ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার আক্রান্তদের বেশির ভাগই শক সিনড্রোমে সিভিয়ার পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যেমনটি ২০১৮ সালেও হয়েছিল। এছাড়া এবার নতুন করে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃষ্টিতে রাজধানীর অলিগলিতে জমে থাকা পানি এবং ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটিতে নাগরিকদের বাসাবাড়িতে অনুপস্থিতি।

এ মুহূর্তে ডেঙ্গু পরিস্থিতি কতটা ভয়ের, নতুন কী ধরনের শঙ্কা রয়েছে, ডেঙ্গুতে এবার বেশি মৃত্যুর কারণ কী— এসব বিষয়ে ঢাকা পোস্ট কথা বলেছে দেশের ডেঙ্গু চিকিৎসায় ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামানের সঙ্গে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. তানভীরুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান : এ বছরের শুরুতে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও গত মাস (জুন) থেকে হঠাৎ করে তা বেড়েছে। এখন যে হারে এটি বাড়ছে এবং ছড়াচ্ছে, এটি আমাদের জন্য অবশ্যই ভয়ের কারণ। ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আমার হাসপাতালে আসছে। গতকাল বুধবার (৫ জুলাই) পর্যন্ত আমার হাসপাতালে রোগী ভর্তি ছিল ২৫১ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৩১ জন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে।

আরও পড়ুন >> রোববার খুলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উদ্বেগের কারণ ডেঙ্গু ও বন্যা

আগে সবাই বলত কাজলা, যাত্রাবাড়ী, মান্ডা, মুগদা, বনশ্রী থেকে বেশি রোগী আসে। কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ হলো, ডেঙ্গু এখন সব জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে। এখন আর নির্দিষ্ট কোনো এলাকা থেকে রোগী আসছে না। সারা ঢাকা শহর থেকেই রোগী আসছে। এমনকি ঢাকার বাইরে থেকেও প্রচুর রোগী ভর্তি হচ্ছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : এবার ডেঙ্গুর উপসর্গের ক্ষেত্রে অন্য বছরের তুলনায় কোনো পার্থক্য পর্যবেক্ষণ করেছেন কি না?

অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান : হ্যাঁ, পার্থক্য আছে। কারণ, এবার যারা আসছে তাদের অধিকাংশই দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত। ক্লাসিক ডেঙ্গুর যে উপসর্গগুলো আমরা জানতাম, দ্বিতীয় দফায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের ক্ষেত্রে এর কিছুটা ব্যতিক্রম হচ্ছে। জ্বর ও মাথাব্যথার সঙ্গে পেট ও বুকের ব্যথা দেখা যাচ্ছে। ব্যথার পরিমাণ এত বেশি যে মনে হচ্ছে শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাচ্ছে। যারা সেকেন্ড টাইম ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের আমরা বলছি কমপ্লিকেটেড ডেঙ্গু বা এক্সটেন্ডেড ডেঙ্গু সিন্ড্রোম। এ সংখ্যাটা কিন্তু এখন অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি।

ঢাকা পোস্ট : দ্বিতীয়বার আক্রান্তদের ঝুঁকি কেমন?

অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান : দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে এবং যথাসময়ে হাসপাতালে এসে চিকিৎসা শুরু করলে খুব বেশি সমস্যা হয় না। কিন্তু যদি রোগী যথাসময়ে না আসেন, তাহলে তাকে রিকভার (পুনরুদ্ধার) করা খুব কঠিন হয়ে যায়। এমনকি তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। মৃত্যুর বড় কারণ হলো লেট রেফারেল।

আরও পড়ুন >> ডেঙ্গুতে ভিকারুননিসার ছাত্রীর মৃত্যু

কারণ, উপসর্গগুলোর সঙ্গে রোগীরা খুব বেশি পরিচিত নয়। যেমন- একজন রোগীর শুরুতে জ্বর ছিল, এরপর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলো। কিন্তু রোগী জানতেই পারল না যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় তার শরীর খুব দ্রুত পানিশূন্য হয়ে পড়ে। যা ডেঙ্গুর বড় একটি উপসর্গ। এ ধরনের রোগীগুলো শক-এ চলে যায়। এমন পরিস্থিতিতে কখনও কখনও কেউ কেউ রিকভারি করতে পারে, অধিকাংশ সময় পারে না। আমরা যখন কিছুই করতে পারি না, তখন আমাদেরও একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এটা খুবই বেদনাদায়ক।

