এবারের শীতে মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করছে করোনা/ ছবি সংগৃহীত

দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এরই মধ্যে সারাদেশে জেঁকে বসেছে তীব্র শীত। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি মাসেই দেশে অতিমাত্রার একাধিক শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। ফলে শীতকে কেন্দ্র করে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় সাধারণ জনমনেও একই শঙ্কা— শীত বাড়লে কি করোনার সংক্রমণও বাড়বে?

করোনাভাইরাসের বিস্তারে শীত বেশি দায়ী, নাকি মানুষের আচরণ— এ নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। অধিকাংশের দাবি, শীতকাল করোনাভাইরাসের জন্য আদর্শ সময়। এ সময়ের তাপমাত্রায় ভাইরাসটি বাড়ে, সহজে সংক্রমিত হয় এবং নিজের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে পারে। তবে অনেকেরই দাবি, বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশগুলোতে গরমের সময়ও করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তার দেখা গেছে। এমনকি, শীত বা ঠান্ডার সঙ্গে করোনাভাইরাসের কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা, এখনও পুরোপুরি প্রমাণিত হয়নি।

এ প্রসঙ্গে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখনও যেহেতু পুরোপুরি শীত আসেনি, একই সঙ্গে ধীরে ধীরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে; সেহেতু সামনের দিনগুলোতে তীব্র আক্রান্তের আশঙ্কা থেকেই যায়।’

শীতকালে মানুষ ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখে। বন্ধ জায়গায় করোনা বেশি ছড়ায়। শীতের সময় একটি বদ্ধ জায়গায় অনেক মানুষ অবস্থান করবে, ফলে সংক্রমণ বৃদ্ধির ঝুঁকি আছে। যদি আমরা স্বাস্থ্যবিধি না মানি, রোগী শনাক্ত না করি, আইসোলেশন না করি, তা হলে শীতে সংক্রমণ বাড়বে।

ডা. মুস্তাক হোসেন, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘শীতের সময় মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতিতে যে পরিবর্তন আসে, সে কারণেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়তে পারে। শীতে যেহেতু দরজা-জানালা বন্ধ থাকে, বদ্ধ ঘরে করোনাভাইরাস আসলে বাড়ে। সেজন্য বলা হয়, আলো-বাতাস ঠিকমতো চললে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি কম। কিন্তু বদ্ধ ঘরে এটা বাড়ে। এ কারণে একটা ভয় থেকেই যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘চীনে এই সংক্রমণ শুরু হয়েছিল গত শীতে। শীতপ্রধান দেশে এর ভয়াবহতা বেশি দেখা গেছে। অনেক শীতপ্রধান দেশে এখন তা বাড়ছে। সবমিলিয়ে এবারের শীতে এটা বাড়তে পারে।’

যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত বাংলাদেশি চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. বি এম আতিকুজ্জামান বলেন, ‘শীতের শুরুতেই শীতপ্রধান দেশগুলোতে করোনার আক্রমণ হয়েছে ভয়াবহ। গত এক সপ্তাহে আমেরিকাতেই রেকর্ড সংখ্যক মানুষ মারা গেছেন। ইউরোপের দেশগুলোতেও শীতে করোনার তীব্রতা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশগুলো ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশেও শীতের প্রকোপে করোনা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে আবার খারাপ হতে শুরু করেছে।’

করোনা আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্যস্ত স্বাস্থ্যকর্মীরা/ ছবি সংগৃহীত

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাস একটি বায়ুবাহিত রোগ। যখন বেশি ঠান্ডা পড়বে এবং মানুষ ঘরের ভেতরে থাকবে, আবদ্ধ জায়গায় পাশাপাশি থাকবে বা একই জায়গা শেয়ার করবে, তখন কিন্তু করোনার প্রকোপ আবারও বেড়ে যাবে। আরেকটা বড় সমস্যা হলো, সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিনের করোনা সংক্রমণে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছে, ফলে মাস্ক পরছেন না। ধুমধাম আয়োজনে বিয়েসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠান পালনের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব অনুষ্ঠানগুলোতে স্বাভাবিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হচ্ছে না। ঠিকমতো কেউ মাস্ক পরছেন না, দূরত্ব বজায় রাখছেন না, হাত না ধুয়েই মুখে স্পর্শ করছেন। এগুলোও এ সময়ে করোনা বাড়ার অন্যতম কারণ।’

যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের সময়ের চার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা করোনাভাইরাসের জন্য বিশেষ অনুকূল পরিবেশ বলে দেখা গেছে। করোনা জীবাণুর ক্ষেত্রে যে নিউক্লিয় এনভেলাপ থাকে, অর্থাৎ ভাইরাসের বাইরে যে আবরণ থাকে, যেটি জীবাণুর জেনেটিক কণাগুলোকে ঘিরে রাখে, সেটাকে বলা হয় লিপিড মেমব্রেন। আবরণটা তৈলাক্ত ধরনের। শীতকালীন পরিবেশে সেটা অনেকক্ষণ টিকে থাকতে পারে। ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিও কম থাকে।

এদিকে, শীতের সঙ্গে করোনাভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নেই— এমন দাবি করে বিশিষ্ট বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ রওশন আরা খানম বলেন, ‘যদিও ভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা কমে আসার পর এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে, তবে শীত বা তাপমাত্রার সঙ্গে করোনাভাইরাসের হ্রাস-বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক আছে, সেটা আমরা এখনও পাইনি। করোনাভাইরাস বিশ্লেষণে সবকিছুই একেবারে নতুন ধরনের দেখা যাচ্ছে।’

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়েছে মার্চ মাসে, যখন এখানে শীতকাল শেষ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে মে, জুন, জুলাই মাসের দিকে; যখন বাংলাদেশে পুরো গরম। প্রতিবেশী ভারতের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। ফলে করোনাভাইরাস বিস্তারে গরম আবহাওয়া কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। গরমপ্রধান অনেকে দেশেও ভাইরাসের বিস্তার ঘটতে দেখা গেছে। শীতপ্রধান দেশগুলোয় গ্রীষ্মের সময়েও করোনাভাইরাসের বিস্তার বন্ধ হয়নি।

শীতের দিনে গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা/ ছবি সংগৃহীত
যেসব গবেষণা হয়েছে, সেখানে ঠান্ডার সঙ্গে এ ভাইরাসের বিশেষ সম্পর্ক আছে। ঠান্ডা বাড়লে ভাইরাসের বিস্তার বাড়বে, এমন কিছু এখনও পাওয়া যায়নি।

চিকিৎসক রওশন খানম, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এস এম আলমগীর মনে করেন, এক বছরের চক্র শেষ না হলে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গতিপ্রকৃতির ওপর শীত-গ্রীষ্মের প্রভাব নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।

তিনি বলেন, ‘এখন ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে হাইপোথিসিস দেয় যে, শীত আসলে করোনাভাইরাস বেড়ে যাবে। বাংলাদেশে কিন্তু সিজনগুলো ভিন্ন। ওখানে শীত মানে তাপমাত্রা ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেল। বাংলাদেশে খুব শীতেও ১৪ থেকে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিরাজ করে। আমরা এটাকে শীত বলি, কিন্তু এটা তো ওরকম শীত নয়। তাপমাত্রা নিয়ে এখন কিছু না বলাই আসলে বেটার।’

লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন বিভাগের ডা. র‍্যশল লোয়ি বলেন, সঠিকভাবে এখনও বোঝা যাচ্ছে না যে, কী বা কোন পরিস্থিতিতে করোনা এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আবহাওয়ার বদল নাকি মানুষের চালচলনের ফলে করোনা বাড়ছে, তা সঠিকভাবে বোঝা যাচ্ছে না। তবে শরীরের বাইরে ঠান্ডার সময় বেশিদিন টিকে থাকে করোনার জীবাণু। করোনার ক্ষেত্রে ৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা খুবই সহায়ক। আল্ট্রা ভায়লেট লাইট কম থাকার ফলে এ ভাইরাস খুব তাড়াতাড়ি ছড়াতে পারে। 

