দুদকের জালে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ বাড়ি কেনা এমপি গোলাপ
মাদারীপুর- ৩ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে নয়টি বাড়ি ক্রয়সহ অর্থপাচারের অভিযোগ ওঠে। অবশেষে এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযোগে আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নিউইয়র্কে মোট নয়টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৩ কোটি টাকা (এক ডলার সমান ১০৮ টাকা ধরে)।
বিজ্ঞাপন
দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে এবং আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করে দুদকের বিশেষ তদন্ত বিভাগ থেকে অনুসন্ধানের জন্য কমিশন থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া জ্যাকসন হাইটের একটি আলিশান ভবনে পাঁচটি কনডোমনিয়াম কেনেন। ওই সময় যার দাম ছিল প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫ কোটি টাকা)। এর কাছাকাছি কয়েকটি ভবনে তিনি আরও তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। যার দাম ছয় লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় সাত কোটি টাকা)। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জ্যাকসন হাইটসে আরও একটি সম্পত্তি কেনেন তিনি। যার মূল্য প্রায় এক দশমিক দুই মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা)। এসব সম্পত্তির সবই নগদ টাকায় কেনা হয়
জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য নয়।’
আরও পড়ুন >> এমপি গোলাপের বিরুদ্ধে যা বললেন ব্যারিস্টার সুমন
অন্যদিকে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগে সেই আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এর আগে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা পোস্টকে বলেছিলেন, ‘আদালত যেহেতু নির্দেশনা দিয়েছেন, সেহেতু দুদক এটি অনুসন্ধান করবে।’ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নয়টি বাড়ি কেনার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুদককে নির্দেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। দুদকের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। রিটে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলারের বিনিময়ে বাড়ি কেনা সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়।
গত ২৬ জানুয়ারি আবদুস সোবহান গোলাপের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
আরও পড়ুন >> নিউইয়র্কে গোলাপের ৯ বাড়ি : অনুসন্ধানে হাইকোর্টের নির্দেশ
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশের পর নির্দেশনা দুদকে পাঠানো হয়েছে। এর পরের অগ্রগতি আমার জানা নেই।’
দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, আবদুস সোবহান গোলাপ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক সম্পত্তি গড়ে তোলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় এসব তথ্য তিনি গোপন রাখেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়।
তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপি তাদের ওয়েবসাইটে করা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শুক্রবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন।
আরও পড়ুন >> আগামী নির্বাচনে আ.লীগই বিজয়ী হবে : গোলাপ
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মো. আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৪ সালে প্রথম নিউইয়র্কে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা শুরু করেন। ওই বছর নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি সুউচ্চ ভবনে অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তিনি। পরের পাঁচ বছরে তিনি নিউইয়র্কে একে একে মোট নয়টি প্রপার্টি বা সম্পত্তির (ফ্ল্যাট বা বাড়ি) মালিক হন। এসব সম্পত্তির মূল্য ৪০ লাখ ডলারের বেশি।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া জ্যাকসন হাইটের একটি আলিশান ভবনে পাঁচটি কনডোমনিয়াম কেনেন। ওই সময় যার দাম ছিল প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ২৫ কোটি টাকা)। এর কাছাকাছি কয়েকটি ভবনে তিনি আরও তিনটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। যার দাম ছয় লাখ ৮০ হাজার ডলার (প্রায় সাত কোটি টাকা)।
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে জ্যাকসন হাইটসে আরও একটি সম্পত্তি কেনেন তিনি। যার মূল্য প্রায় এক দশমিক দুই মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা)। এসব সম্পত্তির সবই নগদ টাকায় কেনা হয়।
আরও পড়ুন >> দুদকের নোটিশ ‘পাত্তা’ দেন না এলজিইডির অতিরিক্ত প্রকৌশলী
গত ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পর মোহাম্মদ আবদুস সোবহান মিয়া কম বেতনের কাজ, যেমন- পিৎজা তৈরি, ওষুধের দোকানে কাজ, লাইসেন্স ছাড়া ট্যাক্সি চালাতেন বলে জানান তার সহকর্মীরা। এসব কাজ থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে এভাবে অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ি কেনা সম্ভব নয়। এসব সম্পত্তি কিনতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাঠানো হয়েছে কি না— তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে সম্পত্তি কেনার জন্য বিদেশে অর্থ পাঠানোর সুযোগ নেই।
যার বিরুদ্ধে অভিযোগে সেই আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি
আবদুস সোবহান মিয়া ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর- ৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান। দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকও ছিলেন তিনি।
গত ২৬ জানুয়ারি আবদুস সোবহান মিয়ার (গোলাপ) বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগপত্র জমা দেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। ওই সময় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, আবদুস সোবহান মিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কসহ অন্যান্য স্থানে একাধিক বাড়ি কেনার তথ্য ২০১৮ সালের নির্বাচনী হলফনামায় গোপন করেন। এজন্য তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। আব্দুস সোবহান গোলাপ ২০১৪-১৫ সালে যখন এমপি ছিলেন তখন তিনি কী পরিমাণ দেশসেবা করেছেন যে সেবা করতে করতে নিউইয়র্কে নয়টা প্রপার্টিজ করেছেন। যেগুলো তার নিজের নামে আছে এবং এখন পর্যন্ত তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেননি।
তথ্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক ‘অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট’ বা ওসিসিআরপি তাদের ওয়েবসাইটে করা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শুক্রবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মো. আবদুস সোবহান মিয়া (গোলাপ) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন
‘শপথ নেওয়ার সাত মাস পর তিনি আমেরিকান সিটিজেনশিপ ত্যাগ করেন। অথচ আমাদের কনস্টিটিউশনে (সংবিধানে) আছে, আপনার যদি বিদেশি নাগরিকত্ব থাকে তাহলে কোনোভাবেই সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিতে পারবেন না। এ বিষয় নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন স্পষ্ট বলেছে, বিষয়টি দুদক দেখবে।’
আরও পড়ুন >> দুর্নীতির জালে বাফুফে, দুদকের জালে নেই কেন?
“গোলাপ সাহেবের নয়টা সম্পত্তি শুধু নিউইয়র্কে পাওয়া গেছে। কত সম্পত্তি যে বাংলাদেশে আছে তার হিসাব তো আর আমি নিতে পারব না। লোকটা যদি এসব সম্পত্তি এমপি থাকাকালীন করে থাকেন, তাহলে আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলের নাম ব্যবহার করে যে টাকাটা তিনি কামাই করেছেন অবৈধভাবে, এটা আপনি নিশ্চিত থাকেন যে নিপীড়িত এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কর্মী যারা তাদের কাছ থেকে নিয়েছেন। কাউকে পৌরসভার চেয়ারম্যান বানাবেন, কাউকে এমপি বানাবেন— এসব বলে টাকা নিয়েছেন। এত দীর্ঘ সময় পরও মানুষ আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে কষ্ট পায়, কারণ কিছু লোক টাকা বানিয়ে লাল হয়ে যাচ্ছে, আর কিছু লোক ওই যে বলে, ‘মজা মারে ফজা ভাই, আর আমরা শুধু বৈঠা বাই।’ কর্মীরা শুধু বৈঠা মারে, আর মজা পায় ওই গোলাপের মতো ফজা ভাইরা”— বলেন ব্যারিস্টার সুমনা।
আরএম/এমএআর