সোনা অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু হিসেবে পরিচিত। সোনার ব্যবহার বলতে মানুষ স্বর্ণালংকার বা গহনা পরাকে বোঝায়। স্বর্ণশিল্প প্রাচীনতম শিল্পগুলোর মধ্যে একটি। ঊর্ধ্বমুখী বাজার মূল্যে অলংকার হিসেবে স্বর্ণের চাহিদা বা ব্যবহারে কিছুটা ভাটা পড়েছে মনে হলেও দেশে অবাধে প্রবেশ করছে সোনা। যার অধিকাংশ আসে চোরাচালানের মাধ্যমে।

২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালায় (২১ সালে সংশোধিত) আমদানির সুযোগ দেওয়া হলেও আমদানি হচ্ছে খুবই কম। বেশিরভাগই আসছে চোরাই পথে। এজন্য গড়ে উঠেছে বিশেষ সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট ব্যাগেজ রুলের আওতায় বৈধভাবে এবং চোরাচালান ও নানা অবৈধ উপায়ে সোনা আমদানি করছে। এর ফলে একদিকে সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

দেশে সোনার চাহিদা কত আর আসছে কী পরিমাণ স্বর্ণ তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য রয়েছে।

যেমন স্বর্ণ নীতিমালার প্রস্তাবনায় উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে ২০ থেকে ৪০ মেট্রিক টন সোনার চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) এক সমীক্ষা বলছে, দেশে স্বর্ণের চাহিদা প্রায় ৪৩ মেট্রিক টন। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) তথ্যানুসারে বছরে দেশের সোনার চাহিদা পূরণে ১৮ থেকে ২০ টন নতুন সোনা দরকার হয়।

আরও পড়ুন : নিখুঁত অলংকার তৈরিতে সেরা বাংলাদেশ, রপ্তানিতে বাধা কোথায়? 

চাহিদাকৃত সোনার মধ্যে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আসা সোনা ও পুরনো বা তেজাবি সোনার জোগানের মাধ্যমে স্বর্ণের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে। এতদিন ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা কম আসলেও সম্প্রতি যাত্রীদের মাধ্যমে সোনা আসা বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে ৫৪ টনের মতো সোনা দেশে এসেছে। যদিও এর আগে থেকেই এই মাধ্যমে এবং এর বাইরে চোরাকারবারির মাধ্যমে ৫-১০ গুণ সোনা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে এসে আবার পাচার হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অন্যদিকে বৈধভাবে সোনা আমদানির পরিমাণ খুবই কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে সোনা আমদানি হয়েছে মাত্র ১৪৮ কেজির মতো।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে কম-বেশি ৪০ হাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী আছেন, যারা প্রত্যক্ষভাবে এই স্বর্ণ ব্যবসায় জড়িত। যদি একজন ব্যবসায়ী এক ভরি করে স্বর্ণ ব্যবহার/বিক্রি করেন, তাহলে বছরে দেশের স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে ১৭০.২৯ টন। যার বর্তমান বাজার মূল্য (৯৮ হাজার টাকা/ভরি ও ১ টন-৮৫৭৩৫.৩২ ভরি) আছে প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার ৭৮ কোটি ৭০ লাখ ২৯ হাজার টাকা। যদি এই ব্যবহার/বিক্রির পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেশি হয় তবে স্বর্ণের চাহিদা হবে ২৫৫.৪৩৫ টন এবং এর বাজার মূল্য ২ লাখ ১৪ হাজার ৬১৮ কোটি ৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। চাহিদাকৃত ওই সোনার ন্যূনতম প্রায় ২০ ভাগ চাহিদা যদি বৈধভাবে পূরণ করা সম্ভব হয় তাহলে ধরে নেওয়া যায় প্রায় ৮০ শতাংশ বা ২০৪.৩৪৮ টন বা ১ কোটি ৭৫ লাখ ১৯ হাজার ৮৪১.১৭ ভরি অবৈধ পথে আসে। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১ লাখ ৭১ হাজার ৬৯৪ কোটি ৪৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী কেজি প্রতি সোনায় প্রযোজ্য ১৫.৫০ শতাংশ শুল্ক-কর বিবেচনায় নিলে এসব অবৈধ স্বর্ণের বিপরীতে শুল্ক-কর আসে ২৬ হাজার ৬১২ কোটি ৬৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। অর্থাৎ বছরে দেশ ওই পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর যদি ৪০ হাজার স্বর্ণ দোকানে প্রতিদিন এক ভরি হিসেবে বছরে ফাঁকি দেওয়া শুল্ক-কর প্রায় ২২ হাজার ১৭৭ কোটি ২০ লাখ টাকা।

