডিবি থেকে নেওয়া ঋণের টাকা অযথাই ব্যয় করা হবে। পাশাপাশি এ সংস্থা গঠন করা হলে প্রশাসনিক জটিলতাও তৈরি হবে। পাশাপাশি শিক্ষা বিভাগ চলে যাবে আমলাদের দখলে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদ হারানো আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।

শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা বলেন, এক দশক আগে মাউশি ভেঙে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর করে সেখানে মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদায়ন করার কথা থাকলেও সেখানে মহাপরিচালকসহ অধিকাংশ পদ প্রশাসন ক্যাডারের দখলে। ফলে ডিআইএ ভেঙে নতুন অধিদপ্তর করা হলে তাও শিক্ষা ক্যাডারের হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।

ডিআইএ পুনর্গঠনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিআইএ পুনর্গঠন করার প্রস্তাব আসার পর থেকে আমি এর বিরোধিতা করে আসছি। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘এ দপ্তর ভাঙলে কাজের সৌন্দর্য নষ্ট হবে। এজন্য ডিআইএ বিভক্ত না করে সেসিপ-এর সুপারিশ বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা কর্মশালায় তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু আমার সেই যুক্তি না মেনে সরকার যেহেতু পুনর্গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন আমার কিছুই বলার নেই।’

নতুন অধিদপ্তরের প্রস্তাবনায় যা আছে

ডিআইএ পুনর্গঠনে সেসিপ কর্তৃক একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয় ২০২১ সালে। প্রতিবেদনটি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির উপস্থিতিতে ওই বছর ১ অক্টোবর উপস্থাপন করা হয়। ওই সভায় উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে একটি সিদ্ধান্ত হয়। ওই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে গত ২৫ এপ্রিল সভা হয়।

আরও পড়ুন >> আত্তীকরণের সমাধান খুঁজতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তোড়জোড়

সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, শিক্ষানীতি- ২০১০ এ ডিআইএ পুনর্গঠনের বিষয়ে বলা আছে, মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক মান মূল্যায়ন এবং তার উন্নয়নে পরামর্শ প্রদানের দায়িত্ব পালনের নিমিত্ত একটি প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক অফিস স্থাপন করা হবে। অন্যদিকে, ডিআইএকে পুনর্গঠিত করা হবে, যা শুধু আর্থিক অডিট পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত ডিআইএ-এর পুনর্গঠন সংক্রান্ত গেজেটে এর কর্মপরিধি বিষয়ে বলা হয়েছে, এ দপ্তর নিয়মিতভাবে সব প্রতিষ্ঠান (বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত) পরিদর্শন ও নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

ডিআইএ পুনর্গঠনের বিষয়ে সেসিপ-এর প্রতিবেদনে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো, শিক্ষানীতি- ২০১০ এর প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। যার দায়িত্ব হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন করে একাডেমিক মান নির্ণয়পূর্বক প্রতি বছর এগুলোর র‌্যাংকিং নির্ধারণ করা এবং উন্নয়নের পরামর্শ প্রদান করা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ কর্তৃক জরুরিভিত্তিতে প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক কার্যালয়ের কার্যাবলি ও সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিদ্যমান ডিআইএকে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তরে রূপান্তর করা। আর্থিক নিরীক্ষা করা হবে এ প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব।

সভায় ডিআইএ পরিচালক পুনর্গঠন ছাড়াই উক্ত সুপারিশ কার্যকর করা যায় বলে মতামত দেন। তিনি (পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর) সভায় বলেন, স্কটল্যান্ড ও পর্তুগালে ডিআইএ-এর মতো কাঠামোতে বর্ণিত কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে— শিক্ষামন্ত্রী তার কাছে জানতে চান। জবাবে অধ্যাপক অলিউল্লাহ্ মো. আজমতগীর বলেন, বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিরীক্ষা ও পরিদর্শনের কাজ করে। ইতোপূর্বে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট অফিসের মাধ্যমে বিদ্যালয় নিরীক্ষার কাজ করা হলেও অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। সবার মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষানীতির আলোকে ডিআইএ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত দেন।

আরও পড়ুন >> কিং মুশতাক ও রানি সিনথিয়া উপাখ্যানে ‘বিব্রত’ আইডিয়াল

‘প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক কার্যালয়’ ও ‘অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর’— নামে দুটি কার্যালয়ের অর্গানোগ্রাম, কার্যপরিধি ও রিপোর্টিং সিস্টেমের বিষয়ে সুপারিশ প্রদানের জন্য দুটি কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয় সভায়। কমিটি গঠিত হওয়ার এক মাসের মধ্যে দুটি প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলা হয়।

জানতে চাইলে সেসিপ প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক শামসুন নাহার বলেন, ২০১০ সালের শিক্ষানীতির আলোকে ডিআইএ পুনর্গঠনের বিষয়ে যে দায়িত্ব ছিল আমরা তা পালন করেছি। এখন বাস্তবায়নের দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের। ডিআইএ-এর পরিবর্তে দুটি অধিদপ্তর বাস্তবায়নের জন্য দুটি আলাদা কমিটি গঠন করেছে মন্ত্রণালয়।

ওই কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামাণিক বলেন, ডিআইএ পুনর্গঠন করে ‘প্রধান শিক্ষা পরিদর্শক কার্যালয়’ ও ‘অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা অধিদপ্তর’ অফিস চালুর বিষয়ে বুধবার (৩০ আগস্ট) কর্মশালা হয়েছে। সবার মতামত নেওয়া হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে দুটি কমিটির প্রতিবেদন কর্মশালায় উপস্থাপন করা হয়েছে। আরেকটি বৈঠক করে তা চূড়ান্ত করা হবে।

আরও পড়ুন >> নির্বাচনের আগেই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও!

সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত ডিআইএ অবকাঠামো ও জনবল সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠাকালে দেশে সাড়ে সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল। বর্তমানে প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু সে তুলনায় জনবল বাড়ানো হয়নি। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় প্রতি বছর গড়ে দুই হাজার প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা যায় না। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আবার ডিআইএ-এর অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষকদের অযথা হয়রানি ও আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

এনএম/এমএআর/