কিং মুশতাক-রানি সিনথিয়া উপাখ্যান
আইডিয়াল স্কুলে অসম এক বিয়ের ‘ময়নাতদন্ত’
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে বিয়ে করেছেন ওই প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির এক সদস্য। শিক্ষার্থীর বয়স ১৮ বছর আর গভর্নিং বডির সদস্যের বয়স ৬০ বছর। এমন অস্বাভাবিক ও অপ্রীতিকর ঘটনার পেছনে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের বিশেষ ভূমিকার প্রমাণ মিলেছে। শিক্ষার্থীর বাবা ওই দাতা সদস্যের নামে মামলা করেছেন।
এ ঘটনা ওই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ওই ঘটনা এত বেশি আলোচিত হচ্ছে এবং এত বেশি নেতিবাচক আলোচনা চলছে যে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অভিভাবকরা এক ধরনের আতঙ্ক ও উদ্বেগে আছেন তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে।
বিজ্ঞাপন
যিনি বিয়ে করেছেন তার নাম খন্দকার মুশতাক আহমেদ ওরফে কিং মুশতাক ওরফে মহারাজা মুশতাক। তিনি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির ডোনার সদস্য। যে শিক্ষার্থীকে তিনি বিয়ে করেছেন তার নাম সিনথিয়া ইসলাম। তিনি প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। তাকে ‘রানি’ বলে সম্বোধন করেন মুশতাক।
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে খন্দকার মুশতাক আহমেদ আইডিয়ালের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু। তার আরেক পরিচয় তিনি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার সাবেক বিএনপি নেতা। ফেসবুক প্রোফাইলে ‘ওয়ার্ড কমিশনার’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। রাজধানীর গুলশান ও নরসিংদীতে তার একাধিক বাড়ি থাকার তথ্য মিলেছে। সিনথিয়া ইসলামের গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায়। তারা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার, বসবাস করেন ঢাকায়।
শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলামের অভিভাবক এবং ঘটনা সম্পর্কে জানেন এমন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অভিযোগ, স্বয়ং অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর প্ররোচনা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এমন অসম বিয়ে ও আপত্তিকর ঘটনা ঘটেছে আইডিয়ালের মতো একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
আরও পড়ুন : ফেঁসে যাচ্ছে রাজধানীর নামিদামি ৭ স্কুল
এ ঘটনায় বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক, গভর্নিং বডির সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তারা বলছেন, এ ঘটনা নৈতিকতার চরম লঙ্ঘন।
দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরাও এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এমন ঘটনার পেছনে অধ্যক্ষের ‘বিশেষ’ ভূমিকার যে অভিযোগ উঠেছে তার যথাযথ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।
প্রথম অভিযোগ যৌন নিপীড়নের
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১৮ মার্চ খন্দকার মুশতাক আহমেদের নরসিংদীর বাগান বাড়ি ‘আনন্দ ভবন’-এ ছাত্রীদের নিয়ে শিক্ষা সফরে যান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী। ওই বাড়িতে সেদিন শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলামের সঙ্গে খন্দকার মুশতাককে বিশেষভাবে মেশার সুযোগ করে দেন অধ্যক্ষ।
‘আনন্দ ভবনের’ একটি সূত্র বলছে, সিনথিয়া ইসলামকে নরসিংদীর ওই বাড়িতে যৌন নিপীড়ন করেন খন্দকার মুশতাক। এমন অভিযোগ লিখিত আকারে আইডিয়ালের পরিচালনা পরিষদকেও দিয়েছেন সেখানে থাকা একজন অভিভাবক।
ওই দিনের (১৮ মার্চ) এবং তারও আগের কয়েকটি ভিডিও ক্লিপ ও ছবি ঢাকা পোস্টের কাছে এসেছে। ওই সব ভিডিও ও ছবিতে গভর্নিং বডির সদস্য খন্দকার মুশতাক ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলামকে খুবই কাছের সম্পর্কের মানুষদের মতো (স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা) একসঙ্গে দেখা যায়।
আরও পড়ুন : ‘মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করেছেন, বিয়ে টিকবে তো?’
