ডেঙ্গু : আগস্ট-সেপ্টেম্বর নিয়েও ভয়
বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে রেকর্ড সংখ্যক মানুষের ডেঙ্গু শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, দুই সিটি কর্পোরেশন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দাবি করা ‘সর্বোচ্চ’ চেষ্টার মধ্যেও প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত রোগী এবং লাশের সারি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশা আগের তুলনায় এখন অনেক ‘স্মার্ট’ হয়েছে। তার ধরন পাল্টেছে। এ অবস্থায় দায়িত্বশীলদের ‘লোক দেখানো’ অভিযান পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ করে তুলতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম একটি ওয়ার্ড হলো বাড্ডা এলাকা। সরেজমিনে পূর্ব বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা ও মেরুল বাড্ডা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন অলিগলির রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে আছে। এলাকাগুলোতে বসবাসরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একদিন বৃষ্টি হলে এক সপ্তাহেও রাস্তাঘাটের পানি সরে না। এমনকি গত দুই মাসে এসব এলাকায় এডিস মশার নিধনে সিটি কর্পোরেশনের কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে ডিআইটি প্রজেক্টের খেলার মাঠ, বাগানবাড়ি, কৃষি ব্যাংক রোডসহ কয়েকটি এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রাস্তাঘাটে তিন থেকে চারদিনের পানিও জমে আছে। এছাড়া বাসাবাড়ির পাশে বিভিন্ন ফাঁকা জায়গায় এক মাসেরও বেশি সময় ধরে পানি জমে আছে। এগুলোতে কোনো নজর নেই সিটি কর্পোরেশনের।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম একটি ওয়ার্ড হলো বাড্ডা এলাকা। সরেজমিনে পূর্ব বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা ও মেরুল বাড্ডা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন অলিগলির রাস্তায় বৃষ্টির পানি জমে আছে। এলাকাগুলোতে বসবাসরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একদিন বৃষ্টি হলে এক সপ্তাহেও রাস্তাঘাটের পানি সরে না। এমনকি গত দুই মাসে এসব এলাকায় এডিস মশার নিধনে সিটি কর্পোরেশনের কোনো অভিযান পরিচালিত হয়নি
মাসের পর মাস জমে আছে পানি, কারও নজর নেই
মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকার ৬ নম্বর রোডের ব্যবসায়ী এনামুল করিমের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, একদিন বৃষ্টি হলে কমপক্ষে দুদিন আমাদের ব্যবসা বন্ধ থাকে। দোকানের সামনের রাস্তায় হাঁটু পরিমাণ পানি জমে থাকে। সিটি কর্পোরেশনের লোকদের ফোন দিলেও তারা আসে না। এলাকার কমিশনারের কাছে বারবার গিয়ে বলা হলেও পানি নিষ্কাশন নিয়ে স্থায়ী কোনো সমাধান হচ্ছে না।
আরও পড়ুন >> অস্বাভাবিক অনুভব করলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করুন
‘ডিআইটি প্রজেক্টের ৩ ও ৪ নম্বর রোড এলাকায় সবসময়ই পানি জমে থাকে। কোনোদিন পানি পরিষ্কার বা এডিসের লার্ভা ধ্বংসের কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। এসব কারণে আমরা শুধু ব্যবসায়িকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না, ডেঙ্গু সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছি এবং আমাদের বাচ্চারাও ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে।’
ডিআইটি প্রজেক্টের বাগানবাড়ি এলাকার বাসিন্দা মো. জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এলাকায় একদিন বৃষ্টি হলে রাস্তায় পানি জমে থাকে অন্তত এক সপ্তাহ। প্রতিটি ড্রেন ময়লা-আবর্জনায় ভরপুর। সিটি কর্পোরেশনের লোকদের বারবার ফোন দিয়েও আনা সম্ভব হয় না। তাছাড়া ড্রেনগুলো এতটাই সরু যে ১০ মিনিটও যদি ভারি বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে আর কোনোদিকেই পানি যায় না। ফলে রাস্তায় হাঁটু পরিমাণ পানি জমে।
‘এলাকায় এত পরিমাণ মশা যে দিনের বেলায়ও মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। আমি নিজেই কিছুদিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছি। এর আগে স্ত্রী-মেয়েও আক্রান্ত হয়। শুধু আমার ঘরেই এ অবস্থা নয়, এলাকার প্রায় প্রতিটি ঘরেই গত এক-দুই মাসে কেউ না কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।’
ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে দুই সিটির ৫৫ ওয়ার্ড
