বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
ভিসি নিয়োগে আনফিটদের প্যানেল!
• দীর্ঘদিন মন্ত্রণালয়ে আটকে থাকে ভিসি নিয়োগের ফাইল
• দীর্ঘসূত্রতার দায় ইউজিসিকে দিচ্ছে এপিইউবি, এড়িয়ে যাচ্ছে মন্ত্রণালয়
• ১১৩ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৩টিতে নেই উপাচার্য
• ৮৩ বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নেই ৪৭টিতে
গত তিন বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল পাঠাচ্ছে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি। তিন বছরে দুবার উপাচার্যের প্যানেল প্রত্যাখ্যান করা হলেও এখনও উপাচার্য পায়নি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি।
বিজ্ঞাপন
গত দুই বছরে আশা ইউনিভার্সিটি থেকে তিনবার উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল পাঠালেও দুবার সে প্যানেল প্রত্যাখ্যান করা হয়। এখনও উপাচার্য সংকটে এ বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘদিন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এমনকি কোষাধ্যক্ষ সংকট থাকার পরও তিনবার কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের প্যানেল প্রত্যাখ্যান করা হয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির।
অনুসন্ধান বলছে, উপাচার্য নিয়োগের প্যানেল ফেরত পাবার এমন অভিজ্ঞতা শুধু প্রেসিডেন্সি, আশা বা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির নয়। দীর্ঘদিন উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এমনকি কোষাধ্যক্ষ না থাকলেও এসব পদে নিয়োগ নিয়ে চলছে ত্রিমুখী সংকট।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ অনুযায়ী, এসব পদে জনবল নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকলেও একদিকে যেমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় নিয়োগে গড়িমসি রয়েছে, তেমনি ইউজিসির অক্ষমতা এবং আইনের তোয়াক্কা না করা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ছাড় দেওয়ার মানসিকতাও পরিলক্ষিত হয়েছে। অদৃশ্য কারণে দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ে ভিসি নিয়োগের ফাইল আটকে থাকাও এ সংকটের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ অনুযায়ী, এসব পদে জনবল নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকলেও একদিকে যেমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় নিয়োগে গড়িমসি রয়েছে, তেমনি ইউজিসির অক্ষমতা এবং আইনের তোয়াক্কা না করা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ছাড় দেবার মানসিকতাও পরিলক্ষিত হয়েছে। অদৃশ্য কারণে দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ে ভিসি নিয়োগের ফাইল আটকে থাকাও এ সংকটের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ।
আরও পড়ুন >> জোড়াতালি দিয়ে চলছে ২০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
তারা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ এসব পদে জনবল নিয়োগ দিলে বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোক্তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হলে অতিরিক্ত অর্থ যেমন খরচ করতে হয় তেমনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য উপাচার্য থাকলে উদ্যোক্তারাও ক্ষমতাশূন্য হয়ে পড়েন। আইনে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা এসব প্রতিষ্ঠানকে অর্থ আয়ের মেশিন মনে করেন। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য এবং ব্যবসায়িক মনোভাবের প্রতিপক্ষ মনে করা হয় উপাচার্যদের। ফলে উপাচার্য প্যানেলে যোগ্যদের নাম না দিয়ে আজ্ঞাবহ এবং আনফিট শিক্ষকদের ভিসি হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে অযোগ্যদের নাম দিয়ে সময়ক্ষেপণ করার প্রক্রিয়া চলে। উপাচার্য নিয়োগে প্যানেলের চাহিদা জানা সত্ত্বেও বারবার তারা অনেকটা ইচ্ছাকৃত ভুল করেন। এতেই ঘটে বিপত্তি! আবার এমন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা প্যানেল প্রস্তুত করার নিয়মই জানেন না। এটা আরও ভয়ানক।