ভিডিও ও ছবি প্রকাশের পর থেকে খন্দকার মুশতাক ও শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলামের সম্পর্কের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তাদের সম্পর্ক ঠিক কোন পর্যায়ে আছে, তা নিয়েও বিভিন্ন রকম আলোচনা ও কথাবার্তা ছড়ায়। কেউ বলেন, তারা বিয়ে করে ফেলেছেন; কেউ বলেন, বিয়ে করেননি কিন্তু অনৈতিকভাবে মেলামেশা করছেন।
গত ৩১ মে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, ‘আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের দাতা সদস্য ষাটোর্ধ্ব খন্দকার মুশতাক আহমেদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখার একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ১৭ বছর বয়সী এক ছাত্রীর সঙ্গে গত দুই বছর ধরে মেলামেশা ও সম্পর্ক স্থাপন করায় তার নৈতিক ও চারিত্রিক স্খলন ঘটেছে।’
মুশতাক-সিনথিয়ার মধ্যে কী ঘটেছে
ঘটনা সম্পর্কে বিশদ জানতে খন্দকার মুশতাক, শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলাম, অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী ও আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে ঢাকা পোস্ট। পাশাপাশি ডোনার সদস্য আর শিক্ষার্থীর এ অসম সম্পর্ক কোনদিকে গড়ায় তার ওপর নিয়মিত নজর রাখা এবং প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টাও করা হয়।
আরও পড়ুন : ছাত্রীকে বিয়ে করা আইডিয়ালের দাতা সদস্য মুশতাকের জামিন
ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলামের সঙ্গে ডোনার সদস্য খন্দকার মুশতাকের পরিচয় হয় অন্তত বছরখানেক আগে। তখন সিনথিয়া ইসলাম আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মুগদা স্কুল শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তখন থেকে খন্দকার মুশতাক তাকে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নানাভাবে প্ররোচিত করে আসছিলেন।
এর মধ্যে এসএসসি পাস করে আইডিয়ালের মতিঝিলের কলেজ শাখায় ভর্তি হন সিনথিয়া ইসলাম। কলেজে ওঠার পর থেকে নিয়মিত বিভিন্নভাবে তাকে ‘অ্যাপ্রোচ’ করা শুরু করেন খন্দকার মুশতাক। তাকে সরাসরি বিয়ের জন্য প্রস্তাবও দিতে থাকেন তিনি। একপর্যায়ে দামি দামি উপহারও পাঠান।
বিয়ে করতে মরিয়া মুশতাক একসময় অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীকে তার পছন্দের বিষয়টি জানান এবং অধ্যক্ষ নানাভাবে তাকে সহযোগিতা করা শুরু করেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্ট কথা বলে শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলামের পরিবারের সঙ্গে। সিনথিয়ার বাবা সাইফুল ইসলাম জানান, তার মেয়েকে প্রথম একটি আইফোন গিফট করেন খন্দকার মুশতাক। মেয়ে তাকে জানায়, ওই ফোন পৌঁছে দেওয়া হয় অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর মাধ্যমে। তখন থেকে অধ্যক্ষ নানাভাবে সিনথিয়াকে খন্দকার মুশতাকের প্রস্তাবের ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করেন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট হওয়ার জন্য দায়ী অধ্যক্ষ ফৌজিয়া।’
১৮ মার্চ, আনন্দ ভবন, শিক্ষা সফর ও মুশতাক-অধ্যক্ষ প্রযোজনা
১৮ মার্চ কী ঘটেছিল তা জানতে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মতিঝিল শাখায় গিয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট।
সবার সঙ্গে কথা বলে এবং নিজস্ব অনুসন্ধানে ঢাকা পোস্ট জানতে পারে ১৮ মার্চ মুশতাকের নরসিংদীর বাগান বাড়িতে যে শিক্ষা সফর করা হয় তা ছিল মুশতাক ও অধ্যক্ষ ফৌজিয়ার পূর্ব-পরিকল্পিত। ওই সফরে সিনথিয়াকে ঘিরে মুশতাকের ‘বিশেষ’ পরিকল্পনা ছিল।
ওই দিনের জন্য তার যে বিশেষ প্রস্তুতি আগে থেকে ছিল তা বোঝা যায় এর দুদিন আগে অর্থাৎ ১৬ মার্চ করা মুশতাকের এক ফেসবুক পোস্টে। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আনন্দ ভবনের রানির সম্মানে আনন্দ ভবন নতুন রূপে সাজানো হচ্ছে, ভালোবাসা অবিরাম!’
