• রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে তৃণমূল
• কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন নেতাকর্মীরা
• সামনে কী হবে, তা নিয়েও রয়েছে টেনশন
• স্মার্ট বাংলাদেশ কেমন হবে, বেড়েছে আগ্রহ 
• বিদেশিদের মাতব্বরি ভাবাচ্ছে তৃণমূল নেতাদের

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীনরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে এখনও অনড়। তারা নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি না নিয়ে বরং কূটনীতিক শিবিরে বেশি সময় দিচ্ছেন। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে তুলছেন প্রশ্ন। বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিদেশিদের কান ভারী করছে।

ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা একের পর এক কর্মসূচি দিচ্ছেন। দুই দলের শীর্ষ নেতারা কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলছেন না। এসব নিয়ে তৃণমূলের ভোটাররা কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। আগামী দিনগুলো কেমন হবে, কারা কারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, বিদেশিদের অবস্থান কী হবে— সবমিলিয়ে তৃণমূলের নজর এখন রাজধানী ‘ঢাকায়’।

জানা যায়, চলতি বছরের (২০২৩ সাল) শেষের দিকে অনুষ্ঠিত হতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আসন্ন এ নির্বাচনের আগে দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে বেশ কয়েকটি বিষয় চ্যালেঞ্জ মনে হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীরা ভোটারদের কাছে এখন থেকে ভোট চাইতে শুরু করেছেন। স্বয়ং আওয়ামী লীগ সভাপতি বেশ কয়েকটি জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। দল-মত নির্বিশেষে সবার কাছেই দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ভোট চাচ্ছেন। এদিকে, ভোটাররাও নির্বাচন প্রসঙ্গে নেতাদের নানা প্রশ্ন করছেন। বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি-না, বিদেশি কূটনীতিকরা কোন স্বার্থে এত তৎপর— আরও কত প্রশ্ন। সব প্রশ্নের জবাবও দেওয়ার চেষ্টা করছেন ক্ষমতাসীনরা।

আরও পড়ুন >> জাতীয় নির্বাচনের আগেই ‘স্মার্ট’ হচ্ছে আওয়ামী লীগ

চট্টগ্রাম বিভাগের সাবেক এক মন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগনেতা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, তৃণমূলের রাজনীতি আর ঢাকার রাজনীতি এক না। ঢাকা থেকে রাজনৈতিক নির্দেশনাগুলো আসে। তাই আমরা সবাই ঢাকার দিকে চেয়ে থাকি। কিন্তু ঢাকার রাজনীতির মূল প্রাণ তৃণমূল। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে অনেক জিজ্ঞাসা রয়েছে। আমরা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি। অধিকাংশ ভোটারই জানতে চান, কূটনীতিকরা কেন বারবার আসছেন? তারা (বিদেশি) কোনো চাপ দিচ্ছেন কি-না বা তাদের ওপর কোনো চাপ আছে কি-না? বিএনপি কি নির্বাচনে আসবে? কে পাচ্ছেন নৌকার প্রতীক?

‘আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি অনেক গুজব ছড়াচ্ছে। নির্বাচন হবে না— ভোটারদের কানে বারবার এ কথা আওড়াচ্ছেন বিএনপির নেতারা। ফলে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ ভোটাররা। এ অবস্থা থেকে ভোটারদের বের করে নিয়ে আসতে হবে। আওয়ামী লীগকেই তা করতে হবে। তবে, আওয়ামী লীগ গুজবের জবাব দিতে সচেষ্ট। এখন দেখার বিষয় আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে কতটুকু সক্রিয়। কারণ, নেগেটিভ জিনিস দ্রুত ছড়ায়। সেই নেগেটিভ জিনিসকে পজিটিভ করতে অনেক কাজ করতে হয়। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ না করলে গুজবের সঠিক জবাব দেওয়া যাবে না’— মনে করেন এ নেতা।

আরও পড়ুন >> যাকে মনোনয়ন দিই, তাকেই জয়ী করবেন

ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাধারণ ভোটাররা আমেরিকা-ভারত কী করছে, সেটি নিয়েই ব্যস্ত। এত দিন বিএনপি বলেছে, আমেরিকা আমাদের সঙ্গে আছে। যখনই ভারত বলল, এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। তখন ফখরুল বললেন যে, রাজনীতির ভেতরে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ! এত দিন আমেরিকা হস্তক্ষেপ করল, তিনি কি তার বাপ হন? আমরা তৃণমূল মনে করি, এমন চক্রান্ত বন্ধ হওয়া জরুরি। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ঐক্য জরুরি। চক্রান্ত বন্ধ ও ঐক্য থাকলে দেশি-বিদেশি সব ষড়যন্ত্র, খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের হাজারও ষড়যন্ত্র, কোনো কাজে আসবে না।’

ক্ষমতাসীন ও বিরোধীরা একের পর এক কর্মসূচি দিচ্ছেন। দুই দলের শীর্ষ নেতারা কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলছেন না। এসব নিয়ে তৃণমূলের ভোটাররা কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন। আগামী দিনগুলো কেমন হবে, কারা কারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, বিদেশিদের অবস্থান কী হবে— সবমিলিয়ে তৃণমূলের নজর এখন রাজধানী ঢাকায়

‘যুগ যুগ ধরে বিএনপি চক্রান্ত করে আসছে। চক্রান্তের বাইরে তাদের কোনো কাজ নেই। বাস্তব চিত্র হলো, মাঠে দাঁড়ানোর মতো তাদের কোনো লোক নেই। তাদের কিছু ভোটার আছে, কিন্তু কর্মী নেই। যে কারণে তারা মাঠে দাঁড়াতে পারে না। তাদের রাজনীতি হলো ষড়যন্ত্র করা। ষড়যন্ত্রের বাইরে বিএনপির কিছু নেই, কোনো পুঁজি নেই।’