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডে গত ১৮ থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত বর্ষা মৌসুম পূর্ব জরিপ পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ঢাকা উত্তরের ৪০টি এবং দক্ষিণের ৫৮টি ওয়ার্ডে পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ বহুতল ভবনে, ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ সাধারণ বাসাবাড়িতে এবং ১৮ দশমিক ২১ শতাংশ নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। জরিপে দুই সিটির ৫৫টি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা হিসেবেও চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ঢাকা উত্তর সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড- ২, ৩, ৫, ৬, ১০, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৩৭ ও ৩৮। এছাড়া মিরপুর, পল্লবী, মাজার রোড, পীরের বাগ, মনিপুর, শ্যাওড়াপাড়া, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, খিলক্ষেত, কুড়িল, জোয়ার সাহারা, বনানী, গুলশান, বারিধারা, মহাখালী, রামপুরা, খিলগাঁও, মালিবাগ, কারওয়ান বাজার, তেজতুরি বাজার, আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, বায়তুল আমান, মগবাজার, ইস্কাটন, বাড্ডা পড়েছে এসব ওয়ার্ডের আওতায়।
আরও পড়ুন >> রোববার খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উদ্বেগের কারণ ডেঙ্গু ও বন্যা
দক্ষিণ সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড- ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, ২২, ২৩, ২৬, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৪১, ৪৪, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫৪, ৫৫ ও ৫৭। এর ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। গোরান, মেরাদিয়া, বাসাবো, সবুজবাগ, মুগদা, মাদারটেক, ফকিরাপুল, আরামবাগ, শাহজাহানপুর, রাজারবাগ, পুরানা পল্টন, বায়তুল মোকাররম, ধানমন্ডি, রায়েরবাজার, নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, মিন্টো রোড, কাকরাইল, হাজারীবাগ, লালবাগ, আজিমপুর, পলাশী, বংশাল, সিদ্দিকবাজার, শাঁখারিবাজার, রায় সাহেব বাজার, ওয়ারী, সূত্রাপুর, মিলব্যারাক, সায়েদাবাদ, উত্তর যাত্রাবাড়ী, মীরহাজিরবাগ, ধোলাইপাড়, গেন্ডারিয়া, জুরাইন ও কামরাঙ্গীরচর এসব ওয়ার্ডের আওতায় পড়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো- ২, ৩, ৫, ৬, ১০, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩৩, ৩৫, ৩৭ ও ৩৮। দক্ষিণ সিটির ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো- ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১১, ১২, ১৩, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, ২২, ২৩, ২৬, ৩৩, ৩৪, ৩৬, ৪১, ৪৪, ৪৬, ৪৮, ৫০, ৫১, ৫৪, ৫৫ ও ৫৭
ঈদের পর রোগী বাড়ছে মিটফোর্ড হাসপাতালে
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (মিটফোর্ড) সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে বর্তমানে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি আছে ১০১ জন। এর মধ্যে ৮৯ জন প্রাপ্ত বয়স্ক এবং বাকি ১২ জন শিশু। গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত) হাসপাতালে নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছে ৩২ জন। এর আগের দিন ২৮ জন এবং তারও আগের দিন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছিল ২১ জন।
ডেঙ্গুর রোগী প্রসঙ্গে মিটফোর্ড পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশীদ-উন-নবী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদের পর থেকে আমাদের হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে গত তিনদিনে ভর্তির সিকুয়েন্স যদি দেখি তাহলে মনে হচ্ছে সংক্রমণ কিছুটা বাড়ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় নয়শো রোগী। এর মধ্যে ছয়জন মারা গেছেন।
কোন এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালটি পুরান ঢাকায় হওয়ায় এখানে বেশির ভাগ রোগীই কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ, জুরাইন, গেন্ডারিয়াসহ আশেপাশের এলাকাগুলো থেকে আসে।
আক্রান্তদের অধিকাংশেরই মৃদু উপসর্গ
ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার আক্রান্ত হওয়া রোগী কেমন আসছে— জানতে চাইলে মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক বলেন, অনেকেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় মৃদু উপসর্গ নিয়ে। যে কারণে অনেক রোগী বুঝতে পারেন না যে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি যদি দ্বিতীয়বারও আক্রান্ত হন, বুঝতেই পারবেন না। কিছু রোগী এসে বলেন যে আমি এর আগে আক্রান্ত হয়েছিলাম। কিন্তু তাদেরকে দিয়ে তো আমরা বলতে পারছি না, শুধু তারাই দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন।