১৮ মার্চের পরদিন অর্থাৎ ১৯ মার্চ এক পোস্টে খন্দকার মুশতাক লেখেন, ‘সুখের সময় পাগলা ঘোড়া, তাড়াতাড়ি চলে যায়... , দুই দিন আনন্দ ভবনে ছিলাম স্বপ্নীল ভালোবাসার স্বর্ণালী আবেশে।’
ওই শিক্ষা সফরে থাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সেদিন সবার সামনে সিনথিয়া ও খন্দকার মুশতাক প্রেমিক-জুটির মতো আচরণ করেন। তারা একে-অপরকে আলিঙ্গন করেন সবার সামনে, এমনকি অধ্যক্ষের সামনেও। এসব ঘটনার সময় অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীকে সারাক্ষণ হাসিমুখে দেখা গেছে এবং দুজনের সম্পর্কের রসায়নে তার বিশেষ সায় আছে বলে মনে হয়েছে।’
একই দিনের এক ছবিতে মুশতাক, অধ্যক্ষ ও সিনথিয়াকে একত্রে দেখা গেছে। সেদিনের কিছু ছবিতে মুশতাক ও সিনথিয়াকে গলায় মালা পরা অবস্থায়ও একসঙ্গে দেখা গেছে।
আপত্তিকর ভিডিও
ঢাকা পোস্টের কাছে আসা ভিডিওতে দেখা যায়, খন্দকার মুশতাক সিনথিয়া ইসলামকে কলেজের পোশাক পরা অবস্থায় কোলে তুলে হেঁটে যাচ্ছেন। আরেক ভিডিওতে সিনথিয়াকে একটি গাড়িতে দেখা যায়। যেটি খন্দকার মুশতাকের বলে অনেকে নিশ্চিত করেছেন। আরেকটি ক্লিপে দেখা যায়, সিনথিয়া ইসলাম দৌড়ে গিয়ে খন্দকার মুশতাকের বুকে পড়ছেন।
ভিডিও ক্লিপগুলো ঢাকা পোস্টের হাতে আছে। এগুলো ১৭ মার্চ ধারণ করা হয়।
সিনথিয়া লাইভে আসেন দুবার
ঢাকা পোস্ট প্রতিবেদন করার জন্য তদন্ত শুরু করলে সিনথিয়া ইসলাম জুনের প্রথম সপ্তাহে পরপর দুদিন ফেসবুক লাইভে আসেন।
এক লাইভে তিনি বলেন, খন্দকার মুশতাক ও তাকে নিয়ে যা প্রচার হচ্ছে তার সব মিথ্যা। মুশতাক তাকে কোনো প্রকার যৌন নির্যাতন করেননি... তার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই.. ইত্যাদি।
আরেক লাইভে তিনি বলেন, তিনি (সিনথিয়া) ১৮ বছর বয়সী একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী। অতএব তার নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে...।
যারা তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দেন তিনি।
বিয়ে-তালাক-তালাক প্রত্যাহার!
এখন পর্যন্ত ঢাকা পোস্টের হাতে আসা তথ্য মতে, সিনথিয়া ইসলামকে ওই প্রতিষ্ঠানের ৬০ বছর বয়সী ডোনার সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর সিনথিয়া ইসলাম একবার খন্দকার মুশতাককে ডিভোর্স দেন। তারপর আবার ডিভোর্স প্রত্যাহার করেন। তারা কয়েক মাস ধরে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একত্রে বসবাস করেন।
সবশেষ গত ১৬ জুন সিনথিয়া ইসলাম ফেসবুকে তাদের যুগল ছবি পোস্ট করে ঘোষণা দেন যে খন্দকার মুশতাক তার স্বামী। ফেসবুক প্রোফাইলের তথ্য পরিবর্তন করেও ‘ম্যারেড টু খন্দকার মুশতাক’ লেখেন তিনি।
তাদের দুজনের বিয়ের কাবিননামা, তালাক নোটিশের হলফনামা এবং সবশেষ তালাক প্রত্যাহারের হলফনামার কপি ঢাকা পোস্টের হাতে এসেছে।
কাবিননামা অনুযায়ী তারা বিয়ে করেছেন গত ২৫ মার্চ। ওইদিন সিনথিয়ার বয়স দেখানো হয়েছে ১৮ বছর এক মাস। অর্থাৎ তার জন্ম তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ দেখানো হয়েছে। কাবিননামায় খন্দকার মুশতাকের বয়স দেখানো হয়েছে ৬০ বছর। তার জন্ম দেখানো হয়েছে ১৯৬৩ সালে।
কাবিননামায় লেখা হয়, তারা দীর্ঘদিন পরস্পরকে ভালোবেসে আসছেন। এ সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দিতে তারা বিয়ে করেছেন।
বিয়েতে মুশতাকের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন ওসমান গণি, আবুল হোসাইন ও মো. শামসুল হক। সিনথিয়ার পক্ষে সাক্ষী ছিলেন রতন সরকার ও আবুল হাসান শেখ।ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে কথা হয় দুইজন সাক্ষী ওসমান গণি ও শামসুল হকের সঙ্গে। তারা এই বিয়ের বিষয়ে কোনো তথ্যই জানেন না। তাহলে সাক্ষী হলেন কীভাবে? জবাবে তারা বলেন, তা মুশতাক ভালো বলতে পারবেন। অন্য সাক্ষী আবুল হোসাইনের মোবাইলে না পেয়ে নতুন বাজার তার বাসায় গেলে তিনিও এ বিষয়ে কিছু জানেন না বলে ঢাকা পোস্টকে জানান।
