রাজধানীতে নির্মাণ হচ্ছে বৃত্তাকার রেলপথ। ২৫ মিনিটে প্রদক্ষিণ করা যাবে পুরো ঢাকা

বহু বছরের বঞ্চনা, জনম জনমের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতার দূত শুনিয়েছিলেন মুক্তির গান। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’। মুক্তির সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পুনর্জন্ম হয়েছে একটি জাতির। রক্তবন্যা পেরিয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে শুরু হওয়া শাপমুক্তি পথের বাঁকে বাঁকে ছিল ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত। কিন্তু মুক্তিপাগল বাঙালিকে থামানো যায়নি, অমঙ্গলের বিষদাঁত ভেঙে ঘুরে দাঁড়িয়েছে নতুন সূর্য হাতে, ছড়িয়েছে নতুন আলো বিশ্বভুবনে। জীবনমান, অর্থনীতি, অবকাঠামোসহ বহু খাতে পেছনে ফেলেছে প্রতিবেশীদের। ঢাকা পোস্টের ধারাবাহিক উন্নয়নের গল্পগাথায় আজ থাকছে রেল খাতের সার্বিক উন্নয়ন… 

রাজধানীবাসীকে অসহনীয় যানজট থেকে মুক্তি দিতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এবার রাজধানীজুড়ে নতুন যোগাযোগ কাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বৃত্তাকার রেলপথের আওতায় আনা হচ্ছে গোটা রাজধানীকে। 

এ প্রকল্পের আওতায় মহানগরীর চারদিক ঘিরে থাকবে ২৪টি রেলস্টেশন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই ও নকশা প্রণয়নের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

রাজধানীতে নির্মাণ হচ্ছে বৃত্তাকার রেলপথ। ২৫ মিনিটে প্রদক্ষিণ করা যাবে পুরো ঢাকা। এ রেলপথ হবে ৮০ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে ৭০ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার হবে ভূমির ওপরে। বাকি ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার যাবে মাটির নিচ দিয়ে। রেলপথের ২৪টির মধ্যে ২১টি রেলস্টেশন হবে উড়াল, বাকি তিনটি হবে মাটির নিচে। প্রতি কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হবে ৮৮১ কোটি টাকা

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি এখনও সমীক্ষার পর্যায়ে আছে। সমীক্ষা শেষে বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা হবে। ঢাকার এ বৃত্তাকার রেলপথ হবে ৮০ দশমিক ৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে ৭০ দশমিক ৯৯ কিলোমিটার হবে ভূমির ওপরে। বাকি ৯ দশমিক ৯ কিলোমিটার যাবে মাটির নিচ দিয়ে। রেলপথের ২৪টির মধ্যে ২১টি রেলস্টেশন হবে উড়াল, বাকি তিনটি হবে মাটির নিচে।

এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মুক্তি মিলবে অসহনীয় যানজট থেকে

প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৭১ হাজার ২৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে হিসাবে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হবে ৮৮১ কোটি টাকা।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গাজীপুরের টঙ্গী থেকে শুরু করে আবার টঙ্গী স্টেশনে গিয়ে শেষ হবে রেলপথটি। টঙ্গী, আব্দুল্লাহপুর, ধউর, বিরুলিয়া, গাবতলী, রায়েরবাজার, বাবুবাজার, সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর, পোস্তগোলা, ফতুল্লা, চাষাঢ়া, সাইনবোর্ড, শিমরাইল, পূর্বাচল সড়ক, ত্রিমুখ হয়ে টঙ্গীকে আবার যুক্ত করবে রেলপথটি।

প্রথমে রেলপথটি রূপগঞ্জের তারাব সেতু এলাকা থেকে শুরুর পরিকল্পনা ছিল। তারপর ইস্টার্ন বাইপাস, আবদুল্লাহপুর, ডিএনডি বাঁধ, লালবাগ, পোস্তগোলা, কদমতলী হয়ে আবার তারাবতে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা। পরবর্তী সময়ে এ পরিকল্পনা বাদ দিয়ে টঙ্গী থেকে শুরু করে আবার টঙ্গী স্টেশনে শেষ করার পরিকল্পনা নেয় কর্তৃপক্ষ।

এ রুটে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। ট্রেনগুলো চলাচল করবে বিদ্যুতে। বৃত্তাকার রেলপথের স্টেশনগুলো হবে টঙ্গী, ত্রিমুখ, পূর্বাচল উত্তর, পূর্বাচল, বেরাইদ, ত্রিমোহনী, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, আদমজী, চিত্তরঞ্জন মোড়, চাষাঢ়া, ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা, সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, ঢাকা চিড়িয়াখানা দক্ষিণ, চিড়িয়াখানা উত্তরা, ধউর ও বিশ্ব ইজতেমা মাঠ