আরও পড়ুন >> ডেঙ্গুতে ভিকারুননিসার ছাত্রীর মৃত্যু
মিটফোর্ড পরিচালক বলেন, ডেঙ্গুরোগী যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের ৮০ শতাংশই পরীক্ষার আগে জানতেন না যে তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। এখনও যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদের অধিকাংশেরই রোগের সাধারণ সিমটম (উপসর্গ) থাকছে না। দেখা গেল কারও পেটব্যথা শুরু হয়েছে, কিন্তু কোনোভাবেই কমছে না। হাসপাতালে আসার পর ডেঙ্গু পরীক্ষায় তার পজিটিভ আসে। এজন্য আমরা বলি যে শারীরিক যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক সমস্যা দেখা দিলেই হাসপাতালে চলে আসতে এবং ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে।
করণীয় এবং সচেতনতা প্রসঙ্গে কাজী রশীদ-উন-নবী আরও বলেন, কোনোভাবেই এবারের ডেঙ্গু-কে অবহেলা করা যাবে না। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। শুরুর দিকে যদি ডেঙ্গু শনাক্ত করা যায় এবং চিকিৎসা শুরু করা যায়, তাহলে দ্রুতই ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যদি ক্রিটিক্যাল অবস্থা নিয়ে হাসপাতালে আসেন, তাহলে তার চিকিৎসা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।
ডেঙ্গুতে কেন এত মৃত্যু
এবারের ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু কেন— জানতে চাওয়া হয় বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেলিন চৌধুরীর কাছে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৬১ জনেরও বেশি। তার মানে প্রথম ছয় মাসের মধ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর একটা রেকর্ড হয়েছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ, এ বছর যাদের ডেঙ্গু হচ্ছে, তাদের অধিকাংশেরই এর আগে একবার বা দুবার ডেঙ্গু হয়েছে। যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তারা যখন আবার ডেঙ্গুর অন্য কোনো উপধরন দিয়ে আক্রান্ত হন, তাদের রোগের তীব্রতা বেড়ে যায়।
লেলিন চৌধুরী বলেন, অনেকেই প্রথম দিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কি না, বুঝতে পারেন না। কেউ কেউ ডেঙ্গু হয়েছে নাকি হয়নি, এটা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধায় থাকেন। তারা তখন চিকিৎসকের কাছে যেতে দেরি করেন। তখন তাদের মধ্যে জটিলতা বা শক সিন্ড্রোমের একটি অবস্থা তৈরি হয়।
‘একদিকে যেমন দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে জটিলতা বাড়ে, অন্যদিকে দেরি করে হাসপাতালে আসায় রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। এ দুই কারণে কিন্তু আমাদের দেশে মৃত্যুর হার বাড়ছে।’
আরও পড়ুন >> জ্বর নিয়ে কুর্মিটোলায় অসংখ্য রোগী, অধিকাংশই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত
বিশিষ্ট এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, গত প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে আমরা ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখছি। এ সময়ের মধ্যে মশার আচার-ব্যবহার ও স্বভাব কিন্তু বদলেছে। আগে এডিস মশা যেসব পরিবেশে থাকত, সকালে বা সন্ধ্যায় কামড়াত, এখন কিন্তু সেই অবস্থা নেই। এডিস মশা এখন দিনভর এবং রাতেও কামড়ায়। সে বাইরের কৃত্রিম আলোতেও থাকতে পারে। সবমিলিয়ে মশার পরিবর্তিত এ ধরন কিন্তু ডেঙ্গু সংক্রমণে বড় একটি ভূমিকা পালন করছে।
ক্রাশ প্রোগ্রাম না হলে ভয়াবহ বিপর্যয়
ড. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমরা ভয় পাচ্ছি যদি ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার বিরুদ্ধে কোনো ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে না নেওয়া হয়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গুর সংক্রমণের একটি ভয়াবহ বিপর্যয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
ডেঙ্গুর সংক্রমণ কেন নিয়ন্ত্রণে আসছে না— জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, এখানে বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। আমাদের সিটি কর্পোরেশনগুলো যে ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করে তার প্রধান একটি অংশই হচ্ছে প্রদর্শনবাদিতা। অর্থাৎ তারা যতটা দেখায় ততটা কার্যকর কাজ করে না। দ্বিতীয়ত হলো- সিটি কর্পোরেশন কিছু কাজ করলেও তাদের পক্ষে একা ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। একসঙ্গে সাধারণ মানুষ ও জনপ্রতিনিধিদের যুক্ত করতে হবে। তারা যুক্ত না হলে সিটি কর্পোরেশন যতই চেষ্টা করুক ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