আরও পড়ুন : তদবিরের চাপ ঠেকাতে ফোন বন্ধ রাখছেন প্রতিমন্ত্রী-সচিব-ডিজি
বিয়ের আড়াই মাস পর গত ১১ জুন খন্দকার মুশতাককে তালাকের নোটিশ পাঠান সিনথিয়া। ওই নোটিশে লেখা হয়, ‘খন্দকার মুশতাক একজন বদমেজাজি, নারীলোভী। তাকে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেন তিনি। এ বিয়ে তিনি মানেন না, তার সঙ্গে তিনি সংসার করতে চান না।’
এর দুদিন পর অর্থাৎ গত ১৩ জুন আবার তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করে নেন সিনথিয়া। সেখানে তিনি লেখেন, ‘তালাকের ওই নোটিশ তার বাবা-মা জোর করে পাঠিয়েছেন। তার কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিনথিয়ার বাবা সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার মেয়েকে ঠাকুরগাঁও থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসেন খন্দকার মুশতাক।’ আর খন্দকার মুশতাক বলেন, ‘এখানে কোনো অপহরণের ঘটনা ঘটেনি। সিনথিয়া নিজেই আমার কাছে ফিরে এসেছে। সে এখন আমার সঙ্গে আছে এবং ভালো আছে।’
মধ্যরাতে বাসা থেকে বের হয়ে যান সিনথিয়া
৬০ বছর বয়সী খন্দকার মুশতাককে বিয়ে করার পর বিষয়টি নিয়ে সিনথিয়ার পরিবারের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। বাবা-মা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে গ্রামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও নিয়ে যান। সেখানে পরিবারের সবাই তাকে বোঝান যে এমন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। একপর্যায়ে সবার চাপে তালাক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সিনথিয়া।
তার বাবার অভিযোগ, তালাক দেওয়ার পর মুশতাক তার মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আরও নানা প্রলোভন দেখান। তার প্রলোভনে পড়ে ১২ জুন রাত আড়াইটায় ঘর থেকে বের হয়ে যায় সিনথিয়া। মুশতাকের গাড়ি আগে থেকেই তাদের বাড়ির আশপাশে ছিল। সেই গাড়ি দিয়ে গভীর রাতে ঢাকায় চলে আসে সিনথিয়া।
থানায় সাধারণ ডায়েরি
মেয়ে নিখোঁজ দাবি করে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন বাবা সাইফুল ইসলাম। সেখানে তিনি লেখেন, আমার মেয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের একাদশ শ্রেণিতে প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ওই প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সদস্য খন্দকার মুশতাক আমার কন্যাকে প্রলোভন দেখিয়ে এবং ফুসলিয়ে গোপনে গত ২৫ মার্চ অ্যাফিডেভিট ও কাজীর মাধ্যমে বিবাহ করে। আমার মেয়ে সেই ভুল বুঝতে পেরে তাকে তালাক দেন। গত ১২ জুন রাত ২টার পর তার মা টয়লেট থেকে এসে দেখেন মেয়ে বিছানায় নেই। তাকে খন্দকার মুশতাক অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে গেছে।
অবশেষে বিয়ের ঘোষণা ও যুগল ছবি প্রকাশ
অনেক জল ঘোলা করার পর গত ১৬ জুন সিনথিয়া ইসলাম ফেসবুকে যুগল ছবি পোস্ট করে খন্দকার মুশতাককে তার স্বামী বলে পরিচয় করিয়ে দেন। দুজনের একটি ‘ক্লোজ’ ছবি পোস্ট করে তিনি লেখেন, 'আমার হাসব্যান্ড খন্দকার মুশতাক আহমেদ। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।'
একইভাবে গত ২২ জুন নরসিংদীর আনন্দ ভবনে তোলা তাদের যুগল ছবি পোস্ট করে খন্দকার মুশতাক লেখেন, ‘প্রিয় এসেছে আনন্দ ভবনে।’
অর্থাৎ দুজনেই তাদের সম্পর্ক স্বীকার করলেন এবং বিয়ের ঘোষণা দিলেন।
সম্পর্ক শুরু আরও আগে, বিয়েও কি আগে হয়েছে?
