রেড নোটিশেই আটকা ‘৬৫ অপরাধীর’ ফেরানো প্রক্রিয়া
বাংলাদেশে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে ১৮ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম ঝুলছে পুলিশ সদরদপ্তরের তালিকায়। ইন্টারপোলের সহযোগিতায় ৬৫ জন অপরাধীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। যদিও ইন্টারপোলের তালিকায় রয়েছে ৬২ বাংলাদেশির নাম। এ তালিকায় রয়েছে যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও পুলিশের করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর ১৮ জনের নামও। তবে, নানা চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের কাউকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি পুলিশ।
ইন্টারপোলের সর্বশেষ রেড নোটিশের সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরাফ খান নামে ভারতীয় পাসপোর্টে দুবাই আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশি রবিউল ইসলামের নাম। পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) সূত্রে জানা যায়, অনেক দিন ধরে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করেও তাদের ফিরিয়ে আনতে পারেনি বাংলাদেশ পুলিশ। তবে পুলিশ সদরদপ্তরের দাবি, বিগত কয়েক বছরের বিভিন্ন সময়ে ১৫ অপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পর ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার ও ওমান থেকে ১৫ জনকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে
ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পর ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার ও ওমান থেকে ১৫ জনকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে।
বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকার পরও ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ নামের এক অপরাধীকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামি। এর আগে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর ইন্টারপোলের মাধ্যমে কামরুল নামের এক হত্যা মামলার আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
আরও পড়ুন >> অবশেষে আরাভ খানের নামে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ
পুলিশ সদরদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীর অবস্থান নিশ্চিত হলেই শুধু হবে না, ছবি ও নামের সঙ্গেও মিল থাকতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অবস্থান নিশ্চিত হলেও অপরাধীরা অবস্থান বদলে ফেলে। আবার অনেকে অন্য দেশের পাসপোর্টে সেই দেশ বা অন্য দেশে আশ্রয় নেয়। তাদের শনাক্ত ও দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশের আইনও একটি বাধা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদরদপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাইলেই কাউকে ফেরানো সহজ নয়। কারণ, চুক্তি থাকতে হবে। ভারত ও থাইল্যান্ড ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় বা প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সদিচ্ছার ওপর।
অপরাধীর অবস্থান নিশ্চিত হলেই শুধু হবে না, ছবি ও নামের সঙ্গেও মিল থাকতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অবস্থান নিশ্চিত হলেও অপরাধীরা অবস্থান বদলে ফেলে। আবার অনেকে অন্য দেশের পাসপোর্টে সেই দেশ বা অন্য দেশে আশ্রয় নেয়। তাদের শনাক্ত ও দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশের আইনও একটি বাধা
পুলিশের তথ্য মতে, গত ছয় বছরে মাত্র একজনকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। তিনি হলেন ঢাকার শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে সুমন সিকদার ওরফে মুসাকে। ২০২২ সালের ৮ মে মুসা ওমানে যাওয়ার পর বিষয়টি মাস্কাটের ইন্টারপোল ডেস্ককে অবহিত করে ঢাকা। ৯ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিদেশ থেকে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়টি মূলত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। এক্ষেত্রে ইন্টারপোলের সহায়তা নিয়ে থাকে বাংলাদেশ পুলিশ। দাপ্তরিকভাবে পুলিশ সদরদপ্তরকে এনসিবি’র মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর অবস্থান, ছবি ও পরিচয় সম্পর্কে তথ্য দিয়ে ইন্টারপোলকে অবহিত করলে সহায়তা করে সংস্থাটি।