আবার ২০২২ সালে ব্যাগেজ রুলে ৫৪ টন আসলেও ঘোষণা ছাড়া অন্তত তিনগুণ সোনা দেশে এসেছে। বাজুসের তথ্যানুসারে ওই সময়ে অন্তত ২০০ টনের বেশি সোনা দেশে এসেছে। অর্থাৎ ১৪৬ টন সোনা যদি স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা অনুযায়ী দেশে আসত তাহলেও প্রায় ১৯ হাজার ১৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকার রাজস্ব সরকারের কোষাগারে জমা হতো। যেভাবেই হিসাব করা হোক, চোরাকারবারিতে দেশ বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এটা পরিষ্কার।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে জুয়েলারি খাতে বছরের রাজস্ব আসে হাজার কোটি টাকার নিচে। যেমন স্থানীয় পর্যায় থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে রাজস্ব এসেছিল সাড়ে ৩২ কোটি টাকা। আর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এসেছিল ৫১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ব্যাগেজ রুলের আওতায় আসা রাজস্ব যোগ করা হলেও সবমিলিয়ে হাজার কোটি টাকার মতো রাজস্ব আসে বলে মনে করছেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন : শাহজালাল যেন ‘সোনার খনি’, চোরাচালানের এত সোনা যায় কোথায়?

সোনা চোরাচালান ও রাজস্ব আদায় প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সহ-সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা হিসাব করে দেখেছি আমদানিকৃত সোনার দাম লোকাল মার্কেটের চেয়ে বেশি পড়ে যায়। কোনো ব্যবসায়ী তো বেশি দামে সোনা কিনে কম দামে বিক্রি করবে না। এ কারণে সোনা আমদানির জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যাগেজে রুলের আওতায় ২০২২ সালে ৫৪ টন সোনা এসেছে। এছাড়া বিভিন্ন মাধ্যমে সোনা আসতেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানির চেয়ে ব্যাগেজ রুলে আনা বেশি লাভ। আমদানি করা তো এক ধরনের লোকসান।

সারা বিশ্বে ২০২১ সালে সব রকম অলংকারের বাজারের মোট আকার ছিল ২৪৯ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার, যার ৪০ শতাংশই স্বর্ণালংকার। প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে ২০৩০ সালে বিশ্বে অলংকার শিল্পের মোট বাজার হবে ৫১৮ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।

তিনি বলেন, এ কারণে স্বর্ণ চোরাচালানও বেশি হচ্ছে। ব্যাগেজ রুলে যদি ৫৪ টন আসে, তাহলে ঘোষণা ছাড়া অন্তত তিনগুণ সোনা বেশি আসছে দেশে। এক হিসাবে দেখা গেছে ২০০ টনের মতো সোনা দেশে আসছে। কিন্তু এত সোনার চাহিদা এ দেশে নাই। এগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে সোনা পাচারের সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রাও চলে যায়।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদের মতে যথাযথ আইন ও নীতিমালার বাস্তবিক প্রয়োগের অভাবে সরকারের খাতায় রাজস্ব যোগ হচ্ছে না।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘সোনা চোরাচালান হচ্ছে, এর বিপরীতে আইন ও নীতিমালাও রয়েছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আইন যথাযথভাবে যাচাই না করে করা হয়েছে। আইনের উদ্দেশ্য ও পরিস্থিতির সঙ্গে বাস্তবের মিল রাখা হয়নি। যে কারণে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না।’