বিয়ের কাবিননামায় রেজিস্ট্রি কপিতে সিনথিয়া ইসলাম ও খন্দকার মুশতাক হলফ করে লিখেছেন, তারা দুজন দীর্ঘদিন ধরে একে-অপরকে জানা ও বোঝার পর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে একত্রে থাকার ইচ্ছা থেকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
দীর্ঘদিন বলতে কত দিন বুঝিয়েছেন, তা তারা পরিষ্কার করেননি। ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধান বলছে, তাদের সম্পর্ক অন্তত ছয় মাস কিংবা এক বছর আগে গড়ে ওঠে। সিনথিয়ার বাবার তথ্য অনুযায়ী মুশতাক তার মেয়ের পেছনে এক বছর আগে থেকে লেগেছেন। মেয়ে তখন স্কুলে পড়ে। অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বয়স্ক একটা মেয়েকে প্ররোচিত করেছেন মুশতাক।
সিনথিয়ার বন্ধু ও সহপাঠীদের মধ্যেও অনেকে বিশ্বাস করেন যে তাদের সম্পর্ক গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সাল থেকে শুরু হয়েছে। তবে তারা কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
ঢাকা পোস্টের হাতে আসা তথ্য বলছে, অন্তত এ বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে তাদের মধ্যে বেশ ‘ইন্টার্যাকশন’ বা পারস্পরিক যোগাযোগ হয়েছে। খন্দকার মুশতাকের কিছু ফেসবুক পোস্টে সিনথিয়া ইসলামের কমেন্ট তেমনই ইঙ্গিত দেয়।
আরও পড়ুন : তাপীয় দ্বীপের ‘হিট বোম্ব’ হচ্ছে ঢাকা
এক পোস্টে সিনথিয়া কমেন্ট করেন, ‘ইউ লুক অ্যামেজিং!’ আরেক পোস্টে কমেন্ট করেন, ‘সো কিউট’! আরেকটিতে কমেন্ট করেন, ‘লাভ দিস।’
এসব ইন্টার্যাকশনের সময় (জানুয়ারি ২০২৩) সিনথিয়া অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন।
ওই সময়ের একটি পোস্টে খন্দকার মুশতাক আকারে-ইঙ্গিতে সিনথিয়াকে 'মাই বিলাভড ওয়াইফ' বলে সম্বোধন করেন। এর উত্তরে সিনথিয়া ‘লাভ’ চিহ্ন দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান!
রেজিস্ট্রি কাবিননামায়ও তারা উল্লেখ করেন, কোর্ট ম্যারেজ করার আগে তারা মুসলিম আইন অনুযায়ী শরিয়ত মেনে একজন হুজুর দ্বারা কালিমা পড়ে বিয়ে করেছেন। সেই বিয়ে কবে হয়েছে তা নিশ্চিত হতে পারেনি ঢাকা পোস্ট। তবে, একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে যে তাদের বিয়ে খন্দকার মুশতাকের বাড়িতে হয়েছে এবং কোর্ট ম্যারেজের বেশ আগেই হয়েছে।
একটি সূত্রে বিয়ের দিনের কিছু ছবিও পেয়েছে ঢাকা পোস্ট। যার একটিতে গলায় গাঁদা ফুলের মালা পরা অবস্থায় খন্দকার মুশতাককে পায়ে ধরে সালাম করতে দেখা যায় সিনথিয়া ইসলামকে।
মহারাজা মুশতাক ও মহারানি সিনথিয়া
খন্দকার মুশতাক নিজেকে কখনো ‘কিং মুশতাক’, কখনো ‘মহারাজা’ আবার কখনো শুধু ‘রাজা’ বলে প্রচার করেন। সিনথিয়াকে তিনি কখনো ‘রানি’, কখনও ‘মহারানি’ বলেও সম্বোধন করেন।
তার কয়েকটি ফেসবুক পোস্টে এ বিষয়ে বার্তা পাওয়া যায়। গত ৪ এপ্রিল এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘বাংলার জননন্দিত মহান সুদর্শন রাজা খন্দকার মুশতাক আহমেদ...!’ আরেক পোস্টে তিনি সিনথিয়াকে ইঙ্গিত করে ‘রানি’ লেখেন।
এছাড়া আগের অনেক ফেসবুক পোস্টে তিনি নিজেকে ‘রাজা-মহারাজা’ বলে সবার সঙ্গে পরিচিত করেন। তার ফেসবুক বন্ধু ও পরিচিতরাও তাকে ‘কিং’ ও ‘রাজা’ বলে বিভিন্ন কমেন্টে সম্বোধন করেন।