তবে শীতে যদি করোনাভাইরাস অনেক বেশি ভয়ঙ্কর নাও হয়ে ওঠে, তারপরও বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির কারণে শীত মৌসুমে ঝুঁকি বাড়ার কথা স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলেছেন। এ অবস্থায় তীব্র শীতে করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়া রোধে যথাযথ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ায় জোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুস্তাক হোসেন বলেন, ‘করোনা মোকাবিলায় আমরা বারবার হাসপাতাল, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর প্রস্তুতির কথা বলছি। কিন্তু আমি মনে করছি, এই মুহূর্তে প্রস্তুতির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো করোনা সংক্রমণ কমিয়ে আনা। যারা নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের থেকে যেন ভাইরাসটি নতুন কাউকে আক্রান্ত করতে না পারে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, রাস্তাঘাটে, যানবাহনে, অফিস-আদালতে কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে তিনি পরীক্ষা না করিয়ে অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো ঘুরছেন-ফিরছেন। এমনকি মাস্কও ব্যবহার করছেন না।’

‘স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত আপাতত করোনা পরীক্ষা এবং হোম আইসোলেশনের দিকে গুরুত্ব দেয়া। বাসা-বাড়ি, সরকারি-বেসরকারি অফিসগুলোতে সরকারি দায়িত্বে গণহারে পরীক্ষা করানো উচিত।

ডা. মুস্তাক হোসেন, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা

তিনি বলেন, ‘তাহলেই প্রকৃত অবস্থাটা জানা যাবে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যাবে। আপনি যদি আইসিইউ বেড দ্বিগুণও করেন, সেইসঙ্গে সংক্রমণও যদি ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে, তাহলে তো সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। আমি বলছি না প্রস্তুতি নেয়ার দরকার নেই, প্রস্তুতিও নিতে হবে। আইসিইউ সংখ্যা কম থাকলে সেটা বাড়াতে হবে। যেসব হাসপাতালে, বিভাগে এবং জেলায় আইসিইউ সাপোর্ট নেই, সেগুলোতে দ্রুত আইসিইউর ব্যবস্থা করতে হবে।’

করোনায় স্বাস্থ্য বিধি পরিপালনে মানুষকে নির্দেশ/ ছবি সংগৃহীত

অধ্যাপক ডা. বি এম আতিকুজ্জামান বলেন, ‘আমরা শুধু কোভিড মোকাবিলায় করণীয় ও পদ্ধতি নিয়ে ভাবছি। কিন্তু কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়া রোধ করতে না পারলে কোনোভাবেই এটিকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না। এজন্যই সবার আগে করণীয় হলো, কোভিড সংক্রমণ রোধ করা এবং দ্রুত চিকিৎসা নেয়া। এছাড়া নিজেকে দ্রুত আইসোলেট করাও খুব জরুরি। এতে করোনার সংক্রমণটা ছড়াবে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘একজন ব্যক্তি যদি করোনায় আক্রান্ত থাকেন আর কোনো লক্ষণ যদি প্রকাশ না পায়, তাহলে তিনি হতে পারেন একটা এলাকার জন্য মরণাস্ত্র। কারণ ওই ব্যক্তি এ রোগ সবার অজান্তেই ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। অতএব শীতে সবাইকেই সতর্ক থাকতে হবে।’

ভ্যাকসিন সবাই কবে পাবেন, সেটা বলা যাচ্ছে না। এমনকি ভ্যাকসিন কতটুকু করোনা রোধ করতে পারবে, সেটাও বলা অনিশ্চিত। তাই ভ্যাকসিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত সতর্কতাই হলো প্রতিরোধের একমাত্র অস্ত্র।

ডা. মুস্তাক হোসেন, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত করোনায় সাত হাজার ৪২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ আট হাজার ৯৯ জনে।  এছাড়া সারাবিশ্বে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা আট কোটি ছাড়িয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ১৭ লাখ ৫৬ হাজার ৯৬৭ মানুষের।  সুস্থতার সংখ্যাও কম নয়। প্রাণঘাতী এ ভাইরাসকে পরাজিত করে মোট সুস্থ হয়েছেন পাঁচ কোটি ৬৪ লাখের অধিক মানুষ।

টিআই/এমএআর