যদিও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. ইফতেখারুজ্জামান  রাজস্ব না পাওয়ার পেছনে স্বর্ণ খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ আমদানি বন্ধ না হওয়াকে দায়ী করছেন।

আরও পড়ুন : ২৫০০ পরীক্ষার খাতায় বিশেষ সংকেত, মিলেছে ঘুষের প্রমাণও

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, স্বর্ণখাতে চোরাচালান বড় একটি সমস্যা। সমস্যা সমাধানে সরকার স্বর্ণ নীতিমালা করেছে। স্বর্ণখাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অবৈধ আমদানির নামে চোরাচালান শুধু নীতিমালা দিয়ে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ। সংশ্লিষ্ট অনেক আইন দেশে বিদ্যমান রয়েছে। চোরাচালান একটি অপরাধ, অবৈধভাবে সোনা বা পণ্য আনা একটি অপরাধ। এগুলো আসলে নিয়ন্ত্রিত হয় না। সে কারণে অপরাধ বন্ধ হয় না।

তিনি বলেন, আমাদের বর্ডার কন্ট্রোলের দায়িত্বে বর্ডার গার্ড বাহিনী ও কাস্টমসসহ বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্মরত রয়েছে। যাদের দক্ষতার অভাব থাকতে পারে কিংবা তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে। যে কারণেই হোক চোরাচালান বন্ধ হয় না। বাংলাদেশে অনৈতিক বিষয়গুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, সে কারণে ব্যাপকভাবে রাজস্ব আদায় থেকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে। এটি ব্যাপক উদ্বেগজনক বিষয়।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, দায়িত্বপ্রাপ্তদের যদি শুদ্ধাচারের মধ্যে না আনা যায় তাহলে এটা বন্ধ করা সম্ভব নয়। যত দিন  আইন ও নীতিমালার প্রয়োগ করতে না পারব, ততদিন এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। অনেক সময় অপরাধী চিহ্নিত হওয়ার পরও কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে। এই যে অপরাধী পার পেয়ে যায় সেটাই তো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এটাই বড় সমস্যা।

ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার

ব্যাগেজ রুলের আওতায় ব্যাগেজ সুবিধায় আনিত শুল্ক ও বাণিজ্যিকভাবে আমদানিকৃত সোনার কর কাঠামোতে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। ব্যাগেজ সুবিধায় বিমানবন্দর দিয়ে আসা একজন যাত্রী সর্বোচ্চ দুটি সোনার বার (২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি ওজন) ঘোষণা দিয়ে আনতে পারে। প্রতি ভরিতে দুই হাজার টাকা হিসাবে মোট ৪০ হাজার ১২৪ টাকা শুল্ক পরিশোধ করে একজন যাত্রী সোনার বার আনতে পারবেন। এর বাইরে ১০০ গ্রাম স্বর্ণালংকার বিনা শুল্কে আনতে পারবেন। এ কারণে যাত্রীদের মাধ্যমে বৈধভাবে সোনার বার আনার ঘটনা বেশ বেড়েছে।

যদিও তারতম্য কমাতে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর থেকে ব্যাগেজ রুলের পরিবর্তন আনা হয়েছে। যাত্রীদের মাধ্যমে সোনা আনার খরচ বেড়েছে। আগে একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম স্বর্ণের বার আনতে পারলেও বর্তমানে তা কমিয়ে ১১৭ গ্রাম করা হয়েছে। আর বাজেটে ব্যাগেজ রুল সংশোধন করে স্বর্ণবার আনার ক্ষেত্রে ভরি প্রতি (প্রতি ১১.৬৬৪ গ্রামে) শুল্ক ২ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৪ হাজার টাকা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বাজুসের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা আশা করছি ব্যাগেজ রুল সংশোধন করায়, এ দেশে স্বর্ণের চোরাচালান এবং মুদ্রা পাচার অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। কারণ ব্যাগেজ রুলের সুবিধা নিয়ে এর আগে অবাধে স্বর্ণ বার বা পিন্ড বিদেশ থেকে দেশে প্রবেশ করেছে। চোরাচালানের মাধ্যমে সেগুলো বিদেশে পাচার হয়। যদিও আমাদের দাবি ছিল ব্যাগেজ রুলের আওতায় বিদেশ থেকে আনা গহনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা ১০০ গ্রাম থেকে কমিয়ে ৫০ গ্রাম করা।