অপহরণের মামলা ও হাইকোর্টে মুশতাকের জামিন
অপহরণের ঘটনায় সিনথিয়ার বাবা সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে খন্দকার মুশতাকের বিরুদ্ধে গত ২২ জুন ঠাকুরগাঁওয়ের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের করেছেন। ট্রাইব্যুনাল মামলাটি তদন্ত করে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে ঠাকুরগাঁও সদর থানাকে নির্দেশ দেন।
এদিকে, এ মামলায় আজ মঙ্গলবার (৪ জুলাই) হাইকোর্ট থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন নিয়েছেন খন্দকার মুশতাক। ছয় সপ্তাহ পর তাকে ঠাকুরগাঁওয়ের আদালতে হাজির হতে হবে। হাইকোর্টে আজ সিনথিয়া ইসলামও উপস্থিত ছিলেন বলে জানান তাদের আইনজীবী মো. সোহরাব হোসেন পলাশ ও জাহিদুল হক।
বাবার বিরুদ্ধে মেয়ের জিডি
এদিকে নিজের এবং স্বামী মুশতাক আহমেদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে গত ১৪ জুন গুলশান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলাম। সেখানে তিনি লিখেছেন তার বাবা সাইফুল ইসলাম তাকে মারধর করেছেন এবং আগামীতে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। এছাড়া মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনকে শায়েস্তা করবেন বলেও শাসিয়েছেন।
বড় অভিযোগ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে
৬০ বছরের ডোনার সদস্য আর কলেজের ১৮ বছরের ছাত্রীর মধ্যে ‘অসম সম্পর্ক’ স্থাপনের পেছনে অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বড় ভূমিকা রেখেছেন বলে সিনথিয়ার বাবা, আইডিয়ালের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন। তারা বলছেন, অধ্যক্ষের প্ররোচনায় এবং সার্বিক সহযোগিতায় তারা কলেজ ক্যাম্পাসে লজ্জাহীনভাবে একত্রে ঘোরাফেরা করেছেন এবং আপত্তিকর আচরণ করেছেন।
এক শিক্ষার্থী জানান, তারা জানতেন দুজনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। প্রিন্সিপাল ম্যাম এটাতে সাপোর্ট দিয়েছেন। নরসিংদীর আনন্দ ভবনে অনেক কিছু হয়েছে, যা আপত্তিকর ছিল। কিন্তু অধ্যক্ষ স্বয়ং সাপোর্ট দেওয়ায় অন্য শিক্ষার্থীরা কিছু বলেননি।
সিনথিয়া ইসলামের পরিবারও আঙুল তুলছে অধ্যক্ষের দিকে। তাদের দাবি, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু মুশতাকের পক্ষে মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করেছেন অধ্যক্ষ।
মুশতাকের বাগানবাড়িতে সিনথিয়া, অধ্যক্ষ আর মুশতাকের একত্রে তোলা ছবিও প্রমাণ করে দুজনের প্রতি তার বিশেষ সমর্থন বা আশীর্বাদ রয়েছে। এমন অভিযোগের বিষয়ে অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর কাছে জানতে চাওয়া হয়। তার কাছে প্রশ্ন রাখা হয়, আপনার মধ্যস্থতায় সিনথিয়া ও মুশতাকের বিয়ে হয়েছে বলে সবাই বলাবলি করছে, এটা সত্য কি না। উত্তরে তিনি বলেন, 'নো কমেন্ট।’
জানতে চাওয়া হয়, ৬০ বছর বয়সী একজন আপনার অল্প বয়সী এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন, তা জেনেও কোনো পদক্ষেপ নেননি। এটা কি নৈতিক দিক থেকে ঠিক হলো? তিনি উত্তর দেন, 'নো কমেন্ট'!
