‘হারলে সুষ্ঠু, জিতলে কারচুপি’— বিব্রত আ. লীগ
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার পরিচালনা করছে। এ সময়ের মধ্যে একাধিকবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে যতই নির্বাচন হয়েছে সবগুলোতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছে।
‘ভোট কারচুপি’, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি’ কিংবা ‘নৌকার বিরোধী প্রার্থীদের হয়রানি’— এমন নানা অভিযোগ ছিল তাদের। প্রতিটি নির্বাচনেই অভিযোগের তীর ক্ষমতাসীনদের প্রতি ছুড়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। যেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জয়ী হলেই যত দোষ! আবার নৌকার প্রার্থী হেরে গেলে অপবাদ দিতেও ছাড়ে না তারা। যদিও ঢাক-ডোল বাজিয়ে অভিযোগ করতে দেখা যায়নি বিরোধীদের।
বিজ্ঞাপন
নৌকা পাস করলেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় না— বিরোধীদের এমন ধারণা ‘বিব্রতকর’ বলছে আওয়ামী লীগ। জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অশুভ রাজনৈতিক শক্তি সবসময় গন্ধ খোঁজে। তারা আওয়ামী লীগের ওপর কীভাবে দোষারোপ করা যায়, সেটা ভাবে। নিজেদের কাজ না করে পরচর্চায় মেতে ওঠে। নির্বাচনে হারলে ভালো হয়নি, জিতলে ভালো— এগুলো তাদের একটা মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে।’
‘ভোট কারচুপি’, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি’ কিংবা ‘নৌকার বিরোধী প্রার্থীদের হয়রানি’— এমন নানা অভিযোগ ছিল তাদের। প্রতিটি নির্বাচনেই অভিযোগের তীর ক্ষমতাসীনদের প্রতি ছুড়েছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। যেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জয়ী হলেই যত দোষ! আবার নৌকার প্রার্থী হেরে গেলে অপবাদ দিতেও ছাড়ে না তারা। যদিও ঢাক-ডোল বাজিয়ে অভিযোগ করতে দেখা যায়নি বিরোধীদের
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ প্রতিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে, বিএনপি কোনো নির্বাচনে প্রকাশ্যে দলীয় প্রার্থী দিচ্ছে না। তাদের নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। বর্তমান সরকারের অধীনে বিএনপি আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না— এমন সিদ্ধান্তের পরও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির ২৯ নেতা কাউন্সিলর পদে অংশগ্রহণ করেন। তাদের সবাইকে আজীবন বহিষ্কার করে বিএনপি।
আরও পড়ুন >> দুর্বল-ক্ষয়িষ্ণু আ. লীগ, চূড়া থেকে এবার তাদের পতনের পালা
এমন ‘কঠিন দৃষ্টান্ত’ স্থাপনের পরও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থিতা দেওয়ার বিষয়টি ঠেকানো যায়নি। জানা যায়, এ নির্বাচনে দলটির ১৭ নেতাকর্মী অংশ নেন। সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে নির্বাচিতও হন। তাদের মধ্যে সাতজন বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। অন্যরা ওয়ার্ড বিএনপির পদধারীসহ দলটির সাবেক নেতৃবৃন্দ।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হেরে গেলে বিএনপির দু-একজন নেতা ছাড়া কাউকে সেভাবে সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। তবে, বরিশাল ও খুলনা নির্বাচন নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছেন দলটির নেতারা।
প্রতিটি নির্বাচনের পরই ব্রিফিং করে ভোটের ফল নিয়ে সমালোচনা করতে দেখা যায় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে। এতদিন বিএনপি একাই ক্ষমতাসীনদের দোষারোপ করলেও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতারাও সরকারবিরোধী সমালোচনা শুরু করে। বরিশালের মেয়রপ্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমের ওপর হামলার পর তারা সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
বিরোধী দলের প্রতিটি নেতাকর্মীর মুখে একটাই কথা, ভোটের কারচুপি। নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হলে এমন অভিযোগ বেশি শোনা যায় বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের মতে, নৌকা হারলে ভোট সুষ্ঠু হয়। আর জিতলে কারচুপি হয়। এটা কেমন অভিযোগ? প্রতিটি নির্বাচনেই বিরোধীদের এমন অভিযোগ তাদের মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন দলটির সিনিয়র নেতারা।