আগস্ট-সেপ্টেম্বর নিয়ে বড় ভয় : কীটতত্ত্ববিদ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঈদ-পরবর্তীতে বিশেষ করে জুলাই মাসে ডেঙ্গুর সংক্রমণ খুবই বেড়ে যাবে। কারণ হিসেবে বিশ্লেষণ করলে আমরা আমাদের ল্যাবে যে কাজটি করি, এডিস মশার ঘনত্ব, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাত— এ কয়েকটি ফ্যাক্টর এনালাইসিস করে একটি মডেল তৈরি করি। সেখানে দেখা যায় কয়েক দিনের মধ্যে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হবে।
‘ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাত। এছাড়া বেশকিছু কারণ আছে। ঈদের ছুটি থাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও অফিস-আদালত বন্ধ ছিল। বৃষ্টিপাত হওয়ায় এসব এলাকাতে বিভিন্ন ছোট-বড় যেসব পাত্র আছে সেগুলোতে বৃষ্টির পানি জমা হয়েছে। এসব জায়গায় এডিস মশার নিরবচ্ছিন্ন প্রজনন হয়েছে। মশাগুলো ইতোমধ্যে উড়ন্ত মশায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ানোর জন্য উপযোগী একটি পরিস্থিতি তৈরি করেছে।’
আরও পড়ুন >> মশার উৎস খুঁজতে ডিএনসিসি এলাকায় ড্রোন ব্যবহার
করণীয় প্রসঙ্গে কবিরুল বাশার বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের যেসব প্রস্তুতি নেওয়া দরকার তার মধ্যে অন্যতম হলো হটস্পট ম্যানেজমেন্ট। যেসব এলাকাতে ডেঙ্গু ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সেসব এলাকার ডেঙ্গু রোগীদের ঠিকানা ধরে ধরে ফগিং করে আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ির আশেপাশের উড়ন্ত মশাগুলো মেরে ফেলতে হবে। কারণ, উড়ন্ত মশাগুলো যতক্ষণ বেঁচে থাকবে ততক্ষণ তারা চারদিক থেকে ডেঙ্গু ছড়াবে।
‘ডেঙ্গুর সংক্রমণ রোধে নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। প্রত্যেককেই নিশ্চিত করতে হবে যে তার বাসাবাড়ি ও আঙিনায় এডিস মশা যেন জমা হতে না পারে। আরেকটি আশঙ্কা আমরা করছি যে এ মাসে দেশের প্রতিটি জেলাতে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। এজন্য শুধু ঢাকায় নয়, প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গু প্রিভেনশন করতে প্রস্তুতি নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪ জুলাই আমরা আমাদের প্রাক-মৌসুম জরিপের ফল প্রকাশ করেছি। আমরা ঢাকা উত্তর সিটির ৪০টি ওয়ার্ড এবং দক্ষিণ সিটির ৫৮টি ওয়ার্ডের মোট ৩১৪৯টি বাড়িতে সার্ভে করেছি। এর মধ্যে ৫৪৯টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পজিটিভ পেয়েছি। এটি আমাদের জন্য খুবই ভয়াবহ বিষয়।
তিনি বলেন, জরিপে প্লাস্টিক ড্রাম, এসির পানি, ফুলের টব ও ছাদে জমে থাকা পানিতে এডিসের সবচেয়ে বেশি লার্ভা পাওয়া গেছে। আমাদের ধারণা, পুরো ঢাকাতেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এডিস মশার বিস্তার। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী মানুষের অসচেতনতা।
নাজমুল ইসলাম আরও বলেন, ডেঙ্গুর সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এ মুহূর্তে জনগণের যেমন অংশগ্রহণ লাগবে, এডিস মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আরও অনেক বেশি সক্রিয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। আমরা শুধু চিকিৎসার জায়গাটি দেখে থাকি। আমাদের হাসপাতালগুলোতে যথাযথভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গুর সংক্রমণ যদি আরও বাড়ে, সেই প্রস্তুতিও আমাদের নেওয়া আছে।
১০ হাজার ছাড়িয়েছে ডেঙ্গু শনাক্ত রোগী, মৃত্যু ৬২
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ৪৫৫ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় সাত হাজার ৪৬৬ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই হাজার ৯৮৯ জন। মৃত্যু হয়েছে ৬২ জনের।
আরও পড়ুন >> ৪৪% বহুতল ভবনে লার্ভা, ‘ভয়াবহ’ বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
এদিকে, গত একদিনে (মঙ্গলবার সকাল ৮টা থেকে বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ ৫৮৪ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৮২ জন, ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২০২ জন। এ সময়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১৯১১ ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসাধীন। ঢাকার ৫৩টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১২৮৫ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬২৬ রোগী ভর্তি আছেন।
টিআই/এমএআর/