প্রতিবারই ‘নো কমেন্ট’ বলে ফোন কেটে দেন অধ্যক্ষ।
সচিবালয়ের সামনে পোস্টার
খন্দকার মুশতাক ও অধ্যক্ষের বিচার চেয়ে কোরবানির ঈদের আগে সচিবালয়সহ বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং করা হয়। এতে ওই দুজনের পাশাপাশি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি ও সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিচারও চাওয়া হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে গত সপ্তাহে অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদী বলেন, ‘পোস্টারের বিষয় আমার নজরে আসেনি। যারা করছে নিশ্চয়ই না বুঝে করছে। ওই মেয়ের বিয়ের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
আইডিয়াল স্কুলের সভাপতি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান বর্তমানে হজ পালন করতে সৌদি আরব রয়েছেন। তাই তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
খন্দকার মুশতাক যা বলছেন
ঘটনার ‘নায়ক’ আবার ‘খলনায়ক’ (অনেকের দৃষ্টিতে) ডোনার সদস্য খন্দকার মুশতাক তার বিয়ে নিয়ে শক্ত অবস্থানে আছেন। তিনি মনে করেন, তার সিদ্ধান্ত সঠিক এবং আইনগতভাবে বৈধ। সুতরাং এখানে কারও কিছু বলার নেই। কেউ কিছু বললেও তার কিছুই আসে যায় না।
ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘আমি মুসলিম আইন অনুযায়ী এবং বাংলাদেশের আইন মতে বিয়ে করেছি। নৈতিকভাবেও এটা ঠিক আছে। কারণ, সে (সিনথিয়া ইসলাম) ১৮ বছরের প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারী। স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। সে এখন আমার সঙ্গে খুব সুন্দরভাবে সংসার করছে।’
পোস্টারিং বা নেতিবাচক প্রচার নিয়ে তিনি বলেন, ‘এগুলো নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এসব করে আমার কিছু করতে পারবে না তারা। সামনে গভর্নিং বডির নির্বাচন, সেখানে আমার ক্ষতি করার জন্য এসব করা হচ্ছে।’
‘প্রাপ্তবয়স্ক’ সিনথিয়া ইসলাম যা বলছেন
সিনথিয়া ইসলামের বক্তব্য নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছে ঢাকা পোস্ট। কিন্তু তার মোবাইল নম্বর প্রায়ই বন্ধ পাওয়া যায়। অন্য উপায়ে বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
তবে, এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে সিনথিয়া ইসলাম নিজেই ফেসবুকে কয়েকবার লাইভে আসেন এবং নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। তিনি বলেন, ‘তাকে নিয়ে এবং খন্দকার মুশতাককে নিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তাকে কেউ নির্যাতন করেনি এবং তিনি ১৮ বছর বয়সের একজন নারী। তার জীবনের ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তার আছে।
বেদনাক্লিষ্ট অসহায় বাবা
সিনথিয়া ইসলামের পিতা সাইফুল ইসলামের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদকের পাঁচবার কথা হয়। প্রতিবারই তিনি ফোনে কান্নাকাটি করেন। অনেক দুঃখ করে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের সবাই শিক্ষিত। কষ্ট করে সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছি। আমার স্বপ্ন ছিল মেয়েকে ডাক্তার বানাব। আমার সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত করছে মুশতাক। আমি তার বিচার চাই।’
তার অভিযোগ অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, “অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীর মধ্যস্থতায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। আমার মেয়ের জীবন, তার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। অভিভাবকরা এ বিষয়ে বারবার ফোন দিয়ে আমার কাছে জানতে চাইছেন। আমি কী বলব? আমার তো বুক ফেটে শুধু কান্না আসে। আমার মেয়ের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে জেনেও তিনি (অধ্যক্ষ) এ অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করেছেন। এটা খুবই জঘন্য কাজ হয়েছে। আমি অধ্যক্ষের বিচার চাই।”
উদ্বেগ-আতঙ্কে ‘বিব্রত’ অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা
মুশতাক-সিনথিয়ার ঘটনা প্রকাশের পর থেকে আইডিয়ালের অভিভাবক ও মেয়ে শিক্ষার্থীরা উদ্বেগের মধ্যে আছেন। অনেকে বেশ বিব্রত বোধ করছেন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, একজন ৬০ বছর বয়সের ব্যক্তি কীভাবে ১৮ বছরের একটি মেয়েকে বিয়ে করে? তাও আবার যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তিনি অভিভাবক প্রতিনিধি সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীকে বিয়ে করেছেন। এটা অন্য সবার জন্য একটা নেতিবাচক উদাহরণ তৈরি হলো।
আইডিয়ালের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দুটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এগুলো পরিচালনা পর্ষদকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে। এ দুটি ঘটনা খতিয়ে দেখতে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে ঢাকার এক এডিসিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
স্কুলের একাধিক অভিভাবক প্রশ্ন রেখে বলেন, যেখানে ৬০ বছর বয়সী একজনের নজর পড়ে ১৭-১৮ বছরের শিক্ষার্থীর ওপর, সেখানে আমাদের মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়?