উপাচার্য নিয়োগে সংকট, আইনে কী বলা হয়েছে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন- ২০১০ এর ১৬ ধারার ৯ উপধারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য বোর্ড অব ট্রাস্টিজকে আচার্য (রাষ্ট্রপতি) সমীপে প্রস্তাব পেশ করার কথা বলা হয়েছে। একই আইনের ৩১ ধারার ৩ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, উপাচার্য পদে নিয়োগের জন্য প্রথম শ্রেণি বা সমমানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অথবা পিএইচডি ডিগ্রি এবং কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যূন ১০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসহ গবেষণা বা প্রশাসনিক কাজে মোট ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একই আইনের ৩২ ও ৩৩ ধারায় উপ-উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যূন ১০ বৎসরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসহ গবেষণা বা প্রশাসনিক কাজে মোট ১৫ বৎসরের অভিজ্ঞতা এবং কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের জন্য অন্যূন ১৫ বৎসরের অধ্যাপনা, প্রশাসনিক বা আর্থিক ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে।
আনফিটদের (অযোগ্য) প্যানেল দেওয়া হয় বলে অভিযোগ
আইনে উপাচার্য নিয়োগের বাধ্যবাধকতা থাকলেও দীর্ঘদিন এসব পদ ফাঁকা থাকার কী কারণ রয়েছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে ইউজিসি সচিব ড. ফেরদৌস জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাছে ভিসি নিয়োগের প্যানেল পাঠালে আমরা যাচাই-বাছাই করে সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেই৷ আসলে বেসরকারি ইউনিভার্সিটি থেকে এমনভাবে প্যানেল প্রেরণ করা হয় যাতে সেখান থেকে যেন ভিসি নিয়োগ না দেওয়া যায়৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী ভিসি থাকুক এটা অনেকে চান না৷ স্থায়ী ভিসি থাকলে তো তার বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়৷ ফলে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কালক্ষেপণ করেন।
আরও পড়ুন >> উপাচার্যসহ তিন শীর্ষপদ ছাড়া চলছে ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়
‘তারা যেহেতু নিয়ম অনুযায়ী ভিসি নিয়োগের প্যানেল প্রেরণ করে না, ফলে সুপারিশও করা যায় না৷ এছাড়া মালিকানা নিয়ে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে, সেসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্যানেলই পাঠানো হয় না৷ ভিসি নিয়োগের তাগাদা দিয়ে ইউজিসি থেকে প্রতি বছর তিন থেকে চারবার চিঠি দেওয়া হয়৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভিসি নিয়োগের ইচ্ছা না থাকলে তো ইউজিসি জোর করে নিয়োগ দিতে পারে না৷ এর বেশি আমরা কী করতে পারি’— প্রশ্ন রাখেন ইউজিসি সচিব।
ইউজিসির এসব নির্দেশনা অমান্য করলেও কেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না— এমন প্রশ্নের উত্তরে সচিব বলেন, ‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করাই সমাধান নয়৷ পদক্ষেপ নিতে গিয়ে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করে দিলে নিরীহ শিক্ষার্থীরা ভোগান্তিতে পড়েন৷ তখন সমস্যাটা জাতীয় আকার ধারণ করে৷ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়াটা স্থায়ী সমাধান নয় বরং এটি আরেকটি সমস্যা।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে চান— উল্লেখ করে সচিব বলেন, ‘কিছু কিছু লোক বাণিজ্যিক স্বার্থ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলেন৷ বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান৷ এখানে তো বাণিজ্যের সুযোগ নেই৷ তারপরও অনেকে বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই বাণিজ্য করে৷ তারা চায় না সবকিছু ঠিকভাবে চলুক৷ ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে তারা বিভিন্ন পদ্ধতি/পন্থা অবলম্বন করেন৷
‘বর্তমান আইনে ট্রাস্টি বোর্ড কাউকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিতে না চাইলে, কিছুই করা যায় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশোধিত আইনে সরকার চাইলে যে কাউকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিতে পারবে৷ নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে কিছুটা সুফল আসতে পারে।’
ভিসি সংকট নিয়ে কী বলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
আইন থাকার পরও টানা তিন/চার বছর ক্ষেত্রবিশেষে এর চেয়েও বেশি সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য না থাকার কী কারণ রয়েছে— জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. আবু ইউসুফ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নেই সেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন নেই? যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নেই আমরা তাদের বারবার চিঠি দিচ্ছি৷ কেউ ভিসি নিয়োগের প্যানেল পাঠাচ্ছে, কেউ পাঠাচ্ছে না৷ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে যাদের কোনো কার্যক্রম নেই৷ অনুমোদন নেওয়ার পর কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কার্যক্রমও শুরু করেনি৷ তাদেরই জিজ্ঞাসা করতে হবে কেন ভিসি নেই!’