প্রকল্প বাস্তবায়নে এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। এজন্য প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘চায়না রেলওয়ে সিউয়ান সার্ভে অ্যান্ড ডিজাইন গ্রুপ কোম্পানি’।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, এ রুটে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলবে। ট্রেনগুলো চলাচল করবে বিদ্যুতে। বৃত্তাকার রেলপথের স্টেশনগুলো হবে টঙ্গী, ত্রিমুখ, পূর্বাচল উত্তর, পূর্বাচল, বেরাইদ, ত্রিমোহনী, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ, আদমজী, চিত্তরঞ্জন মোড়, চাষাঢ়া, ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা, সদরঘাট, কামরাঙ্গীরচর, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, গাবতলী, ঢাকা চিড়িয়াখানা দক্ষিণ, চিড়িয়াখানা উত্তরা, ধউর ও বিশ্ব ইজতেমা মাঠ।

 বৃত্তাকার রেলের ভিত্তি ভাড়া ধরা হয়েছে ৩০ টাকা ৬০ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া যুক্ত হবে তিন টাকা ৮০ পয়সা।

প্রাথমিকভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পাঁচ মিনিট পরপর দুদিক থেকেই ট্রেন চলাচল করবে। রাজধানীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে চলাচলে ২৫ মিনিট সময় লাগবে। স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে টিকিট ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে।

ঢাকার চারদিকে রেলপথ ব্যবস্থার ওপর বহু আগেই গুরুত্ব দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। বেশি স্টেশন থাকলে তাতে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে চলাচল সহজ হয়

ড. সালেহ উদ্দিন, পরিবহন বিশেষজ্ঞ

ট্রেনগুলো চলবে স্ট্যান্ডার্ড গেজ ডাবল লাইনে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায়। রেল কর্মকর্তারা এটাকে বলেন ‘ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন’। প্রতিটি ট্রেন হবে ছয় বগিবিশিষ্ট। এজন্য প্রথম ধাপে কেনা হবে ৩০ সেট ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ইএমইউ)। 

এ রেলপথ নির্মাণে প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছিল ২০১৪ সালে। এখন মূল প্রকল্পের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের ছক বা ডিপিপি তৈরি করা হবে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা আশা করছেন, মূল প্রকল্পের কাজ দ্রুতই শুরু করা যাবে।

ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) পরিচালিত বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় যাত্রীদের গন্তব্যের দূরত্ব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুই থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে। ছোট ছোট দূরত্বে যাওয়ার জন্য পাড়ি দিতে হচ্ছে অনেকটা পথ। এক্ষেত্রে বৃত্তাকার রেলপথ বাস্তবতার নিরিখেই উপযোগী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রকল্পটি দ্রুতই বাস্তবায়ন হবে। তবে কবে থেকে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে তা সমীক্ষার পরই জানা যাবে

ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার, মহাপরিচালক, বাংলাদেশ রেলওয়ে

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ঢাকার চারদিকে রেলপথ ব্যবস্থার ওপর বহু আগেই গুরুত্ব দিয়ে তা বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। বেশি স্টেশন থাকলে তাতে স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে চলাচল সহজ হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, প্রকল্পটি দ্রুতই বাস্তবায়ন হবে। তবে কবে থেকে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে তা সমীক্ষার পরই জানা যাবে।

রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজও এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে

রাজধানীর যানজট নিরসনে ঢাকার চারপাশে সার্কুলার রেলপথ (বৃত্তাকার রেলপথ) নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকল্পের প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয় ২০১৪ সালে। প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য ২০১৫ সালের ২৯ জুন পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠানো হয়। ওই বছরের ৪ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ‘অর্থায়ন প্রক্রিয়াকরণে অনুসৃতব্য পদ্ধতি’ শীর্ষক সভায় চীনা অর্থায়নে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্নের জন্য সংশ্লিষ্টদের অবহিতের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২০১৬ সালের ১৮ মে প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। একই বছরের ২ জুন রেলওয়ের ওই অনুরোধ পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় মন্ত্রণালয়। 

সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২ এপ্রিল প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয়ে এবং ১৮ অক্টোবর পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এটি নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করতে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ রেলওয়ে, চীনের সিউয়ান সার্ভে চীনের ডিজাইন গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড, বেটস কনসাল্টিং সার্ভিস লিমিটেড বাংলাদেশ ও ইঞ্জিনিয়ার অ্যান্ড অ্যাডভাইজার লিমিটেড বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পিএসডি/এসকেডি/এমএআর/এমএমজে