• আমার নিজের কোনো সম্পত্তি নেই : তিতাস এমডি
• মন্ত্রণালয় থেকে অভিযোগ পাঠানো হচ্ছে : পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান
• তিতাস এমডির শত্রুর অভাব নেই : মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব
• নিরপেক্ষ তদন্তে প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নিতে হবে : মির্জ্জা আজিজুল

মাত্র দুই বছরের জন্য তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ। এ সময়ের মধ্যেই দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি! অভিযোগ রয়েছে, দুই বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে অন্তত ৬৯০ কোটি টাকা পকেটে পুরেছেন হারুনুর রশীদ। যদিও এ অভিযোগ নাকচ করার পাশাপাশি নিজের কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ নেই বলে দাবি করেছেন তিনি!

জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তিতাস গ্যাসের এমডি হিসেবে যোগ দেন হারুনুর রশীদ। চাকরির মেয়াদ শেষে ২৯ সেপ্টেম্বর অবসরে যাওয়ার কথা রয়েছে তার। তবে, অবসরে যাওয়ার আগেই দুর্নীতিতে ফেঁসে যাচ্ছেন এ প্রকৌশলী। ইতোমধ্যে একটি-দুটি নয়, সুস্পষ্ট মোট ২৬টি ‘অতি গোপনীয় এবং অতি জরুরি’ বর্ণনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ ২৩ জনের কাছে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরাসরি ৩৯০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে আরও ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন হারুনুর রশিদ!

আরও পড়ুন >> তিতাসে বেতন পায় মৃত বা বিদেশে থাকা নিরাপত্তাপ্রহরীরাও!

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ / ফাইল ছবি

তিতাস এমডির বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অভিযোগগুলো হলো- ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো, গ্যাস বিপণন নিয়মাবলী- ২০১৪ লঙ্ঘন করে ৪০ কোটি টাকার ঘুষের লেনদেন, দুই কোটি টাকার বিনিময়ে সাড়ে ১০ কোটি টাকা মওকুফ, তিন কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে রাষ্ট্রের সাড়ে ১৩ কোটি টাকার ক্ষতি, গ্যাস বিপণন নিয়মাবলী- ২০১৪ লঙ্ঘন করে দুই কোটি টাকার ঘুষ বিনিময়, ফিদা সিএনজি অ্যান্ড ফিলিং স্টেশনের বকেয়া ৪৫ কোটি টাকা আদায় না করে অবৈধ ১০ কোটি টাকা লেনদেন, বকেয়া অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার পরও গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে পাঁচ কোটি টাকার ঘুষ গ্রহণ, তিন কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে রাষ্ট্রের সাড়ে ১৪ কোটি টাকার ক্ষতি, গ্যাস বিপণন নিয়মাবলী- ২০১৪ এবং মন্ত্রণালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে ২৫ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে স্থায়ীভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্নযোগ্য ১৭২টি আবাসিক গ্রাহক ও দুটি বাণিজ্যিক গ্রাহককে পুনঃসংযোগ।

আরও পড়ুন >> এমটিএফইর মতো উচ্চপ্রযুক্তির দুর্নীতি ধরতে জাইকার দ্বারস্থ দুদক

অভিযোগগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে— জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের নির্দেশনা উপেক্ষা করে তিন কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে লোড বৃদ্ধি ও নতুন সংযোগ প্রদান, পাঁচ কোটি টাকার আর্থিক লেনদেনের বিনিময়ে গড় বিল করে রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধন, ডেমরা এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে ৫০ কোটি টাকা আয়, আউটসোর্সিং বিধিমালা লঙ্ঘন করে তিতাস গ্যাসে জনবল নিয়োগ এবং নিয়োগ বাণিজ্য করে অবৈধভাবে পাঁচ কোটি টাকা আয়, ২০০ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে এক হাজার ২৪৭টি অবৈধ সংযোগ প্রদান এবং তা সার্ভারে এন্ট্রি দিয়ে বৈধ করা, এসব অভিযোগে দায়ের করা মামলার আসামিদের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে মামলা প্রত্যাহার বা ধামাচাপা দেওয়া, পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকার প্রি-পেইড মিটার ২৩ হাজার টাকায় কিনে রাষ্ট্রের কোটি কোটি আত্মসাৎ এবং ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে নতুন গ্যাস সংযোগ ও লোড বৃদ্ধি করে ৩০০ কোটি টাকার বাণিজ্য।

অর্থের বিনিময়ে অবৈধ সংযোগ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের এক প্রকৌশলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমডির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো সত্য। যদি অভিযোগগুলোর ভিত্তি না থাকত তাহলে সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা দেওয়া সম্ভব হতো না। তিনি গত দুই বছরে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। যদিও অনেকে বলেন, তার নেতৃত্বে তিতাসের অনেক অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

তিনি একদিকে যেমন অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন, তেমনি টাকার বিনিময়ে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে অবৈধভাবে সংযোগ দিয়েছেন। এমনকি আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনেক সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে অর্থের বিনিময়ে সুবিধা দিয়েছেন।