উপাচার্য সংকটে বেহাল দশা : সমাধান কোথায়
দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগেরই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য নেই। এটি কীভাবে দেখছেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বহু আগে থেকেই আমরা এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে জনবল নিয়োগের কথা বলে আসছি৷ একটি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ ছাড়া চলছে, মানে এর কার্যক্রম ঠিকভাবে হচ্ছে না৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকা মানে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট সচল থাকা৷ একাডেমিক কাউন্সিল থেকে সিন্ডিকেট হয়ে না আসলে কোনো পরীক্ষার ফল বৈধ হয় না৷ উপাচার্য না থাকলে কাজটা করবেন কে? সত্যিকার অর্থে একজন উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কান্ডারি৷ ট্রাস্টি বোর্ডের দায়িত্ব সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি নেই, সেসব দেখভাল করা৷ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন তো একজন উপাচার্য।’
আরও পড়ুন >> বিশ্ববিদ্যালয় ও হলের পরিবেশ যেমন হওয়া উচিত
‘এখন যদি কান্ডারিই না থাকে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কীভাবে? যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নেই সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এসব পদ ফাঁকা আছে— সেই জবাবদিহিতার আওতায় কি আনা সম্ভব নয়? আমি মনে করি, এখানে ইউজিসির একটি শক্ত অবস্থান নেওয়া উচিত৷ এক বা দুই বছর উপাচার্য না থাকলে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া উচিত৷ এ ধরনের শক্ত পদক্ষেপ না নিলে এভাবেই চলতে থাকবে।’
শিক্ষার্থীদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে ট্রাস্টি বোর্ডকে ভিসি নিয়োগের সময়সীমা বেধে দেওয়া যেতে পারে৷ এরপরও ভিসি নিয়োগ না দিলে জরিমানা করা যেতে পারে৷ কোনো না কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে৷ এসবেও কাজ না হলে তাদের নোটিশ দিয়ে বলা যেতে পারে যে, নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ থাকবে৷ যেসব শিক্ষার্থী আছেন তাদের বিদায় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ করে দিতে হবে’— বলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
তার মতে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন-ভাতা প্রচুর৷ যদি এসব গুরুত্বপূর্ণ পদ ফাঁকা রেখেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অন্যায় করা হয়৷ তাদের পরিবারের সঙ্গে অন্যায় করা হয়৷ বেতন-ভাতা দিয়েও যদি তারা প্রাপ্যটা না পায় তাহলে তো সেটি অন্যায়৷ এদিকে, ইউজিসিকে তোয়াক্কা না করার একটি মনোভাব রয়েছে৷ ইউজিসির নির্দেশনা মেনেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা উচিত। সেটি না পারলে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দেওয়া উচিত৷ শিক্ষার্থী ও শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে ইউজিসির শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা জরুরি৷ ট্রাস্টি বোর্ড সঠিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে না পারলে সেটি হস্তান্তর কিংবা পাঁচ বছর মেয়াদের একটি সময়সীমা নিয়ে সেটি বন্ধ করে দেওয়া উচিত৷
ভিসি নিয়োগের প্যানেলে অযোগ্যদের নামের তালিকা দেওয়া মানে আইনের তোয়াক্কা না করা—উল্লেখ করে এ শিক্ষাবিদ বলেন, ‘একটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি উপাচার্য নিয়োগের প্যানেলই তৈরি করতে না পারে তবে তারা সেটি পরিচালনা করছে কীভাবে? তাদের অনুমতি দেওয়া হলো কীভাবে? আমি মনে করি, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুমতি দেওয়ার আগে সেটি পরিচালনার সক্ষমতা আছে কি না, ইউজিসিকে তা দেখতে হবে৷ প্যানেল প্রস্তুত করার সক্ষমতা আছে কি না, সেটিও দেখতে হবে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য একটি বড় পদ৷ এ পদে যারা নিয়োগ পান তাদের আকর্ষণ করার মতো সক্ষমতা আছে কি না, সেটিও দেখতে হবে৷ এগুলো না থাকলে অনুমোদন দেওয়া হলো কেন?’
