দেশের সরকারি কর্মচারীদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কল্যাণার্থে গঠিত হয় বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী কল্যাণ বোর্ডটি ২১ সদস্য বিশিষ্ট। চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব ছাড়া বাকি ১৯ জন এ বোর্ডের সদস্য। এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মনোনীত ১৩ থেকে ১৬ গ্রেডের একজন কর্মচারী প্রতিনিধি এবং ১৭ থেকে ২০ গ্রেডের একজন কর্মচারী প্রতিনিধি রয়েছেন।

শুধু বোর্ড নয়, আইনানুযায়ী বোর্ডের আঞ্চলিক কল্যাণ কমিটিতেও রয়েছেন ১৩ থেকে ১৬ ও ১৭ থেকে ২০ গ্রেডের এ দুই প্রতিনিধি। বোর্ড ও আঞ্চলিক কমিটি থেকে ওই দুই প্রতিনিধিকে বাদ দেওয়ার বিধান রেখে নতুন আইনের খসড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড।

জানা গেছে, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের অধীনে সাবেক সরকারি কর্মচারী কল্যাণ অধিদপ্তর ও সাবেক বোর্ড অব ট্রাস্টিজ (কল্যাণ তহবিল ও যৌথবিমা তহবিল) একীভূত করে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলাদেশ সরকারের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আর্থসামাজিক নিরাপত্তার বিধানসহ তৃণমূল পর্যায়ে অধিকতর কল্যাণসাধনের জন্য এ বোর্ড গঠন করা হয়।

আইনানুযায়ী বোর্ডের আঞ্চলিক কল্যাণ কমিটিতেও রয়েছেন ১৩-১৬ ও ১৭-২০ গ্রেডের এ দুই প্রতিনিধি। বোর্ড ও আঞ্চলিক কমিটি থেকে ওই দুই প্রতিনিধিকে বাদ দেওয়ার বিধান রেখে নতুন আইনের খসড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড

আরও পড়ুন >> ২৮ বছরেও হয় না পদোন্নতি, ফাইলে নেই গতি

২০১৮ সালে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড আইনের সংশোধন করা হয়। আইনটি ‘যুগোপযোগী’ করতে আবারও তা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড। এজন্য ‘বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড (সংশোধন) আইন, ২০২৩’ এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামতও চাওয়া হয়েছে।

৫ ধারা অনুযায়ী বোর্ড গঠন

বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড আইনের ৫ ধারায় বোর্ড গঠনের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বোর্ডের চেয়ারম্যান। মহাপরিচালক একই সঙ্গে এ বোর্ডের সদস্য সচিবও।

সদস্য হিসেবে রয়েছেন যথাক্রমে- সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব (প্রশাসন), অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব (বাজেট উইং), মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব, লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের যুগ্মসচিব, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মনোনীত একজন প্রতিনিধি (যুগ্মসচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন), স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, সব বিভাগীয় কমিশনার, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সচিবালয় ও কল্যাণ), বোর্ডের পরিচালক, বিভাগীয় পরিচালক, উপপরিচালক, কল্যাণ সমিতির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মনোনীত ১৩-১৬ গ্রেডের কর্মচারী প্রতিনিধি ও ১৭-২০ গ্রেডের কর্মচারী প্রতিনিধি।

নতুন আইনের খসড়া অনুযায়ী, বোর্ড ও আঞ্চলিক কল্যাণ কমিটি থেকে বাদ যাচ্ছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মনোনীত ১৩-১৬ গ্রেডের একজন কর্মচারী প্রতিনিধি এবং ১৭-২০ গ্রেডের একজন কর্মচারী প্রতিনিধি। আইনটি পাস হলে ১৯ বছর ধরে চলে আসা এ নিয়ম বাদ পড়বে। ফলে বোর্ড কিংবা কমিটিতে ১৩-২০ গ্রেডের কোনো প্রতিনিধি থাকবেন না

বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড আইনের যে খসড়া তৈরি হয়েছে সেখানে যারা থাকছেন- ১. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/সচিব (তিনি বোর্ডের চেয়ারম্যানও হবেন), ২. অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব অথবা প্রতিনিধি (যুগ্মসচিবের নিচে নয়), ৩. অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব অথবা প্রতিনিধি (যুগ্মসচিবের নিচে নয়), ৪. লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব অথবা প্রতিনিধি (যুগ্মসচিবের নিচে নয়), ৫. সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/সচিব অথবা প্রতিনিধি (যুগ্মসচিবের নিচে নয়), ৬. স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব অথবা প্রতিনিধি (যুগ্মসচিবের নিচে নয়), ৭. মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব/সচিব অথবা প্রতিনিধি (যুগ্মসচিবের নিচে নয়), ৮. গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/সচিব অথবা প্রতিনিধি (যুগ্মসচিবের নিচে নয়, ৯. গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, ১০. বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের প্রতিনিধি (অতিরিক্ত মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিচে নয়), ১১. বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নরের প্রতিনিধি (নির্বাহী পরিচালকের নিচে নয়), ১২. বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের  চেয়ারম্যান, ১৩. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ১৪. বিভাগীয় কমিশনার (সকল), ১৫. বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক, ১৬. জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (সচিবালয় ও কল্যাণ), ১৭. বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি, ১৮. বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (যিনি এটির সদস্য সচিব হবেন)।