আরও পড়ুন >> ‘নতুন করে আর সম্মেলন হবে না’
গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পরের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন, গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে। একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেখাতে হবে, তারা সেটাই চেষ্টা করেছে। ওই চেষ্টার ফল আমরা দেখে ফেলেছি। এর মাধ্যমে কী উঠে এসেছে, আমরা তা দেখেছি। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের আসল চিত্র।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগকে মানুষ ভোট দেয়। মানুষের ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। তাহলে আওয়ামী লীগকে কি পরাজিত হয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে ফেয়ার ইলেকশন হয়েছে? অন্যায় কাজ না করে অন্যায়ের দায়িত্ব নিতে হবে? এর দায় কি আওয়ামী লীগের? যারা এ অপবাদ দেন, যারা এ অপপ্রচার করেন, যারা এ মিথ্যাচার করেন, বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই অপচেষ্টা চালান। তাদেরই এ দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে। কিছু সময়ের জন্য মানুষকে ভুল বোঝাবার যে অপচেষ্টা, তাদের এ অপপ্রচার অপচেষ্টা হিসেবেই প্রমাণিত হবে।’
এদিকে, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার আবারও ‘নির্বাচন নির্বাচন খেলা’ শুরু করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। এজন্য প্রয়োজন একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আজ জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে কোনো নির্বাচন এ দেশে হবে না। সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ আমাদের ভোট দেওয়ার অধিকার নাই। ২০১৪ সালে আমরা ভোট দিতে পারিনি। ২০১৮ সালে ভোট দিতে পারিনি। সামনে আবার নির্বাচন। সেই নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন নির্বাচন খেলা শুরু করেছে আওয়ামী লীগ।’
আরও পড়ুন >> সংলাপ হবেই, তবে এখনই নয়!
গত ১৩ জুন রাজধানীর হাজারীবাগে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি এবং তার দোসররা কী মনে করে জানেন? তারা মনে করে, নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে যেদিন আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। আওয়ামী লীগ হারলে ওরা (বিএনপি) বলবে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে তারা (বিএনপি) কোনোদিন পরাজয় মেনে নেয় না।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নৌকা জিতলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, এটা তারা কখনও মেনে নেবে না। যারা আওয়ামী লীগের বিরোধী, জীবনেও আওয়ামী লীগ করেনি, তারাই এ সমালোচনা করে। তারা স্বাধীনতার সময় আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা মিথ্যাচার করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তারা মুসলিম লীগ ও যুদ্ধাপরাধী। অতিবামদের নিয়ে জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করে। এ লোকগুলোই পদ্মা সেতু নির্মাণে বিরোধিতা করেছে। তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা, বাংলাদেশের উন্নয়নের বিরোধিতা করা। এ কারণে আওয়ামী লীগ জিতলে তাদের গায়ে জ্বালা ধরে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জিতলেও তাদের কষ্ট হয়। এ কারণে ওরা সমালোচনা করে।’
আরও পড়ুন >> রাজনীতির মাঠে ‘জামায়াতি ধাঁধা’
‘গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অল্প ভোটে হেরেছে। সেটা নিয়ে কেউ কথা বলে না। কিন্তু অন্য সিটিতে জিতছে, তাই কথা উঠছে। এ শক্তি তো আজ থেকে নয়, আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে তারা বিরোধিতা করে আসছে। তারা আওয়ামী লীগের সমালোচনা সবসময় করবে। আজ টেলিভিশনে যারা সমালোচনা করে, তারা কিন্তু বলেছিল পদ্মা সেতু হবে না। অথচ পদ্মা সেতু হয়েছে’— বলেন এস এম কামাল হোসেন।
এমএসআই/এমএআর/