‘একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে তখনই অনুমোদন দেওয়া উচিত যখন সব কিছুতেই তারা সক্ষম৷ ভিসি নিয়োগে পাঁচ মাসও সময় লাগার কথা নয়৷ বড়জোর পাঁচ দিন লাগার কথা৷ যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এভাবে চলছে তাদের পরিচালনার যোগ্যতাই নেই। দুইটা বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করতে পারলে বাকিরাও ঠিক হয়ে যাবে৷ বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হতে পারে না৷ নর্থ সাউথের মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয় যদি আইনের আওতায় আনা যায় তাহলে ছোটগুলো কেন আনা যাবে না? সমস্যা থাকার পরও ছাড় দিয়ে দিয়ে আমরা এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছি৷’
আরও পড়ুন >> ট্রাস্টি বোর্ডে এক পরিবারের তিনজনের বেশি নয়
‘একটি টেলিভিশন খোলা আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা কিন্তু এক জিনিস নয়৷ একজন কয়লা ব্যবসায়ী চাইলেই যে সুগন্ধি তেলের ব্যবসা করতে পারবেন, তা নয়৷ এখন আলাদা করে ভাবার সময় এসেছে যে কতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় চলা উচিত এবং কতগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত৷’
উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে ইউজিসিকে দায় দিচ্ছে এপিইউবি
উপাচার্য নিয়োগের প্রতিবন্ধকতা কোথায়— এমন প্রশ্নে অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সভাপতি শেখ কবির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ইউজিসি নিজেই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছে। তারা যে নীতিমালা করেছে সে নীতিমালায় ভিসি পাওয়া মুশকিল৷ ধরেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি নিয়োগ দেব না৷ সরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি থাকে না৷ সেখানে তারা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রো-ভিসি নিয়োগ দিতে এত সচেষ্ট কেন? সরকার টাকা দিয়েও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি দিতে পারে না অথচ আমরা টাকা দেব আবার প্রো-ভিসিও নিয়োগ দেব! নিয়োগ দিতে তারা এত উদগ্রীব কেন? এছাড়া ভিসি নিয়োগে যাদের নাম প্রস্তাব করা হয়, তাদের পাওয়াও মুশকিল৷ যারা ভিসি হিসেবে যোগ্য তারা সবাই মোটামুটি পরিচিত, আবার তারা আমাদের কলিগও। কেউ কারও বিকল্প হয়ে প্যানেলে থাকতে চান না৷ এটা একটা সমস্যা৷ আমরা দাবি করেছিলাম, একজন করে নাম পাঠানোর৷ সেটি চ্যান্সেলর অ্যাপ্রুভ করলে ভালো৷ না করলে আমরা আবার পাঠাব৷’
‘আমরা যে প্রস্তাব পাঠাই, সেটি নাকচ হয়ে ফেরত আসতেও তিন/চার মাস সময় লাগে৷ এসব কারণেই সমস্যা হচ্ছে৷ আমার মনে হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসির প্রয়োজন হয় না৷ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন প্রো-ভিসি দিলেও সমস্যা নেই৷ কারণ, সেখানে প্রয়োজন৷ কিন্তু দুই/তিন হাজার শিক্ষার্থীর ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পদের প্রয়োজন নেই৷ এ বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যানও একমত হয়েছেন৷ তিনিও বলেছেন, ছোট বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি নিয়োগ দেওয়া চাপ হয়ে যায়।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের সংগঠন- এপিইউবির এ শীর্ষ নেতা বলেন, ‘উপাচার্য নিয়োগে যোগ্যদের তালিকা পাঠানো হয় না— কথাটি ঠিক নয়৷ আসলে তিনজনের মধ্যে একজনের যদি একটু সমস্যা থাকে তাহলে তারা পুরো প্যানেলই বাদ দিয়ে দেয়৷ বাকি দুজন থেকে নির্বাচন করলে তো সমস্যা হয় না৷ দুজনের একজনকে নিয়োগ দিতে পারে৷ প্যানেল বানানোও তো কষ্ট৷ এদিকে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ইউজিসির খণ্ডকালীন ছয়জন দায়িত্বে আছেন অথচ বেসরকারির জন্য একজনও নেই৷ তাহলে আমাদের কথাটা সেখানে বলবে কে? স্থায়ী সদস্য না থাকুক ১১৩টি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির কি দুজন খণ্ডকালীন সদস্য থাকতে পারে না— প্রশ্ন রাখেন শেখ কবির হোসেন।
উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ সংকটে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়
ইউজিসির সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, দেশে বর্তমানে ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৪৩টিতে উপাচার্য নেই। উপ-উপাচার্য নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৩টি। কোষাধ্যক্ষ নেই ৪৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘদিন এসব গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য রেখেও দিব্যি সব একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। ইউজিসি থেকে বারবার এসব পদে জনবল নিয়োগের কথা বলা হলেও গায়ে মাখছে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
আরও পড়ুন >> নির্বাচনের আগেই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও!