চোরাচালানের ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে স্বর্ণালংকার রপ্তানিও

স্বর্ণালংকারের বিশ্ববাজার সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বাজার গবেষণা (মার্কেট রিসার্চ) প্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে ২০২১ সালে সব রকম অলংকারের বাজারের মোট আকার ছিল ২৪৯ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার, যার ৪০ শতাংশই স্বর্ণালংকার। প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে ২০৩০ সালে বিশ্বে অলংকার শিল্পের মোট বাজার হবে ৫১৮ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।

চীন ও ভারতের মতো জনসংখ্যাবহুল দেশে ব্যাপক চাহিদার কারণে অলংকারের বিশ্ববাজারের প্রায় ৬০ শতাংশ অংশীদার এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। বিশ্বে হাতে তৈরি ও মেশিনে প্রস্তুত উভয় ধরনের অলংকারের চাহিদা রয়েছে। হাতে তৈরি অলংকার শিল্প বেশ শ্রমঘন এবং এতে মূল্য সংযোজন অনেক বেশি। এ ধরনের অলংকারের প্রায় ৮০ শতাংশ বাংলাদেশ ও ভারতে উৎপাদিত হয়। কিন্তু আইনের প্রয়োগ, যথাযথ নীতিমালা ও পরিকল্পনার অভাবে বিশ্ববাজারে হাতে তৈরি অলংকার রপ্তানিতে বাংলাদেশ খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে চাহিদার প্রায় পুরোটাই রপ্তানি করছে ভারত। ২০২১-২২ অর্থবছরে অলংকার রপ্তানি থেকে ভারতের আয় ছিল ৩৯.৩১ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধু স্বর্ণালংকার থেকে রপ্তানি আয় ছিল ৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার।

এ বিষয়ে বাজুসের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণালংকার রপ্তানির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের দরকার যুগোপযোগী স্বর্ণ নীতিমালা। এজন্য স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে বসতে হবে। তাহলে অনেকদূর যাওয়া সম্ভব হবে। আদর্শ নীতিমালা হলে আমাদের এই খাতের সম্প্রসারণ হবে, অনেক কর্মসংস্থান হবে। স্বর্ণালংকার রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব আমরা।

বর্তমান অবস্থান থেকে ২০৩০ সাল নাগাদ কোথায় যেতে পারে বাংলাদেশের স্বর্ণশিল্প- এ নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিউওয়াই রিসার্চ। ওই প্রতিবেদনের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২২ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত স্বর্ণালংকার, স্বর্ণের বার ও রুপার অলংকার বাজার প্রতি বছর গড়ে ১২ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে। ফলে ২০৩০ সালে বাংলাদেশে স্বর্ণালংকার, স্বর্ণের বার ও রুপা মিলিয়ে মোট বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ হাজার ১০৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারে।

আর ২০২২ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর স্বর্ণের বারের বাজার ১১ শতাংশ হারে বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে কিউওয়াই রিসার্চ। যেখানে ২০৩০ সালে বিক্রির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৮৭ কোটি ২৫ লাখ ডলারে।

কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা

বর্তমানে বাজুসের তালিকাভুক্ত ৪০ হাজার স্বর্ণ ব্যবসায়ী রয়েছে। স্বর্ণ শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে। বাজুসের তথ্যানুসারে যথাযথ নীতিমালা ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই এ শিল্পে ৪০-৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। দুবাই যেমন স্বর্ণ ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশও তেমন হতে পারে। যদিও স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের স্বর্ণ শিল্পের বড় বাধা হিসেবে দেখছেন স্বর্ণ আমদানিতে উচ্চ হারে করারোপ। বাজুসের প্রাথমিক ধারণা, প্রতিদিন স্থল, নৌ ও বিমান পথে অন্তত ২০০ কোটি টাকার স্বর্ণ বাংলাদেশে আসছে। অর্থাৎ বছরে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার স্বর্ণ দেশে আসছে। চোরাচালান বন্ধ করা গেলে স্বর্ণালংকার খাত থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেতে পারত। আবার শিল্পের সম্প্রসারণের ফলে প্রচুর কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হতো।