কৌশলে নানা অনিয়ম

অপর এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে জানান, দুর্নীতি করে এমডি হারুনুর রশীদ অনেক অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তিনি খুবই কৌশলে অনিয়মগুলো করেছেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে চলেন। ফলে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ গেলে তার বিরুদ্ধে কেউ ব্যবস্থা নেয় না। তবে, তিনি যে বলছেন তার কোনো সম্পদ নেই, বিষয়টি সঠিক হতে পারে। কারণ, দুর্নীতি করলে কেউ তো নিজের নামে সম্পদ গড়বে না। এমডির বেলাতেও ঠিক এমনটি হয়েছে। তিনি দুর্নীতি করে নিজের নামে কিছু করবেন না, এটাই স্বাভাবিক।

আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও তিতাসের অনেক সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করে অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্টদের অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন হারুনুর রশীদ / ফাইল ছবি

 বললেন পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযোগটি এখন পর্যন্ত আমার কাছে আসেনি। আমি আমার প্রশাসন শাখায় খোঁজ নিচ্ছি। যদি এ ধরনের কোনো অভিযোগ এসে থাকে তাহলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী অবশ্যই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে যাচাই-বাছাই করব। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তীতে আমরা ব্যবস্থা নেব।

আরও পড়ুন >> ২৮ বছরেও হয় না পদোন্নতি, ফাইলে নেই গতি

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে দুর্নীতির সবগুলো অভিযোগ সত্য নাও হতে পারে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো অভিযোগ মিথ্যাও হতে পারে। তবে, অভিযোগ যদি সুনির্দিষ্ট হয়, তদন্ত কমিটি তা যাচাই করবে। পদ্ধতিগতভাবে বা আইনগতভাবে যদি তিনি কোনো ভুল করে থাকেন, তাহলে তাকে দায়ী করা যায়। এজন্যই বলছি, আমার অফিস এরকম অভিযোগ পেয়েছে কি না, আমি তা খোঁজ নিয়ে দেখছি। অভিযোগ পেলে তাৎক্ষণিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।

আরও পড়ুন >> তিতাস ব্যবস্থাপকের স্ত্রীর এত সম্পদ!

পরবর্তীতে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে ফোন দিলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন শাখা এ সংক্রান্ত অভিযোগ পেয়েছে। তারা জানিয়েছে, অভিযোগটি দ্রুতই আমার কাছে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের কপি পেলে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করব। এরপর সত্যতা পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।

একটি-দুটি নয়, সুস্পষ্ট মোট ২৬টি ‘অতি গোপনীয় এবং অতি জরুরি’ বর্ণনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ ২৩ জনের কাছে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরাসরি ৩৯০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে আরও ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন হারুনুর রশিদ

অভিযোগ পেলে কাউকে ছাড় নয়

জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. আ. খালেক মল্লিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তিতাসের এমডি হারুনুর রশীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাইনি। আপনি আমাদের অফিসে এলে খুঁজে দেখা যেতে পারে। তবে, তার শত্রুর কোনো অভাব নেই। অভিযোগ এলে বা আপনারা রিপোর্ট করলে আমরা তদন্ত দিয়ে দেই। অভিযোগ পেলে আমরা কাউকে ছাড় দিই না।

আরও পড়ুন >> পেট্রোবাংলার পেটে সরকারের ২২ হাজার কোটি টাকা

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সার্বিকভাবে বাংলাদেশে এখনও ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে। এটা আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও এখনও জিরো টলারেন্সে নামেনি। যদি সরকারি কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তাহলে অবশ্যই নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। তদন্তের মাধ্যমে যদি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

যদি দুর্নীতি করতাম, তাহলে আমার বাড়ি-গাড়ি সবকিছু থাকত- তিতাস এমডি হারুনুর রশীদ / ফাইল ছবি

দুর্নীতির অভিযোগে যা বললেন তিতাস এমডি

৬৯০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তিতাস এমডি হারুনুর রশীদের। নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন তিনি। বলেন, প্রতিবারই এ ধরনের অভিযোগ করা হয়। তবে, বাস্তব অর্থে আমার নিজস্ব কোনো বাড়ি বা গাড়ি নেই। আমি এখান থেকে অবসরে গেলে রিকশা ছাড়া গাড়িতে চড়তে পারব না। আজ পর্যন্ত নিজের নামে কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট কিনতে পারিনি। যদি দুর্নীতি করতাম, তাহলে তো আমার সবকিছুই থাকত।

আরও পড়ুন >> দুর্নীতির ৯৮ মামলায় আসামি ১১১ সরকারি ব্যক্তি

ঢাকা পোস্টের কাছে আসা ২৬টি সুস্পষ্ট অভিযোগের বর্ণনা কীভাবে মিথ্যা বা মনগড়া হতে পারে- এমন প্রশ্নে তিতাস এমডি বলেন, ‘আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন, সত্যিই আমার কিছু আছে কি না? পরিবার নিয়ে এখনও ছোট্ট একটি  ফ্ল্যাটে বসবাস করি।’

এসআর/কেএ/এসকেডি