ইউজিসির জোরালো ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে মত শিক্ষাবিদদের
উপাচার্য নিয়োগে এমন সংকট নিয়ে ইউজিসিকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে বলে জানিয়েছেন ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানরা এমন শিক্ষকদের ভিসি হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেন যারা তাদের মতো চলেন এবং কথা শোনেন। অযোগ্য হলেও তাদেরকেই সুপারিশ করা হয়। এদিকে বেসরকারি ইউনিভার্সিটিগুলোতে ছাত্র সংখ্যা কম, ফান্ডের ঘাটতিসহ বিভিন্ন সমস্যা থাকে। ফলে যারা উপাচার্য হওয়ার যোগ্য তারা এগুলো বিবেচনায় নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে উপাচার্য হতে চান না।
দেশের প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ট্রাস্টি বোর্ড যেমন খুশি তেমনভাবেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান। কিন্তু রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হলে তা আর সম্ভব হয় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপাচার্যদের প্রতিপক্ষ মনে করতে শুরু করেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশে বহু বেসরকারি ইউনিভার্সিটি হয়েছে। কিন্তু এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য প্রশাসন নিয়ে এখনো সমস্যা রয়েই গেছে। আমি মনে করি- এ সংকট দূর করতে ইউজিসির জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। ইউজিসি জাতীয়ভাবে সব সিনিয়র প্রফেসরদের একটি তালিকা করতে পারে। এ তালিকা থেকেই ইউজিসি বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির জন্য উপাচার্য নিয়োগের সুপারিশ করতে পার। তাহলেই এ সমস্যা কমে আসবে।
এ বিষয়ে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে চায় না। এসব পদে নিয়োগ দিলে যেহেতু তাদের কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা দিতে হয় সেহেতু ইচ্ছাকৃতভাবেই এসব পদ শূন্য রাখা হয়। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড চায় রাষ্ট্রপতি যে উপাচার্য নিয়োগ দেন তারা তাদের বেতনভুক্ত কর্মচারী হোক। তারা ভুলে যান উপাচার্য, উপ-উপাচার্য এমনকি কোষাধ্যক্ষ কিন্তু তাদের বেতনভুক্ত কর্মচারী না।
তিনি বলেন, কিছু প্রতিষ্ঠান আছে বিশ্ববিদ্যালয়কে সনদ বিক্রির দোকান মনে করে। আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় একবার সব ইউনিভার্সিটিকে নোটিশ করলাম যাদের উপাচার্য নেই তারা দ্রুত উপাচার্য নিয়োগ দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে। কারণ যেসব শিক্ষার্থী তাদের কোর্স শেষ করে বের হচ্ছেন তাদের সনদে যদি বৈধ উপাচার্যের স্বাক্ষর না থাকে তাহলে তো সেই সনদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। ইউজিসিতে আজাদ সাহেব থাকতেই নর্থ-সাউথের বিরুদ্ধে কত রিপোর্ট হয়েছে। কিন্তু সেসব মন্ত্রণালয়ে গিয়েই মারা পড়ে। এদিকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি চলছে রাস্তার লাইসেন্সবিহীন টেম্পুর মতো। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি দুই হাজার শিক্ষার্থীর অনুমতি নিয়ে আট হাজার সনদ বিক্রি করছে। এটাই দেশের একমাত্র ইউনিভার্সিটি যারা কনভোকেশনে রাষ্ট্রপতিকে দাওয়াত দিয়ে সেটা বাতিল করেছে। আসলে এভাবেই চলছে সবকিছু।
উপাচার্য নেই যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে
ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, আশা ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ডেলটা ইউনিভার্সিটি, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, ব্রিটানিয়া ইউনিভার্সিটি, চিটাগাং ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, টাইমস ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি সৈয়দপুর, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি কাদিরাবাদ, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি কুমিল্লা, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস, এপিআই ইউনিভার্সিটি, নরদান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলোজি খুলনা, ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলোজি চট্টগ্রাম, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি, রবীন্দ্র সৃজনকলা ইউনিভার্সিটি, রূপায়ণ এ কে এম শামসুজ্জোহা ইউনিভার্সিটি, আনোয়ার খান মডার্ন ইউনিভার্সিটি, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি রাজশাহী, মাইক্রোল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, শেখ হাসিনা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি, বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি খুলনা, তিস্তা বিশ্ববিদ্যালয়, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজি বাংলাদেশ, লালন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইবাইস ইউনিভার্সিটি ও দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা।
এমএম/এমএআর/