পাতালেও যাচ্ছে রেল
বহু বছরের বঞ্চনা, জনম জনমের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার দূত শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।‘ মুক্তির সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পুনর্জন্ম হয়েছে একটি জাতির। রক্তবন্যা পেরিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু হওয়া শাপমুক্তি পথের বাঁকে বাঁকে ছিল ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালিকে থামানো যায়নি, অমঙ্গলের বিষদাঁত ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নতুন সূর্য হাতে, ছড়িয়েছে নতুন আলো বিশ্বভুবনে। জীবনমান, অর্থনীতি, অবকাঠামোসহ বহু খাতে পেছনে ফেলেছে প্রতিবেশীদের। ঢাকা পোস্টের ধারাবাহিক উন্নয়নের গল্পগাথায় আজ থাকছে রেল খাতের সার্বিক উন্নয়ন…
ঢাকা মহানগরীর ১১টি রুটে ২৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল রেল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে সরকার। এর মধ্যে চারটি রুটের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ সেতু বিভাগের অধীনে এসব রেলপথ নির্মাণ করা হবে বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞাপন
সেতু বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ লাখ কর্মজীবী মানুষের অর্ধেকই মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করতে পারবেন। ফলে মাটির উপরিভাগে যান ও জনজট কমবে। বাঁচবে কর্মঘণ্টা, যানজটের অসহনীয় দুর্ভোগ থেকেও রেহাই মিলবে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের প্রায় ৮০ লাখ কর্মজীবী মানুষের অর্ধেকই মাটির নিচ দিয়ে চলাচল করতে পারবেন। ফলে মাটির উপরিভাগে যান ও জনজট কমবে। বাঁচবে কর্মঘণ্টা, যানজটের অসহনীয় দুর্ভোগ থেকেও রেহাই মিলবে
তারা আরও জানান, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে পরামর্শক হিসেবে স্পেনের টিপসা’র নেতৃত্বে জাপানের পেডিকো, বিসিএল অ্যাসোসিয়েটস, কেএসসি ও বেটস-কে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকায় পাতাল রেল নেটওয়ার্কের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১টি রুটের অ্যালাইনমেন্ট প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চারটি রুটে এ রেলপথ নির্মাণ হবে।
যে চারটি রুটে প্রাথমিকভাবে পাতাল রেলপথ নির্মাণ হবে তার মধ্যে ঝিলমিল থেকে টঙ্গী পর্যন্ত প্রায় ২৯ কিলোমিটার, শাহকবির মাজার রোড থেকে সদরঘাট পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার, কেরানীগঞ্জ থেকে সোনাপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৪৮ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসব রুটে পাতাল রেল চালুর সুপারিশ অনেক আগেই করা হয়েছিল। তবে এগুলো যেন বৃত্তাকার রেলপথ, মেট্রোরেলসহ অন্য প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, সেদিকে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে।’
ঢাকা মহানগরীকে পাতাল রেল বা সাবওয়ের আওতায় আনতে প্রথমে ৯০ কিলোমিটারের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে তা ২৩৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত হয়
বাংলাদেশ সেতু বিভাগের প্রকল্প কর্মকর্তারা ঢাকা পোস্টকে জানান, চুক্তি অনুযায়ী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে ২৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পাতাল রেলপথ নির্মাণের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাইসহ ৯০ কিলোমিটারের নির্মাণকাজের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব পায়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সমীক্ষা শেষে ২৫৮ কিলোমিটার সাবওয়ে (পাতাল রেল) নির্মাণের প্রস্তাবনা গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশ সেতু বিভাগে দাখিল করে।
সমীক্ষার ওই প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, পাতাল রেলের জন্য নির্মাণ হবে টানেল। এসব টানেল ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩০ মিটার নিচ দিয়ে যাবে। ফলে জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণজনিত কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে না।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার আলোকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পাতাল রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনাকে উচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। এজন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষার প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদিত হয়।