আইডিয়ালের গভর্নিং বডির সদস্য শাহাদাৎ ঢালী বলেন, ‘একজন ছাত্রীর সঙ্গে একজন অভিভাবক সদস্যের এ ধরনের সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্পূর্ণ অনৈতিক। এমনকি ওই সম্পর্ক বিয়েতে গড়ালেও তা আপত্তিকর। এটি নৈতিকতার চরম লঙ্ঘন। আমরা আইডিয়ালের অভিভাবকরা এটা মেনে নেব না। আমরা এখন তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। সেটি এলে গভর্নিং বডির মিটিং করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।‘
অভিভাবক ফোরামের বক্তব্য
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিতে (আইডিয়ালে) এর আগেও ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। আগে সঠিক বিচার হলে বা পদক্ষেপ নিলে নতুন করে এমন ঘটনা ঘটত না। এখন অধ্যক্ষের মধ্যস্থতায় এ ধরনের ঘটনা শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের উদ্বেগ বাড়াবে।’
শিক্ষাবিদরা বলছেন ‘এটা অনৈতিক’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যদি দুজনের সম্মতিতে বিয়ে হয় তাহলে কোনো সমস্যা দেখছি না। তবে, এ ধরনের ঘটনায় দুটি দিক থাকে। একটি হলো আইনি, অন্যটি হলো নৈতিক। এখানে নৈতিক জায়গা নিয়ে কথা আছে। আমাদের সমাজে এ ধরনের বিয়েকে অন্য চোখে দেখা হয়। স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য বা অধ্যক্ষের মধ্যস্থতায় যদি এ ঘটনা ঘটে থাকে তবে তা অবশ্যই ঠিক হয়নি। কারণ, অধ্যক্ষ শুধু শিক্ষার্থী নয়, অভিভাবকদেরও অভিভাবক। তিনি যদি বিয়ে করার ব্যাপারে মেয়েটির ওপর কোনো ধরনের প্রভাব বিস্তার করে থাকেন তবে তা অনৈতিক হয়েছে।’
শিক্ষাবোর্ড ও অধিদপ্তর মনে করে ‘বিষয়টি সমর্থনযোগ্য নয়’
জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আইনগত দিক নয়, নৈতিক দিক চিন্তা করলে এ ঘটনা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এ ধরনের ব্যক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত নয়।’
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘৬০ বছরের একজন বৃদ্ধ ১৮ বছরের মেয়েকে বিয়ে করবে, এতে আইনি কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু উনি যেহেতু স্কুলের গভর্নিং বডির সদস্য হয়ে স্কুলের একটি মেয়েকে বিয়ে করেন, এটা নৈতিকতা বিরোধী। এটা সমর্থনযোগ্য নয়।’
তিনি বলেন, বিষয়টি অভিযোগ আকারে শিক্ষাবোর্ডের কাছেও এসেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষাবোর্ড সমন্বয় করে তদন্ত করছে।
তার বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেবেন— এমন প্রশ্নে বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, ‘কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
তদন্তের কী খবর
ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি করেছে আইডিয়াল কর্তৃপক্ষ। সেটি মাত্র এক সদস্য বিশিষ্ট! ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মমতাজ বেগম একাই তদন্ত করছেন এ ঘটনার। জুনের প্রথম সপ্তাহে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মমতাজ বেগমের কাছে জানতে চাওয়া হয়— তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে, প্রতিবেদন কবে নাগাদ জমা দিতে পারবেন। তিনি এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। বলেন, ‘আপনি এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলুন। যা জানার তার কাছ থেকে জানুন।’
জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমানের বক্তব্য জানতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলেও তার ফোন ব্যস্ত পাওয়া যায়।
এনএম/জেএস