‘প্রধানমন্ত্রী এত কিছু করছেন, তার কোনো প্রচার নেই। সংসদ সদস্যরা (এমপি) এর প্রচার করেন না। তারা বলেন না, এটা প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। বলেন, আমার বাপ-দাদার পক্ষ থেকে দিয়েছি। তারা যদি কাজগুলো সঠিকভাবে করতেন, টিআর-কাবিখা কর্মকাণ্ডগুলো সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতেন তাহলে কোনো সমস্যা হতো না। কোনো ষড়যন্ত্র কাজে আসত না।’

আরও পড়ুন >> ‘হারলে সুষ্ঠু, জিতলে কারচুপি’— বিব্রত আ. লীগ

বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. তৌহিদুল করিম (কল্লোল) ঢাকা পোস্টকে বলেন, তৃণমূল বিএনপির অবস্থা খুবই খারাপ। তারা হাইকমান্ড থেকে কোনো নির্দেশনা পেলে সেটা মানেন না। তারা চান নির্বাচনে অংশ নিতে। তাদের উদ্দেশ্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ। কিন্তু হাইকমান্ড তৃণমূলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়। এ কারণে তৃণমূল বিএনপির হাইকমান্ডকে মানে না। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখি দল। যে কোনো পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। তৃণমূল আওয়ামী লীগ এর ব্যতিক্রম নয়।

‘আমাদের (বগুড়া- ৪) আসনটা জাতীয় পাটির প্রার্থীকে দেওয়া হয়। ফলে নৌকার লোকেরা নৌকায় ভোট দিতে পারেনি। এবার আমাদের আকাঙ্ক্ষা জোটের প্রার্থীকে নয়, নৌকায় ভোট দেব। প্রার্থী নৌকার-ই হবে। হাইকমান্ড যাকে মনোনয়ন দেবে তাকে নিয়েই আমরা কাজ করব। আমরা কেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছি।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবু হুসাইন বিপু ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত যে সহিংসতার রাজনীতি করে, এটি দেশের মানুষ ভালো করেই জানে। তারা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। সহিংসতার মধ্য দিয়ে সরকারকে সরানোর যে দুঃস্বপ্ন তারা দেখছে, এ দেশের সাধারণ মানুষ কখনও তা পূরণ হতে দেবে না। কারণ, সাধারণ মানুষ জানেন জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছেই বাংলাদেশ বেশি নিরাপদ।

আরও পড়ুন >> জিএম কাদেরের ‘নীরবতা’র অনুবাদ— নির্বাচনকালীন সরকার হবেই!

যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আরশাদ পারভেজ বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে আমরা একটা সুন্দর নির্বাচন আশা করছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন যে দৃশ্যমান— তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সেটা দেখছেন। এখন বলা হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। এটা কী, আমাদের অনেক নেতাকর্মী তা জানেন না। একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। স্মার্ট কী, কেমন হবে— সেটা নিয়ে নেতাকর্মীরা আলাপ করছেন। পাশাপাশি ঢাকায় কী হচ্ছে, তার খোঁজখবর নিচ্ছেন। আমরা যখন নিজ এলাকায় উন্নয়নের প্রচার করতে যাই তখন দেখি, আগামী নির্বাচন নিয়ে সবার মধ্যে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সেই আগ্রহ স্মার্ট বাংলাদেশ কেমন হবে, তা নিয়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, বর্তমান ভোটাররা বেশ সচেতন। তারা আর অন্ধ বিশ্বাসী নন। প্রার্থী ও দল বিবেচনা করে তারা ভোট দেন। তিনি আরও বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ বেশ সচেতন। কারা কী করল, কোন কোন দেশের সঙ্গে বিএনপি বসছে, তারা নির্বাচনে না এলে আওয়ামী লীগ কী করবে, কোন এমপির সঙ্গে কোন নেতারা দ্বন্দ্ব, কাকে প্রার্থী করলে জয় নিশ্চিত হবে— সব বিষয়ে তারা বেশ ধারণা রাখেন। তাদের আর ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়।’

তবে, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ভোটারদের মধ্যে টেনশনও তত বাড়ছে। ভোটাররাও চান না, বিদেশিরা এখানে হস্তক্ষেপ করুক— জানান এ নেতা।

আরও পড়ুন >> বাস্তবতার নিরিখে নতুন কর্মসূচি চায় বিএনপির সঙ্গীরা

এদিকে, সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দিনদিন চাঙা হচ্ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতি। ভেদাভেদ ভুলে এক ছাতার নিচে আসার চেষ্টা করছেন তারা। নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে। ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্মীদের অবমূল্যায়ন ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতিসহ নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছে ভেড়ার চেষ্টা করছেন স্থানীয় এমপিরা।

দলীয় সূত্র মতে, নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসায় এলাকামুখি হচ্ছেন নৌকা প্রতীকের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। সেখানে দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন মুখ। তারা নিয়ম করে নিজ নিজ এলাকায় সময় দিচ্ছেন। তাদের পদচারণায় উজ্জীবিত কর্মী-সমর্থকরা। মূলত, বর্তমান এমপিদের টেক্কা দিয়ে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চান তারা।

বসে নেই বর্তমান এমপিরাও। তারাও ফের নৌকার মনোনয়ন নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছেন। দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব-বিভেদ, রাগ-ক্ষোভ ও অভিমান ভুলে সবাইকে নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। উঠান বৈঠক, কর্মী ও বর্ধিত সভা এবং দিবসভিত্তিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তৃণমূলের রাজনীতিতে ফের বইছে নির্বাচনী হাওয়া।

এমএসআই/এমএআর/