২৩৮ কিলোমিটার পাতাল রেল নির্মাণে ব্যয় হবে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পরিচালনার মাধ্যমে খরচ তুলে নেবে। তারপর প্রকল্পের দায়ভার সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে
এ রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও প্রাথমিক নকশা তৈরির কাজ করতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ২০১৮ সালের ২ আগস্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ২০১৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। এরপর ২০১৯ সালের মে মাসে প্রতিবেদন দাখিল করে বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে।
ঢাকা মহানগরীকে পাতাল রেল বা সাবওয়ের আওতায় আনতে প্রথমে ৯০ কিলোমিটারের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে তা ২৩৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বর্ধিত করার সিদ্ধান্ত হয়।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে ১১টি রুটের প্রস্তাব করে। বাংলাদেশ সেতু বিভাগের ১০টি দল সরেজমিনে অ্যালাইনমেন্ট পরিদর্শন করে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গত ১৫ মার্চ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের খসড়া প্রতিবেদন জমা দেয় বাংলাদেশ সেতু বিভাগের কাছে।
ব্যয় কত হবে সেটা চূড়ান্ত বলা যাবে সমীক্ষা শেষ হলে। প্রাথমিকভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া চারটি রুটে পাতাল রেল নির্মাণ করতে ২০৩০ সাল পার হয়ে যাবে
কাজী মুহাম্মদ ফেরদৌস, প্রকল্প পরিচালক
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত ৩৫ হাজার বাড়িঘর ও ৭০টি স্থানের ট্রাফিক জরিপ করে। যে ১১টি রুটের প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হলো— গাবতলী-ভোলাব ইউনিয়ন সড়ক (দৈর্ঘ্য ৩০.৫১ কিলোমিটার ও ২৬টি স্টেশন), ভাওয়াল (কেরানীগঞ্জ)-ঠুলঠুলিয়া (পূর্ব খিলগাঁও) (দৈর্ঘ্য ১৫.৬৮ কিলোমিটার, স্টেশন ১৪টি), বসুন্ধরা রিভার ভিউ-দক্ষিণ গাবতলী (দৈর্ঘ্য ১৭.৩৩ কিলোমিটার, ১৫টি স্টেশন), হাজারীবাগ-পূর্বাচল উত্তর (দৈর্ঘ্য ২৯.৪০ কিলোমিটার, ২৫টি স্টেশন), ঝিলমিল-টঙ্গী জংশন (দৈর্ঘ্য ২৮.৭১ কিলোমিটার, ২৭টি স্টেশন), শাহকবির মাজার রোড-সদরঘাট (দৈর্ঘ্য ২২.৯৯ কিলোমিটার, ২০টি স্টেশন) কেরানীগঞ্জ-সোনাপুর (দৈর্ঘ্য ১৯.৫০ কিলোমিটার, ১৮টি স্টেশন), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়-নারায়ণগঞ্জ (দৈর্ঘ্য ৪৭.৫৪ কিলোমিটার, ৪৪টি স্টেশন), তেঘরিয়া বাজার-নারায়ণগঞ্জ (দৈর্ঘ্য ১৩.৩৩ কিলোমিটার, ৮টি স্টেশন), টঙ্গী জংশন-কোনাবাড়ী (দৈর্ঘ্য ১৬.৯৯ কিলোমিটার, ১০টি স্টেশন), গাবতলী- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (দৈর্ঘ্য ১৫.৫২ কিলোমিটার, ৮টি স্টেশন)। এর মধ্যে চারটি রুটকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
ব্যয় ৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি
২৩৮ কিলোমিটার পাতাল রেল নির্মাণে ব্যয় হবে পাঁচ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। এক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত পরিচালনার মাধ্যমে খরচ তুলে নেবে। তারপর প্রকল্পের দায়ভার সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে।
বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে। পাতাল রেলের জন্য অর্থ জোগাড় কঠিন হবে না
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন, সচিব, সেতু বিভাগ
প্রায় চার বছর আগে পাতাল রেলের পরিকল্পনা করে বাংলাদেশ সেতু বিভাগ। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন এগিয়েছে ৬৪ শতাংশ। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কাজী মুহাম্মদ ফেরদৌস ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যয় কত হবে সেটা চূড়ান্ত বলা যাবে সমীক্ষা শেষ হলে। প্রাথমিকভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া চারটি রুটে পাতাল রেল নির্মাণ করতে ২০৩০ সাল পার হয়ে যাবে।
গত বুধবার ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত কর্মশালায় বাংলাদেশ সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের বাজেট ছিল ১৪০ কোটি টাকা। এখন তা প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করছে। পাতাল রেলের জন্য অর্থ জোগাড় কঠিন হবে না।
পিএসডি/এসকেডি/এমএআর/এমএমজে