আরও পড়ুন >> পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’ জারি
ইন্টারপোলের লাল নোটিশে থাকা কোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলে কিংবা মারা গেলে তার নাম ওই নোটিশ থেকে মুছে ফেলা হয়। পাঁচ বছরে একবার ওই নোটিশে থাকা নামের তথ্য আপডেট করা হয়।
তথ্য মতে, ইন্টারপোল বিশ্বের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক অপরাধের তিনটি প্রধান ক্ষেত্র- সন্ত্রাসবাদ, সাইবার অপরাধ ও সংগঠিত অপরাধ নিয়ে কাজ করে। এটি বিশ্বব্যাপী আইন প্রয়োগকারীকে তদন্তমূলক সহায়তা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ প্রদান ছাড়াও পলাতক অপরাধী, জননিরাপত্তা এবং সন্ত্রাস, মাদক ও মানবপাচারকারীসহ যেকোনো সদস্য দেশের পুলিশকে জরুরি সহায়তা বা অপারেশনাল কার্যক্রমে সহায়তা করে থাকে।
গত ছয় বছরে মাত্র একজনকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। তিনি হলেন ঢাকার শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে সুমন সিকদার ওরফে মুসাকে। ২০২২ সালের ৮ মে মুসা ওমানে যাওয়ার পর বিষয়টি মাস্কাটের ইন্টারপোল ডেস্ককে অবহিত করে ঢাকা। ৯ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়
পুলিশের তালিকায় শীর্ষ ১৮ সন্ত্রাসী যারা
এখন পর্যন্ত পুলিশের তালিকায় ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন- ‘আব্বাস ওরফে কিলার আব্বাস, জাফর আহমেদ ওরফে মানিক, শামীম আহমেদ ওরফে আগা শামীম, লিয়াকত হোসেন, ইমামুল হোসেন ওরফে হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আমিনুর রসুল ওরফে টোকাই সাগর, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আরমান ওরফে সুমন, কামাল পাশা ওরফে পাশা, খন্দকার তারভীর ইসলাম জয়, আব্দুল জব্বার ওরফে মুন্না, ইমাম হোসেন, খোরশেদ আলম ওরফে ফ্রিডম রাসু, সোহেল রানা ওরফে ফ্রিডম সোহেল ও খন্দকার নাঈম আহমেদ টেটন।
তবে, পুলিশের এ খাতায় নাম দেখা যায়নি শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ, কামরুল আলম মুন্না, নবী হোসেন, শাহাদত হোসেন ও কামরুজ্জামানের।
দেড় ডজন মামলার নিয়েও নিরাপদে পালায় শীর্ষ সন্ত্রাসী টোকাই সাগর
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য মতে, টোকাই সাগরের জন্ম চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের বাউরিয়া গ্রামে। সাগরের আসল নাম আমির হোসেন। টোকাই সাগর সন্দ্বীপের বাউরিয়া হাইস্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাড়ি ছাড়েন। সন্দ্বীপ থেকে আসেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী মার্কেটে। ১৯৮৬ সালে কর্ণফুলী মার্কেটে চাঁদাবাজি নিয়ে এক যুবক খুন হন। সেই মামলার আসামি সাগর ঢাকার আগারগাঁও বস্তিতে আশ্রয় নিয়ে নাম ধারণ করেন আমিন রসুল সাগর। ১৯৮৯ সালে ডাকাতির অভিযোগে ডিবি তাকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে গ্রেপ্তার হয়েও কিছুদিন পর ছাড়া পান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুবলীগের লিয়াকত ও মুরগি মিলনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে সাগরের হাত থেকে বিমানবন্দরের ইজারা চলে যায় আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার ছেলে দীপু চৌধুরীর হাতে। এতে মুরগি মিলনের লাভ হয়। এ নিয়ে সাগর ও মিলনের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। পরে কালা জাহাঙ্গীর ও সুব্রত বাইনের সঙ্গে নিয়ে মুরগি মিলনকে খুন করেন সাগর।
পুলিশের খাতায় সাগরের বিরুদ্ধে মামলা ছিল ১২টি। সব মামলায় তিনি জামিন পেয়েছিলেন। ঢাকাই সন্ত্রাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বিত্তবান সাগর ২০০১ সালের ৩ এপ্রিল দুবাই থেকে ঢাকায় ফেরার পথে গ্রেপ্তার হন। এরপর একদিন সবার অজান্তে জামিনে বের হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। সাগর এখন নিউইয়র্কের ফ্ল্যাশিং এলাকায় বাড়ি কেনাবেচার ব্যবসায় বেশ নামডাক করেছেন।
খুনি রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাঠাতে বিভিন্ন সময়ে আবেদন জানালেও দেশ দুটির সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। অন্যদিকে, আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন কোথায় আছেন সেই তথ্যও নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার
দুবাইয়ে গ্রেপ্তারের পরও মুচলেকায় চম্পট সন্ত্রাসী জিসান
কুমিল্লার ছেলে জিসানের বেড়ে ওঠা ঢাকার রামপুরায়। এলাকায় মাস্তানি করতে করতে চাঁদাবাজ হয়ে যান। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে খিলগাঁও এলাকার সন্ত্রাসী আসিফের সঙ্গে মিশে অস্ত্র হাতে নিয়ে খুনখারাবিতে জড়িয়ে পড়েন। ওই সময় ঢাকায় কালা জাহাঙ্গীর গ্রুপের সঙ্গে তাদের বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিএনপি সরকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিলে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। সেই তালিকায় জিসানের নামও ছিল। ২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুই ডিবি পুলিশকে হত্যা করেন জিসান। এরপর তাকে ধরতে তৎপর হয় প্রশাসন। ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি। এরপর তার নামে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করা হয়।
এনসিবি’র তথ্য মতে, সেই সময় পালিয়ে গিয়ে প্রথমে ভারতে আশ্রয় নেন জিসান। সেখানে নাম পাল্টে আলী আকবর চৌধুরী পরিচয়ে ভারতীয় পাসপোর্ট সংগ্রহ করে তিনি দুবাই চলে যান। সেখানে বসেই রেস্তোরাঁ ও গাড়ির ব্যবসা করছেন তিনি।
আরও পড়ুন >> টেলিটকের তারেককে ধরতে রেড নোটিশ জারির নির্দেশ
ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে জিসানের যোগসূত্র মেলায় দুবাইয়ে আশ্রয় নেওয়া জিসানকে ফেরানোর চেষ্টা করে পুলিশ। জিসানকে ইন্টারপোলের সহযোগিতায় গ্রেপ্তারও করে দুবাই পুলিশ। সেসময় তার হাতে ছিল ভারত ও ডমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্ট। এ পাসপোর্ট নিয়ে তিনি এতদিন দুবাইয়ে অবস্থান করছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি মুচলেকা দিয়ে জামিন নেন। এক সপ্তাহের মাথায় চলে যান লন্ডনে।
সেসময় জিসানকে ফেরানোর বিষয়ে এনসিবি কর্মকর্তারা জানান, ভারত ও থাইল্যান্ড ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তবে, দুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট অর্থাৎ এমএলএ’র মাধ্যমে জিসানকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
হত্যাসহ দেড় ডজন মামলার আসামি শাহাদত কোথায়
রাজধানীর মিরপুর এলাকায় সবার কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত। এক সময় তিনি মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজধানীর মিরপুরের স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মনির উদ্দিন মনু হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শাহাদাত। ২০০২ সালের ১০ মে কমিশনার সাইদুর রহমান নিউটন হত্যাকাণ্ডের পর দেশ ছাড়েন শাহাদাত। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ দেড় ডজন মামলা রয়েছে। পুলিশের খাতায় শাহাদাত মোস্ট ওয়ানটেড হিসেবে তালিকাভুক্ত। যে কজন পলাতক আসামিকে গ্রেপ্তারে সরকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে শাহাদাত তাদের মধ্যে প্রথম সারির একজন। পালিয়ে শাহাদাত ভারতে আশ্রয় নেন।
২০২০ সালে লিবিয়ায় পাচার হওয়া ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনের নামে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের জাফর ইকবালকে ইতালিতে গ্রেপ্তার করে দেশটির পুলিশ। ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি এনসিবিকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করে এনসিবি রোম। পুলিশের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, জাফরকে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ ৪০ দিন সময় লাগতে পারে। তবে, আড়াই বছরেও তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি
বছর পাঁচেক আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত কলকাতা পুলিশের হাতে আটক হলেও পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। শাহাদত ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে দুবাই হয়ে ইতালি চলে যান। ভারতে তার স্থায়ী বসবাসের খবর পাওয়া গেলেও তিনি দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত যাতায়াত করেন বলে জানা যায়। তার কাছে বিশ্বের একাধিক দেশের পাসপোর্টও রয়েছে।
একইভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে অবস্থান নেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ ও তানভীরুল ইসলাম জয়, নেপালে সুব্রত বাইন, দুবাইয়ে আতাউর ধরা পড়লেও দেশে ফেরানো সম্ভব হয়নি। ওই দেশের আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা আশ্রয় নেন অন্যত্র। মাঝেমধ্যে দু-একজন ভারত, দুবাই, নেপালে আটক হওয়ার তথ্য পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবি শাখা পায়। তবে, তাদের সবাইকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ শীর্ষ সন্ত্রাসী ভারতে অবস্থান করছে।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে গ্রেপ্তার হন ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ। সে সময় বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাকে দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আর ফেরত আনা সম্ভব হয়নি।
পুলিশ বলছে ৬৫ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ
কতজন পলাতক আসামিকে ফেরাতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে— এমন লিখিত প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সদরদপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ থেকে জানানো হয়, সংখ্যাটি ৬৫।
ইন্টারপোলের তথ্য মতে রেড নোটিশে ৬২ বাংলাদেশি
তবে, ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে ‘রেড নোটিশ অব ওয়ান্টেড পারসন্স’ তালিকায় বিভিন্ন দেশের মোট ছয় হাজার ৯৪৮ জন অপরাধীর ছবি, নাম ও জাতীয়তা তথা দেশের নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি ৬২ অপরাধীর নাম।
তারা হলেন- রবিউল ইসলাম ওরফে রবিউল (আরাভ খান), জাফর ইকবাল, তানজিরুল স্বপন, মোল্লা নজরুল ইসলাম, মিন্টু মিয়া, ওয়াসিম, খোরশেদ আলম, গিয়াস উদ্দিন, অশোক কুমার দাস, মিজান মিয়া, চন্দন কুমার রায়, রাতুল আহমেদ বাবু, সিরাজ মোস্তফা ওরফে মো. লালু, হারিস চৌধুরী, জাহিদ হোসেন খোকন, মো. সাঈদ হোসাইন ওরফে হোসেন, সাঈদ মোহাম্মদ হাসান আলী, আজিজুর রহমান, অজয় বিশ্বাস, তরিকুল ইসলাম, হানিফ, আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, মো. সবুজ ফকিদ, মো. মনির ভূঁইয়া, শফিক-উল, আমান উল্লাহ শফিক, আবুল কালাম আজাদ, জাহিদুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন খান, মোহাম্মদ ইকরাম খান ওরফে নাঈম খান, ফেরদৌস ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, মো. ইউসুফ, আব্দুল আলীম শরীফ, মজনু আহমেদ, নুরুল দিপু, মোহাম্মদ ফজলুল আমিন জাবেদ, এসএইচএমবি নুর চৌধুরী, আব্দুর রশিদ খন্দকার, নাজমুল আনসার, শরফুল হোসেন আহমেদ, শরিফুল হক ডালিম, রউফ উদ্দিন, মোসলিম উদ্দিন খান, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান মাহমুদ চৌধুরী, আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ তাজ উদ্দিন মিয়া, সালাহউদ্দিন মিন্টু, গোলাম ফারুক অভি, শেখ হারুন, সুজিত সুলতান, তৌফিক আলম, জাফর আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, জিসান আহমেদ জিসান, আমিনুর রাসুল, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়, নবী হোসেন, সুব্রত বাইন ত্রিমৈত্রী, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস ও আব্দুল জব্বার।
ফেরানো যায়নি বঙ্গবন্ধু হত্যার পাঁচ খুনিকেও
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছয়জনের এখন পর্যন্ত ফাঁসি হয়েছে। বাকি আছেন আরও পাঁচজন। তারা হলেন- আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এবিএমএইচ নূর চৌধুরী। রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ তাদের ফেরত পাঠাতে বিভিন্ন সময়ে আবেদন জানালেও দেশ দুটির সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। অন্যদিকে, আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিন কোথায় আছেন সেই তথ্যও নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।
মানবপাচারকারী জাফরকে ফেরাতে ৪০ দিন সময় নিয়েছিল পুলিশ