এবার এমন অনেক রোগী আসছে যারা ডেঙ্গু সংক্রমণের বিষয়টি বুঝতে না পেরে অন্য রোগের চিকিৎসা করছেন। দেখা গেল একজন রোগীর বেশ পেটে ব্যথা, সে হয়তো পেটে ব্যথার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন। কিন্তু কোনো ধরনের উন্নতি না পেয়ে আমাদের কাছে আসছেন এবং পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু ধরা পড়ছে। এমন অসংখ্য রোগী আমরা পাচ্ছি।

সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা চলছে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

অনেকেই জানে না যে রোগটা কী বা আদৌ এটা ডেঙ্গু কি না? কিন্তু যখন জানছে তখন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা অনেককে পেয়েছি যাদের গর্ভাবস্থায় ডেঙ্গু হয়ে গেছে। এমনও পেয়েছি সিজার হয়েছে, এরপর আবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এজন্য আমাদের নির্দেশনা হচ্ছে, শারীরিকভাবে যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক কিছু অনুভূত হলেই হাসপাতালে এসে এনএস- ১ পরীক্ষা করতে হবে, যা আমাদের হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টাই হয়।

আমাদের হাসপাতালে করোনার র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট ও ডেঙ্গুর জন্য এনএস- ১, এ দুটি পরীক্ষা ২৪ ঘণ্টা হয়ে থাকে। যেকোনো রোগীকে আগে এ দুই পরীক্ষা করেই হাসপাতালের ইনডোরে ঢুকতে হবে। এছাড়া আমাদের প্যাথলজি বিভাগে রাত ৮টা পর্যন্ত যেকোনো পরীক্ষাই করা যায়।

আরও পড়ুন >> জ্বর নিয়ে কুর্মিটোলায় অসংখ্য রোগী, অধিকাংশই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত

ঢাকা পোস্ট : মোটা দাগে কোন লক্ষণগুলো দেখা দিলে একজন রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে আসতে হবে?

অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান : যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক লক্ষণ দেখা দিলেই দ্রুততম সময়ে হাসপাতালে আসতে হবে। হাসপাতালে এসেই এনএস- ১ পরীক্ষাটি করে নিশ্চিত হতে হবে এটি ডেঙ্গু কি না।

এক্ষেত্রে কিছু উপসর্গের কথা বলতেই হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো বমি। কারও দীর্ঘস্থায়ী বমি হলে, এমনকি সেটা ওষুধ খেয়েও না কমলে দ্রুত হাসপাতালে এসে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। আরেকটি হলো ডায়রিয়া। আমাদের হাসপাতালে এমন অনেকেই এসেছেন যারা দু-তিনদিন ধরে ডায়রিয়ায় ভুগছিলেন, ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছিল না। হাসপাতালে এসে ডেঙ্গু পরীক্ষার পর তার পজিটিভ এসেছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু রোগীরা / ঢাকা পোস্ট 

আরও কিছু উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো- পেটে ব্যথা, শরীরে পানি জমে যাওয়া, বুক-পেটে পানি জমা, মস্তিষ্কের প্রদাহ, খিঁচুনি হওয়া এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।

এজন্য আমরা খুবই গুরুত্ব দিয়ে বলব যে যখনই আপনি শরীরে অস্বাভাবিক কোনো সমস্যা দেখতে পাবেন, শারীরিক প্রতিক্রিয়া অনুভব করবেন, প্রথম কাজই হবে রেজিস্টার্ড (নিবন্ধিত) চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অথবা হাসপাতালে আসা। এক্ষেত্রে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া। যদি ডেঙ্গুর রিপোর্ট পজিটিভ হয়, তাহলে তার চিকিৎসা এক রকম হবে, নেগেটিভ আসলে চিকিৎসা হবে অন্য রকম।

আমরা যদি শুরুতেই কারও ডেঙ্গু শনাক্ত করতে পারি তাহলে সহজে চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। যদি দেরিতে শনাক্ত হয়, সেক্ষেত্রে খারাপ কিছু হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

ঢাকা পোস্ট : অসংখ্য ডেঙ্গু রোগী এখন আপনার হাসপাতালে। আপনি বলছিলেন জনবলের সংকট, কীভাবে সামাল দিচ্ছেন?

অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান : যদিও ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী আমরা সামাল দিচ্ছি, আমাদের জনবল কিন্তু খুব বেশি নেই। তাছাড়া, আমরা শুধু ডেঙ্গু রোগেরই চিকিৎসা দিচ্ছি না। সব ধরনের রোগীকে আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। স্বল্প জনবল দিয়ে একসঙ্গে সব সামলাতে কষ্ট হচ্ছে, তারপরও কিছুই করার নেই। আমার হাসপাতালে রোগী আসলে তাকে তো ফিরিয়ে দিতে পারি না।

আরও পড়ুন >> মশার উৎস খুঁজতে ডিএনসিসি এলাকায় ড্রোন ব্যবহার

আমার নার্সের সংকট তীব্র, ডাক্তারেরও সংকট আছে। তারপরও আমরা ম্যানেজ করে চালিয়ে নিচ্ছি। এক্ষেত্রে রেশনিং করতে হচ্ছে। যেখানে আমাদের একটা ওয়ার্ডে তিনজন চিকিৎসকের ডিউটি করার কথা, সেখানে দুজন দিয়ে ২৪ ঘণ্টা চালাতে হচ্ছে। এরপরও ভালো লাগার বিষয় আছে। সেটি হলো, আমাদের চিকিৎসক-নার্সদের সেবায় রোগীরা সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যাচ্ছে।

গতকাল বুধবার পর্যন্ত মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল ২৫১ জন  / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : গত মাসে (জুন) আমরা দেখলাম প্রায় ছয় হাজার লোক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। মৃ্ত্যুর হারটাও আশঙ্কাজনক। জুলাই মাসে ডেঙ্গুর ঝুঁকি কেমন দেখছেন?

অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান : ডেঙ্গু দিন দিন অনেক বেড়েছে। আমার হাসপাতালে গত মাসে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছিল দুই হাজারের মতো। জুলাই মাসের এ কয়দিনে তিনশোর বেশি নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে। আবার ঈদুল আজহার পর প্রচুর সংখ্যক মানুষ ঢাকায় ফিরেছে। নতুন করে আক্রান্তের হারটাও বেড়ে যাবে।

ছুটির মধ্যে অনেকের ঘরে খালি পাত্রে, বেসিনে, বারান্দায়, ছাদে, ফুলের টবে পানি জমেছে। সেখানে যে লার্ভা জন্মেছে এবং এডিস মশায় পরিণত হয়েছে, সেগুলোর ফল তো আমাদের পেতেই হবে।

ঢাকা পোস্ট : বৃষ্টিতে জমা পানি কতটা ভয়ংকর, কী করা যেতে পারে?

অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান : ঈদের ছুটিতে অনেক বাসাই বন্ধ ছিল। গত তিন-চারদিনের বৃষ্টিতে স্বাভাবিকভাবে এসব বাসার সামনে ও আশপাশে এবং ছাদে পানি জমেছে। এগুলোতে ডেঙ্গুর লার্ভা তৈরি হবে এবং সেগুলো ছড়িয়ে পড়বে। এজন্য নিজের ঘর ও আঙিনা নিজেকেই পরিষ্কার করতে হবে। যেখানে পানি জমে থাকার সম্ভাবনা আছে, সেখানে আর কিছু না পারলে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিতে হবে। তাহলে কিন্তু আর লার্ভাটা জন্মাবে না।

রাজধানীর যেকোনো এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগীরা ছুটে আসছেন মুগদা হাসপাতালে / ছবি- ঢাকা পোস্ট

আরও পড়ুন >> ৪৪% বহুতল ভবনে লার্ভা, ‘ভয়াবহ’ বলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

আমার কাছে মনে হচ্ছে, গত কয়েক দিনের বৃষ্টি এবং ঈদের ছুটি- এ দুটি মিলিয়ে চলতি মাসে একটু ঝামেলা তৈরি হতে পারে। এজন্য আমাদের মধ্যে সচেতনতাটাও বাড়াতে হবে। 

ঢাকা পোস্ট : ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

অধ্যাপক ডা. নিয়াতুজ্জামান : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভ কামনা রইল।

টিআই/জেএস/এমএআর/