চোরাকারবারের নিরাপদ রুট বাংলাদেশ

বাংলাদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে যত স্বর্ণ প্রবেশ করে তার অধিকাংশ পাচার হয়ে যায়। তথ্য-প্রমাণ বলছে বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের সহজ রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশে সোনা পাচার করে। অভিনব বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশ হয়ে সোনা পাচার হচ্ছে।

বাজুসসহ স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের তথ্যানুসারে প্রধান তিনটি কারণে বাংলাদেশ থেকে স্বর্ণ পাচার হয়। যার মধ্যে রয়েছে- ভারতে স্বর্ণ আমদানিতে কর বেশি। বাংলাদেশে তুলনামূলক কম। কর বেশি হওয়ার কারণে বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশকে চোরাচালানের রুট হিসেবে বেশি ব্যবহার করা হয়। কারণ কর ফাঁকি দিয়ে কালোবাজার থেকে যদি স্বর্ণ সংগ্রহ করা যায়, তাহলে আরও বেশি লাভ।

বাংলাদেশকে স্বর্ণ চোরাচালানের সহজ রুট হিসেবে ব্যবহারের আরেকটি কারণ হচ্ছে ভারতে জুয়েলারি ব্যবসা। ভারতীয় স্বর্ণ রপ্তানির বড় বাজার রয়েছে। ভারতের জুয়েলারি ব্যবসা বিশ্ব বিখ্যাত। সে কারণে স্বর্ণের কাঁচামাল হিসেবে কালোবাজার থেকে প্রচুর স্বর্ণ সংগ্রহ করে তারা।

তৃতীয় কারণ, সন্ত্রাসী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যক্রম। যেখানে আর্থিক লেনদেন স্বর্ণবারের মাধ্যমে চলে। সংশ্লিষ্টদের মতে কালোবাজারে টাকা বা অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে স্বর্ণ বেশি নিরাপদ। কারণ এটা আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।

এ বিষয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও এনবিআর সদস্য ড. মো. শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে এনবিআর সব সময় তৎপর রয়েছে। শুল্ক স্টেশনগুলোকে সর্বোচ্চ নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে।  চোরাচালান প্রতিরোধে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে জনবল সংকটসহ নানা কারণে আমাদেরও সীমাবদ্ধতার রয়েছে।

কালোবাজারে টাকার বিকল্প যখন স্বর্ণ

চোরাকারবারিতে স্বর্ণ সবচেয়ে নিরাপদ বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকে। কারণ কালোবাজারে যত বড় পুঁজি ব্যবহার হয় তার পুরোটাই অপ্রদর্শিত আয়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমসের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চোরাকারবারিদের বিনিময়ের প্রধান আকর্ষণ হলো স্বর্ণ। এ কারণে শুল্ক-কর শূন্য করা হলেও স্বর্ণ চোরাকারবারি বন্ধ করা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে এটাই সবচেয়ে নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হয়। অবৈধ আয়ের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের আয় কখনোই অর্থনীতির মূল স্রোতে যোগ হয় না। কারণ মূল স্রোতে আনা হলেই উৎস নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। যদি কোনো কারণে ওই আয় প্রকাশ পেয়ে যায়, তাহলে কালো টাকার মালিকদের আয়কর প্রদানসহ বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। এমনকি বৈধ করার কর যদি শূন্যও করা হয়, তারপরও অপ্রদর্শিত আয় কখনোই সামনে আনবে না। এই ধরনের কালো টাকার মালিকদের কাছে সোনা নিরাপদ বিনিয়োগ।

আরএম/জেএস