২০২০ সালে লিবিয়ায় পাচার হওয়া ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনের নামে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের জাফর ইকবালকে ইতালিতে গ্রেপ্তার করে দেশটির পুলিশ। ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি এনসিবিকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করে এনসিবি রোম। পুলিশের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, জাফরকে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ ৪০ দিন সময় লাগতে পারে। তবে, আড়াই বছরেও তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
পালানো যুদ্ধাপরাধীদের ফেরাতে তোড়জোড়
২০১১ সালে নগরকান্দার পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠে স্থানীয় বিএনপির সহ-সভাপতি এম এ জাহিদ ওরফে খোকন ওরফে খোকন মাতব্বরের বিরুদ্ধে। সেই সময় তিনি পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এ আসামি বর্তমানে সুইডেনে রয়েছেন। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা কয়েক বছর ধরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও সম্ভব হয়নি।
একই অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক যুদ্ধাপরাধী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধেও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। ফাঁসির রায় হওয়ার আগে ২০১২ সালে সবার চোখ এড়িয়ে দেশ ছাড়েন এ যুদ্ধাপরাধী। তিনি ভারত নাকি পাকিস্তানে, বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, সে সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য নেই সরকারের কাছে।
মডেল তিন্নি হত্যার প্রধান আসামিও কানাডায়
মডেল তিন্নি হত্যা মামলার প্রধান আসামি গোলাম ফারুক অভি। আশির দশকের এ ছাত্রনেতার ওপর ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ। অভি কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তাকেও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
পলাতক আসামিদের ফেরানো যাচ্ছে না কেন
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. কামালউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরানোর যে কমিটি সেটাতে আমিও ছিলাম। দুজনের অবস্থান জানা গেলেও পলাতক বাকি তিনজনের অবস্থান জানা যাচ্ছে না। ল ফার্ম নিয়োগ করেও যুক্তরাষ্ট্রে থাকা রাশেদ চৌধুরী এবং কানাডায় অবস্থান করা নূর চৌধুরীকে ফেরানো যায়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তারা ফেরত দেয় না। আমরা ইন্টারপোলে ছবি, সম্ভাব্য হাতের ছাপও পাঠিয়েছিলাম। পলাতক তিনজনকে ট্রেসই করা যায়নি।
আরও পড়ুন >> ডেসটিনি : পলাতক ৩৯ জনকে গ্রেপ্তারে রেড নোটিশ জারির নির্দেশ
সাবেক এ স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, চাইলেই কাউকে ফিরিয়ে আনা সহজ না। কিন্তু চাইতে তো হবে। ইন্টারপোলে যে ৬২ জনের নাম ঝুলছে তাদের কিন্তু গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে পাঠাবে না। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে খোঁজা। খুঁজে অবস্থান নিশ্চিত হয়ে জানানো। সেটা হচ্ছে না। সেটা নিয়মিত মনিটরিং ও খোঁজ রাখার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবি’র।
‘যদি কাউকে ফিরিয়ে আনতে চাই, তিনি যদি ক্রিমিনাল হন, তাহলে সেই দেশের সঙ্গে চুক্তি (বহিঃসমর্পণ চুক্তি) থাকতে হবে। আমি জানি সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সেরকম কিছু আমাদের নেই। আমি স্বরাষ্ট্রে থাকতে ভারত ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছিল।’
এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের এনসিবি’র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই দেশ ছেড়ে পলাতক অপরাধী-আসামিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এনসিবি’র মাধ্যমে বাংলাদেশি ৬৫ জনের তথ্য দিয়ে তাদের ফেরানোর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। এনসিবি’র সঙ্গে ইন্টারপোল ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগাযোগ অব্যাহত আছে। ইন্টারপোল প্রায়শই সহযোগিতা করে থাকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীসহ দাগি আসামি, অপরাধী ও দণ্ডপ্রাপ্তদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান।
এ বিষয়ে একাধিকবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সিনিয়র সচিবের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও বক্তব্য মেলেনি।
জেইউ/এমএআর/