সংশোধিত খসড়ায় ১৩-১৬ ও ১৭-২০ গ্রেডের দুই প্রতিনিধিকে বাদ দেওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সরকারি কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা / প্রতীকী ছবি

বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আঞ্চলিক কল্যাণ কমিটি

বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী বোর্ডের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রত্যেক বিভাগে একটি করে আঞ্চলিক কল্যাণ কমিটি রয়েছে। বিদ্যমান আইনে এ কমিটির একজন সভাপতি, একজন সদস্য সচিব এবং আটজন সদস্য রয়েছেন।

আরও পড়ুন >> কে হচ্ছেন ২৪তম প্রধান বিচারপতি

এর মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার সভাপতি এবং সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন বোর্ডের বিভাগীয় উপপরিচালক। সদস্য হিসেবে রয়েছেন- বিভাগীয় কমিশনার মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, উপমহাপুলিশ পরিদর্শক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক, গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, কল্যাণ সমিতির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে বিভাগীয় কমিশনার মনোনীত ১৩ থেকে ১৬ গ্রেডের কর্মচারীদের একজন প্রতিনিধি এবং ১৭ থেকে ২০ গ্রেডের কর্মচারী প্রতিনিধি।

‘বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড (সংশোধন) আইন, ২০২৩’ এর খসড়া অনুযায়ী, আঞ্চলিক কল্যাণ কমিটিতে থাকছেন- ১. বিভাগীয় কমিশনার (যিনি এর সভাপতিও হবেন), ২. বিভাগীয় কমিশনার মনোনীত একজন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, ৩. উপমহাপুলিশ পরিদর্শক, ৪. স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক, ৫. মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক, ৬. সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক, ৭. গণপূর্ত বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, ৮. বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রক, ৯. বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত মনোনীত প্রতিনিধি, ১০. বোর্ডের সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভাগীয় পরিচালক (যিনি এটির সদস্য সচিবও হবেন)। 

বোর্ড ও কমিটি থেকে বাদ যাচ্ছেন ১৩-২০ গ্রেডের কর্মচারী প্রতিনিধি

‘বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ড (সংশোধন) আইন, ২০২৩’ এর খসড়া অনুযায়ী, বোর্ড ও আঞ্চলিক কল্যাণ কমিটি থেকে বাদ যাচ্ছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে মনোনীত ১৩-১৬ গ্রেডের একজন কর্মচারী প্রতিনিধি এবং ১৭-২০ গ্রেডের একজন কর্মচারী প্রতিনিধি। আইনটি পাস হলে ১৯ বছর ধরে চলে আসা এ নিয়ম বাদ পড়বে। ফলে বোর্ড কিংবা কমিটিতে ১৩-২০ গ্রেডের কোনো প্রতিনিধি থাকবেন না।

কর্মচারী নেতাদের ক্ষোভ

এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন কর্মচারীদের তিনজন নেতা। বিষয়টি নিয়ে তারা ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। তবে, তাদের বক্তব্য ‘কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যায়’ বিধায় নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তারা।

আরও পড়ুন >> নিয়োগ দুর্নীতিতে ফাঁসছেন যবিপ্রবির সাবেক ভিসি!

১৬-২০ গ্রেডের সরকারি কর্মচারী সমিতির একজন নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৯ বছর ধরে চলে আসা একটি নিয়ম তারা কেন হঠাৎ বাদ দিয়ে দিচ্ছেন? এটি হয়ত তারা ‘ইগো প্রবলেম’ থেকে করছেন। কারণ, তারা চান না বড় বড় কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বোর্ড সভায় আমাদের মতো কর্মচারীরা থাকুক।

১৯ বছর ধরে চলে আসা একটি নিয়ম ‘ইগো প্রবলেম’ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন সংক্ষুব্ধরা / ছবি- ঢাকা পোস্ট  

১৭-২০ গ্রেডের কর্মচারী সমিতির আরেক নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, যদি ১৭-২০ গ্রেডের কর্মচারীদের প্রতিনিধিকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে বোর্ডে আমাদের প্রতিনিধিত্ব কে করবেন? এটি অযৌক্তিক একটি সিদ্ধান্ত বলে আমরা মনে করি।

বোর্ড-কমিটিতে তারা থাকবে না কেন

বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী ঐক্য পরিষদের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইনের খসড়ায় আমরা দেখলাম, ১৩-১৬ গ্রেড এবং ১৭-২০ গ্রেডের কর্মচারী প্রতিনিধিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে যারা বোর্ড ও কমিটিতে থাকবেন, তারা সবাই বড়-বড় কর্মকর্তা। বোর্ড ও কমিটিতে আমাদের হয়ে তারা ঠিকভাবে কথা বলবেন? এখানে অবশ্যই আমাদের প্রতিনিধি থাকা উচিত। এটি অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক (সচিব) কাজী এনামুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, খসড়াটি তৈরি করার সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। তখন এ পদে অন্য একজন ছিলেন। আমি এখানে নতুন এসেছি।

আরও পড়ুন >> প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনকালীন সরকারের আকার

মহাপরিচালক আরও বলেন, আইনটির খসড়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত চাওয়া হয়েছে। এটি তো এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

এ বিষয়ে তিনি অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা, গবেষণা ও উন্নয়ন) এ কে এম আবদুল্লাহ খানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তার দপ্তরে গেলে বলা হয়, উনি একটি মিটিংয়ে আছেন। পরবর্তীতে একাধিকবার ফোন করা হলেও ধরেননি তিনি।

এসএইচআর/